তারেক রহমান
সাদ রহমানের গদ্য ‘তারেক রহমান ঘোষিত ফ্যামিলি কার্ড’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
বিএনপির নেতা তারেক রহমান সাহেব পরশু `ফ্যামিলি কার্ড` বইলা একটা জিনিসের ঘোষণা দিছেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সারাদেশের সকল পরিবারকে এই কার্ড দেওয়া হবে। তিনি বলছেন, গ্রামের দিক থেকে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। পত্রিকাগুলা দেখলাম তারেক রহমানের এই ঘোষণারে খুব একটা পাত্তা দিলো না।
তারা পাত্তা দিলেও পারতো। তাতে বিএনপির লাভ হইতো। তারেক রহমান দেশে না আসা পর্যন্ত আমাদের গণমাধ্যমগুলা কি তারেককে গুরুত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিছে? হইতে পারে। এইটা তারেক রহমানের জন্য সুখবর নয়। সেক্ষেত্রে তাকে দেশে আসার প্রক্রিয়া আরও তরান্বিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপির সামনে এইমুহূর্তে দুইটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এক, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের জন্য কত সময় নেবে, এবং এই সময় নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে। দুই, সম্প্রতি যেই পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটতে যাইতেছে আমাদের দেশে, বিএনপি এইটারে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে।
তারেক রহমান সাহেবের `ফ্যামিলি কার্ড` ঘোষণার শক্তির জায়গাটা হইলো, এইটা বিএনপির সামনে থাকা এই দুইটা বড় চ্যালেঞ্জকেই স্পর্শ করতে পারতেছে। দেশের পরিবর্তিত বাস্তবতায় প্রথম কোনো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আসা এইটা প্রথম কোনো ওয়েলফেয়ার পলিসি বা কল্যাণমুখি নীতি।
এই ধরনের ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামের ঘোষণা মানুষের মধ্যে নির্বাচনী আকাঙ্ক্ষা তৈরি করবে। একইভাবে পপুলিস্ট রাজনীতির অসারতাগুলাও মানুষের সামনে পরিষ্কার করবে। মানুষ কি চায়, হুড়ুমতাল পাগলামি নাকি নীতিগত-পলিসিগত গণতন্ত্র— এইটা মানুষ ভাবতে আরম্ভ করবে। আমি তারেক রহমানকে তাই এই `ফ্যামিলি কার্ড` ঘোষণার জন্য সাধুবাদ জানাই।
আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির যেই আকাঙ্ক্ষা— যেকোন দেশে যেকোন সময়— এর মূলকথা হইলো এলিটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ। উচ্চবিত্ত এলিট, সাংস্কৃতিক এলিট, সিভিল সোসাইটি তথা রাষ্ট্রীয় এলিট, ইত্যাদি বর্গগুলার বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ-ঘোষণার নামই হইলো পপুলিজম বা পপুলিস্ট রাজনীতি।
পপুলিস্ট রাজনীতির ভিতরে আমরা যে ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী গোঁড়ামি দেখি, তা মূলত এই এলিটবিরোধী যুদ্ধের বাইপ্রোডাক্ট। ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদি মহড়ার নামে যা বাইর হইয়া আসে। ফলে পপুলিস্ট রাজনীতিকে নিছক ধর্মীয় উম্মাদনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা ভুল।
পপুলিস্ট রাজনীতি মানে নিছক জাতিবাদ নয়, নিছক ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, বরং এইটা রাষ্ট্রে ও রাষ্ট্রীয় অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণহীনতার প্রকাশ। এলিট-সিস্টেমের ফাপড়ে পইড়া মানুষ যেই অধিকারের গল্প কেবল শুনে, কিন্তু সেখানে স্থান পায় না, ফলে সে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
কথা হইলো, তাইলে এইসব ‘ফ্যামিলি কার্ড’ জাতীয় ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামও একইরকম এলিটীয় বুদ্ধি না? যা রাষ্ট্রের চিন্তাশীল এলিটদের মাথা থেকে বাইর হইতেছে! মানুষ কি এরেও অবিশ্বাস করবে না?
ঠিক কী অর্থে, তাইলে আমি বলতেছি, তারেক সাহেবের এইসব ওয়েলফেয়ার ঘোষণা পপুলিস্ট রাজনীতির অসারতাগুলো সামনে নিয়া আসবে?
পশ্চিমের দেশগুলাতে পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান হইছিল যখন সেইসব দেশের মানুষ দেখতে পাইলো, তাদের ওয়েলফেয়ার বা কল্যাণমুখী নীতি ইত্যাদি মানুষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছাইতেছে না। এলিটেরা রাষ্ট্রের মাথায় বইসা বইসা তাদের জন্য যেইসব ওয়েলফেয়ার বানাইতেছে, সেইগুলা অপূর্ণাঙ্গ। ফলে তখন তারা এই এলিট-সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আকার নিয়া দাঁড়াইলো। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, মুসোলিনি, ট্রাম্প ইত্যাদির ভিতর দিয়া তাদের প্রত্যাখ্যানের জায়গাটা তারা পরিষ্কার করতে শুরু করলো।
ইন্টারেস্টিংলি, বাংলাদেশে আমরা যেই পপুলিস্ট রাজনীতি ফেইস করতে যাচ্ছি, তার সঙ্গে এই পশ্চিমা পপুলিজমের একটা বড় তফাৎ আছে। সেটা হইলো, আমাদের এইখানে পপুলিস্ট রাজনীতি একই এলিট বনাম অধিকারহীনের লড়াই হইলেও, আমাদের যেই এলিট সেই এলিট কোনোদিনও ওয়েলফেয়ার পজিশন ছিল না। আমাদের এলিটরা কখনো ওয়েলফেয়ারিজম করে নাই। ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রাম বানাইয়া লিবারাল ভদ্র রাস্তায়, ভদ্র ক্যাপিটালিজমের ভিতর দিয়া তারা শাসন করতে চেষ্টা করে নাই।
গর্দভ পরিবারতন্ত্র, কিংবা স্টেট-অ্যাসেট কুক্ষিগত কইরা, অথবা ছায়ানটে শান্তিনিকতনের সংগীত গাইয়া, কিংবা নিছক ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাইখাই তারা এলিট হইয়া গেছে। ফলে আমাদের পপুলিস্ট রাজনীতি যেই এলিটকে টার্গেট কইরা আগাইতেছে, সেই এলিট আসলে ওয়েলফেয়ার ভদ্র ক্যাপিটালিুট সুশীলৈ এলিট না, গর্দভ এলিট। কাজেই আমার অনুমান হইলো, আমাদের রাষ্ট্র যদি আসলেও ওয়েলফেয়ারিজমের মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে, তাইলে মানুষ কিছু সময়ের জন্য চুপ থাকবে, এবং নিও বাংলাদেশি ওয়েলফেয়ার এলিটদেরকে তারা জায়গা দেবে।
পপুলিস্ট রাজনীতির দুয়ার তারা নিজেরাই কিছুদিনের বন্ধ কইরা রাখবে। আমি খুশি হইতেছি, বিএনপি বা তারেক রহমান এই জায়গাটা ধরতে পারতেছেন। আশা করি, আঠারো মাসের হিসাবটা মাথায় রাইখা তারা ওয়েলফেয়ার সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা আরো বাড়াইবেন, এবং তার ভিতর দিয়াই আমাদের পপুলিস্ট রাজনীতির মাজা একটু একটু কইরা ভাঙতে থাকবে।
বাংলাদেশসহ আমাদের এই পুরা সাউথ এশিয়ার জন্যই ওয়েলফেয়ার মডেল বাস্তবায়ন করার কিছু মেজর চ্যালেঞ্জ আছে। বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলারই এইসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যেমন আমাদের এইখানে সমাজের ভিতরে একটা স্ট্রাকচারাল ইনইকুয়ালিটি আছে। ফলে ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রাম চালাইলেই যে তার সুফল জায়গামতো পৌঁছাইতে থাকবে এমন না।
কোন ওয়েলফেয়ার শুরু করার আগে যদি এইটা নিশ্চিত হওয়া না যায়। যেমন এই ‘ফ্যামিলি কার্ড’ তা সঠিক লোকের কাছে পৌঁছাইতে পারতেছে কিনা, তাইলে এই ওয়েলফেয়ার উল্টা আরো ব্যাকফায়ার করবে। তখন মানুষ আরো বেশি পপুলস্ট হইয়া উঠবে। আমাদের দেশে ওয়েলফেয়ারের ধারণা চিরকাল পলিটিশিয়ানদের অনুগত ছিল। রেশনের চাল দেওয়ার জন্য বিগত রেজিম কীভাবে মানুষকে গাড়ির পেছনে দৌড় খাওয়াইতো, তা নিশ্চয়ই আমরা ভুইলা যাই নাই।
ফলে, একদিকে ওয়েলফেয়ারকে পলিটিশিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত রাইখা অন্যদিকে আবার ওয়েলফেয়ার দিয়া ভোট আদায়ের যে ক্রিটিকাল স্বাতন্ত্র্য দরকার, সেটা বিএনপি কতটা পারবে তাও দেখার বিষয় আছে। পলিটিশিয়ান-মুক্ত ওয়েলফেয়ার বানাইতে না পারলে মানুষ সেইটা বেশিদিন নেবে না। গুণী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ ধারণায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিছেন স্বাস্থ্য আর এডুকেশনকে। তার কারণ, রেশনের চাল আর ফ্যামিলি কার্ড দিয়া আপনি মানুষকে স্বাধীন ও ডিগনিটি সম্পন্ন মানুষে পরিণত করতে পারবেন না।
ওয়েলফেয়ারের নামে আমরা ফ্যামিলি কার্ড আর চাউলের গাড়ির পেছনে দৌড়নোর সংস্কৃতি চাই না। আমরা স্বাধীনতা চাই। তার ফলে কার্ড, তার ফলে চাউল। আশা করি তারেক রহমান সাহেব আমাদের মনের অবস্থা বুঝবেন।
লেখক: কবি