সানোয়ার রাসেলের গল্প ‘রমিজের কপাল’

প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০২১

রমিজ খুব বাজে একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। একে তো পুলিশ তাকে হেব্বি মাইর দিয়া ভ্যানে তুলছে। তার উপর ভ্যানে উঠাইয়াই এমন একটা বাড়ি দিছে কোমর বরাবার, রমিজের মনে হইতাছিলো যে তার জীবনডা কোমরের মধ্যেই বুঝি এতদিন বাস করতো, এইমাত্র তা উইড়া গেলো গা। এরও উপরে তারে হাজতে ঢুকানির সময় এমনভাবে ঘাড় ধাক্কা দিছে যে, সে হুরমুর কইরা ফ্লোরে গিয়া পড়ছে। পড়ছে তো পড়ছে এমন জায়গায় যে, কুন হারামির পোলা আবার ঐহানে মনে হয় মুইতা থুইছিলো। মুতে, ধুলায়, রক্তে মাখামাখি হইয়া রমিজ একটা বাজে পরিস্থিতিতে হাজতে আটকা পইড়া আছে।

 

বাল... রমিজ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে। মনে মনে ভাবে, সব দোষ তার কপালের। পরক্ষণেই মনে ভাবে, কপাল তো সবারই থাকে। সব দোষ খালি তার কপালেরই হইব এইটা কেমন বিবেচনা! ধরা যাক, সে যদি গরীবস্য গরীব না হইতো, তার ফুটপাতের কাপড়ের ব্যবসাটা যদি করোনার লক ডাউনে ডুইব্যা না যাইতো, তাইলে কি সে এই পরিস্থিতিতে পড়ে আজকে? আর ঐ বালের ব্যবসা থাকলেই কি, না থাকলেই কি, রমিজ ফের ভাবে। ঝুটের মাল বাইর করতে অমুক তমুকের হাতে পাওয়ে ধরা, ফুটপাতে বাক্স লইয়া বসবার লাইগ্যা অমুক লীগ, তমুক লীগের তস্য নেতারে মাসকাবারি দেওয়া, তার উপরে দৈনিক ঠোলাগো চা-সিগ্রেটের টেকা- এই সব দিয়া থুইয়া যা থাকে তাতে কুনু সত্যিকার মাইনসের সংসার চলে? কুত্তার সংসার। হ, রমিজ ভাবে, এইগুলা হইলো কুত্তার জীবন। তো এরমধ্যে লক ডাউনে তো সব হাওয়া, ফক্কিকার! বান্দির পুতেরা বলে স্বেচ্ছাসেবী নামাইছে। এরে তারে খাওন, পিন্দন, হাগন, মুতন আরও কতো কি বলে দিছে, এহ! ছবির পরে ছবি, ছবির পরে ছবি তুলছে। গরীবের হোগামারা সারা, আর তারা বলে সরকারের কাছ থেইক্যা পুরস্কার নিছে।

রমিজ এত কিছু জানে না। শুধু জানে তার বউটা খিদার জ্বালায় মাগি হইয়া গেছে। তা কি করবে রমিজ? তার কি রোজগারের আর কুনু মুরোদ আছে? মাঝখানে মেয়র ইলেকশনের কয়ডা দিন একটু মুখ তুইলা চাইছিলো খোদায়। দৈনিক বিভিন্ন প্রার্থীর দুই চাইরটা কইরা মিছিলে যাইতে পারতো। পার মিছিল একশ টেকা। মন্দ ছিল না। তা সে আর কয়দিন? ভাবে রমিজ, এই যে মিছিল হইলো, ভোট হইলো, ভীড় হইলো, কই, তখন তো কারও করোনা হইলো না! খালি রমিজ ফুটপাতে কাপড় বেচতে লইলেই করোনা হয়? লক ডাউন শেষ হইলো, কিন্তু পরিস্থিতি তবু আগের মতো স্বাভাবিক হইলো না। আয় নাই, রোজগার নাই। সংসারে অশান্তি লাইগাই আছে। বউটা প্রথমে অভাবে শুরু করলেও, এখন তা স্বভাব হইয়া গেছে। রমিজ বেশি কিছু কইতেও পারে না। লক ডাউনের সময় যখন বউডা খারাপ কামে গেছিল, তখন তো পেডের চিন্তায় না করতে পারে নাই রমিজ! এখন কিছু কইলেই মুখ ঝামটায়া উঠে। হা হা হা। এই কথা মনে কইরা রমিজের বেদনার মধ্যেও হাসি উঠে। কিছু দিন রিক্সা চালায়া পেটের গতি করতে চাইছিল রমিজ।

একদিন দুই প্যাসেঞ্জারের গপ্পো শুনছিলো। এখন নাকি এলাকার ওসিমসিরাও নেতাগো আগের মতো গুণে না। তারা কয়, কিসের নেতা? আমরা না থাকলে তারা এইবার ক্ষমতায় আসতে পারতো নাকি? নাইটিলেকশনে তারা কয়টা কেন্দ্রে সিল মারছে? আমরাই তো সব পরিস্থিতি ঠিক কইরা দিছি। এখন তাগো গুননের টাইম নাই। নেতারাও নাকি মুখ বুইঝা এইসব মাইনা নেয়, ওসিমসিগো খুব স্যার স্যার করে। রমিজ ভাবে, তার অবস্থা হইছে এই নেতাগো মতো। কিছুই বলবার উপায় নাই।

হাজতে বইসা পুলিশ নিয়া এইসব ভাবতাছে রমিজ! নিজেই সতর্ক হয়। যদিও মনে মনে ভাবছে, তবু কিছুই কি বলা যায়? যদি টের পায়া মামুরা আবার ধইরা পিটনা লাগায়? ধুর, কি কুক্ষণেই যে সে ঘর থেইকা রাগারাগি কইরা বাইর হইছিলো। ভাবছিল, ঘরের মাগির চোপার দেমাগ আজকা ভাইঙ্গাই দিবে সে। সে নাকি কুনু কামাই রোজগার করতে পারে না? বইসা বইসা বউয়ের কামাই খায়? আজকা দরকার পরলে মসজিদ থেইকা জুতা চুরি করবে রমিজ। তবু এই মাগির চোপা ভাঙ্গতে হইবে। মাফ করনের মালিক আল্লা। নিজের একমাত্র মলিন পাঞ্জাবি আর ছিড়া টুপিটা মাথায় দিয়া এই পবিত্র জুম্মাবারে বায়তুল মোকাররমে গিয়া হাজির হইছিলো রমিজ। না হইলেও চাইরপাঁচ জোরা জুতা সরানির নিয়ত মনে।

পরিস্থিতিতে যে এমন গরম হইবো তা কি সে আগে জানতো? আজকে বলে আবার স্বাধীনতা দিবস! নিজের পেটরেই কুনু স্বাধীনতা দিতে পারলো না রমিজ, তাইলে আর কুন চ্যাটের স্বাধীনতা নিয়া ভাবে সে? এইদিকে বলে আবার ইন্ডেয়া থেইকা মুদী আসছে এই দেশের স্বাধীনতা করবার লাইগ্যা। হেফাজতের হুজুররা তাই বিরাট ক্ষ্যাপছে! ক্যান? সে নাকি ইন্ডেয়ায় মুসলমানগোর খুব রক্ত ঝরাইছে। হাজার হইলেও, রমিজও তো মুসলমান। অভাব-অনটনের ধান্দায় নামাজ-রুজাডা ঠিকমতো করতে পারে না। তাই বইলা ইমানের জোশ কি তারও কম আছে? তাই জুম্মাশেষে মুসুল্লিরা যখন নারায়ে তাকবীর বইলা বাইর হইলো, সেও জুতা চুরির কথা ভুইলা বেমালুম মিছিলে ঢুইকা গেছিলো। ভালই চলতেছিলো, এর মধ্যে শোরগোল শুরু হইয়া গেলো। রমিজ দেখলো, ঢালপাড় বস্তির কয়েকজন পিকেটার, যাগোরে সে চিনছিলো মেয়র ইলেকশনের মিছিলের সময়, হঠাৎ কইরা আওলাপাথারি ঢিল মারা শুরু করলো। কয়েকজন আবার পেপারকাগজে অগুন ধরায়া ধুমা বানাইলো। এরমধ্যেই পুলিশেরা সাইরেন বাজাইতে বাজাইতে বেদম মাইর শুরু করলো। টিয়ারগ্যাস আর রবার বুলেটও চললো। রমিজ দৌড়াইয়া পলাইতে যাইয়া দড়াম কইরা এক পুলিশের লগে ধাক্কা খাইয়া আল্লাগো বইলা বইসা পড়লো।

পুলিশও `খানকির পোলা` গাইল দিয়া তারে হেব্বি মাইর শুরু করলো। মারতে মারতে ভ্যানে তুললো।

`বাইঞ্চুদ মুদী`, মনে মনে গাইল দেয় রমিজ। হারামজাদাডা এইভদেশে না আইলে সে আরামসে দুই চাইরটা জুতা চুরি কইরা ঘরে গিয়া মাগিডার চোপা ভাঙ্গতে পারতো। তা আর হইলো কই। সবই রমিজের কপাল। রমিজ ভাবে, এহন কপাল কইরা তারে যদি হেফাজত কর্মী বইলা মামুরা চালান দেয়, তাও মন্দের ভালো। কয়দিন পরে ছাড়ান পাওয়া যাইবো নিশ্চয়। কয়দিন আগেই না হেফাজতেরা শোকরানা সভা করলো? তাগো প্রতি একটু হইলেও দরদ দেখাইবো মনে হয়। আর যদি বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী বইলা চালান দেয়, তাইলে তো রমিজ শ্যাষ! আল্লা, এইবারের মতো কপালডা একটু ভালা কইরা দেও গো। আর কুনু দিন মসজিদে জুতা চুরি করতে যামু না। আমার কুনু দোষ নাই, সব দোষ ঐ মাগির।

রমিজ বিড়বিড় করে তার কপালের জন্য প্রার্থনা করতে থাকে।