অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম
সাধারণের অসাধারণ নজরুল
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : আগস্ট ২৮, ২০১৮
যে দেশের বুকে পায় না চাষীরা পেটের ক্ষুধার অন্ন, পেটের ক্ষুধার অন্ন
সে দেশের প্রতি শস্য কণায় আগুন লাগিয়ে দাও, দাও দাও দাও...
আল্লামা ইকবালের লেখা এই গানটা ছোটবেলায় যতবার শুনেছি ততবার নজরুলের নাম মনে হয়েছে। ভাবতাম, নজরুলের লেখা গান। ধারণা ছিল, নজরুল ছাড়া এমন ভয়ংকর গান আর কেউ লিখতে পারে না। পরে অবশ্য জেনেছি, এটি নজরুলের লেখা না। কবি আল্লামা ইকবালের লেখা থেকে অনুদিত। কিন্তু নজরুল নিয়ে আমার সে চিন্তার পরিবর্তন হয়নি বিন্দুমাত্র।
তিনিই প্রথম মানুষ ছিলেন, যিনি প্রথম স্বাধীন ভারতের ডাক দেন। তার আগে অনেকেই নানাভাবে স্বাধীন ভারতের কথা বলেছেন, কিন্তু নজরুল ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহসের সাথে পত্রিকায় প্রকাশ্যে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। অন্যরা যেখানে আলোচনা বা অহিংস আন্দোলনের ডাকে ব্যস্ত, নজরুল তখন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিমদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ‘প্রধান দ্বন্দ্ব’ অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন। রাজনৈতিক কাজে ছুটেছেন ভারতবর্ষজুড়ে।
গতকাল ছিল ১২ ভাদ্র, ২৭ আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এদিনে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। যদিও এটা মৃত্যুবার্ষিকী না। বিদ্রোহীদের মৃত্যু হয় না।
বাংলা সাহিত্যে তার মতো আগ্রাসী ভাষার ব্যাবহার আর কেউ করতে পারেনি। শোষিত/শ্রমিকদের জন্য কথা বলে আর কেউ জেলে যায়নি। রবীন্দ্র সাহিত্য মানুষকে প্রশান্তি কিংবা চিন্তাশীল অথবা দর্শন দিয়েছে। কিন্তু নজরুলের মতো অন্য কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যে মানুষকে এত মাত্রায় প্রতিবাদী করে তোলার ক্ষমতা ছিল না। এত উন্মাদনা আর কোথায় আছে?
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।
আজও ‘বিদ্রোহী’ কিংবা ‘মানুষ’ কবিতা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস যোগায়। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট` বা `জাগো অনশন-বন্দি, ওঠো রে যত` এই গানগুলো আজও শোষিত মানুষদের নতুন করে সংগ্রাম করার ডাক দেয়। রোমান্টিকতাও ছিল অসামান্য। `দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো` এমন অসংখ্য সৃষ্টি আছে নজরুলের, যা পড়লে বোঝা মুশকিল ‘বিদ্রোহী’ কীভাবে এমন সৃষ্টি করতে পারে।
জীবনও ছিল অদ্ভুত রকমের বৈচিত্র্যে ভরা! আমার এক বন্ধুর ভাষ্যমতে, নজরুল পৃথিবীর সবচেয়ে ‘প্রিকুলিয়ার লোক’। সে বন্ধু বিশেষ কোনো গবেষক মানুষ না। কিন্তু তার কথার ঢের মূল্য আছে, কারণ সে সাধারণ মানুষ। যে সাধারণ মানুষের জন্যেই নজরুল সাহিত্য রচনা করতেন। নজরুল কোনো গবেষকের জন্য ‘কুলি-মজুর’ কবিতা রচনা করেননি। তাই আমরা যারা খুব সাধারণ তাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের মতো করে নজরুল সাহিত্য ব্যাখ্যা করার।
যেটুকু পড়ে জেনেছি, নজরুল অসাধারণ মেধাবী ছিলেন, একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি মহান সাহিত্য স্রষ্টা। কিন্তু কোনো পবিত্র দেবদূত না। তিনিও সাধারণ মানুষ। তাই বিয়ের অনেক আগেই প্রমীলা দেবী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন! এটা যেমন সত্য, একইভাবে এটাও সত্য যে, নজরুল অতি মাত্রায় খামখেয়ালি ছিলেন। যা ঐ সমাজে অসামাজিক ছিল বলে দাবি করে অনেক ইতিহাসবিদ, তাই তাকে নিয়ে সমালোচনা কম ছিল না।
নজরুল সমালোচনার অন্যতম লেখা কাজী আব্দুল ওদুদের ‘শাশ্বত বঙ্গ’র প্রবন্ধ ‘নজরুল ইসলাম’। পড়লে কিছুটা বুঝা যায়। আর নজরুলের লেখা ‘আমার কৈফিয়ত’-এ তো নজরুল নিজেই তুলে ধরেছেন নজরুলকে নিয়ে অন্যদের সমালোচনা। একই কবিতাই সে সমালোচনার কঠিন জবাবও দিয়েছেন তিনি।
জীবনের একসময় নজরুল কালি সাধনা করতেন। তিনি ‘শাক্তধর্ম’ পালন করতেন এটা সবারই হয়তো জানা আছে। (হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম শাক্তধর্ম। শাক্তধর্ম বলতে শক্তিবাদ বুঝানো হয়। হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায়। এই ধর্মে হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর)। কালির প্রতি ভক্তি থেকেই নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রচনা শুরু। বিংশ শতাব্দীর শ্যামাসঙ্গীতকে নিয়ে গিয়েছিলেন সর্বচ্চো স্তরে। নজরুলের লেখা হাজার হাজার শ্যামাসঙ্গীত, যার তুলনা বাংলা সাহিত্যে আর নেই।
আবার তিনি মহাদেব ‘শিব’-এর কত বড় ভক্ত, সেটা বুঝতে খুব গবেষণা করতে হবে না। নজরুলের প্রতিবাদী প্রায় কবিতা আর গানে ভগবান শিবের বর্ণনা পড়লেই সহজেই বোঝা যাবে। বর্তমান যুগের সুপার-হিরো চরিত্রের মতো, তার সাহিত্যে শিবকেও উপস্থাপন করা হয়েছিল নায়ক হিসাবে। অন্যদিকে তার মতো ইসলামি হামদ-নাত আর কে লিখেছে? সম্ভবত আর কেউ লিখতেও পারবে না কোনোদিন।
অথচ নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত শুনে অনেকে বলে, তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন। এটা কিছুটা সত্যি, কারণ শাক্তধর্ম তো হিন্দু ধর্মেরই একটা শাখা মাত্র। তাই বলে ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন না। সেটা বোঝা যায় তার ইসলামি সাহিত্যচর্চা দেখে। আল্লাহ ও মুহাম্মদের (স.) উদ্দেশে লেখা ভক্তিমূলক-আবেগী গানের ভাষা, অনেক বিখ্যাত মাওলানার ইসলাম ব্যাখ্যার চেয়েও বেশি মধুর। অতএব যারা নজরুলকে ইসলামি কবি বা হিন্দু কবি হিসাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে, তারা হয়তো নজরুলের অর্ধেক লিখা পড়েছে মাত্র। অর্ধেক নজরুলকে দেখেছে মাত্র।
নজরুল সাহিত্যের এই দুই মেরু দেখে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। শোষিত মানুষের জন্য সারাজীবন প্রতিবাদ করেছেন। মোল্লা-ঠাকুরদের ধর্ম বেঁছে খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। গোঁড়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে তার যেমন ঘৃণা ছিল, ঠিক সম পরিমাণ ঘৃণা ছিল মুসলিম ভণ্ড মোল্লাদের বিরুদ্ধে। যারা আজও ধর্মব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে!
সব মিলিয়ে নজরুল যেমন বিচিত্র তার সাহিত্যও তেমন বিচিত্র। বিচিত্র হলেও তিনি তার সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল মানুষদের একজন ছিলেন। সমাজের বর্তমান নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, শাসকদের লুটপাট, অতি সাম্প্রদায়িকতা এ সবের বিরুদ্ধে মানুষের বিশেষ করে তরুণদের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ আমাদের আদর্শ কিংবা আমাদের প্রতিবাদী করার মতো কোনো উপাদান নেই। নজরুলের সাহিত্য সেই উপাদান হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে নজরুলকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না। নজরুলের সাহিত্য যে পরিমাণ আধুনিক আর বিদ্রোহী ঘরনার সেটা কোনোভাবেই সামনে আসছে না।
কারণ বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্র সাহিত্যকে আদর্শ ধরে বসে আছেন। তারা হয়তো ভুলে গেছেন, সাহিত্যের কোনো আদর্শ থাকে না, আর সাহিত্য বুঝতে বা আলোচনা করতে গবেষক বা গ্রামার জানতে হয় না, শুধু একটা মন থাকলেই চলে। এক সময় ভাবতাম, আমাদের শাসকরা অনেক বোকা, এই কারণেই তারা নজরুলকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, আমাদের শাসকরা ভয়াবহ রকমের চতুর! কারণ তারা জানেন, নজরুলচর্চা হলে প্রতিটি মনের মধ্যে বিদ্রোহ তৈরি হবে। প্রতিবাদ হবে, সংগ্রাম হবে... বেঁচে যাবে সুন্দরবন, বন্ধ হবে তাদের স্বৈরাচারী শাসন।
লেখক: কবি, কলামিস্ট, কার্টুনিস্ট ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী