সাদ রহমান
সাদ রহমানের কলাম ‘বিএনপি ক্যানো রাজপথে নামে না’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২৩
সরকারি ও সরকারবিরোধী উভয়প্রকার বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে একযোগে বিএনপির বিষোদগার কইরা যাইতেছেন গণমাধ্যমগুলাতে, বিএনপি ক্যানো রাজপথে থাকতে পারলো না এই ‘দোষে’— তাতে বিএনপির অপরিসীম ক্ষতি হইতেছে বইলা আমি মনে করি। কার্যত দেশেরও।
এইসব আলোচনার ফলে দেশের মানুষ নিজের অজান্তে আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনকে একধরনের বিমূর্ত বৈধতা দিতে পারে। নির্বাচনকে সামনে রাইখা এই অবস্থায় এইধরনের হতাশা মানুষকে সহজে ডাইভার্ট কইরা দিবে। মানুষের মধ্যে একধরনের স্যাডিজম গ্রো করতেছে মনে হয়। বিএনপির কাছে তাদের আশা-প্রত্যাশাগুলা অভিমান ও রাগে বদল হইয়া তাদেরকে আওয়ামী লীগের কাছে ‘আরও মাইর খাই’ মূলক আত্মঘাতি সত্ত্বায় বদল করতেছে।
কথা হইলো, সরকারি বুদ্ধিজীবীদের না হয় এইটা লক্ষ্য ছিল, কিন্তু সরকারবিরোধীরাও যে একই লক্ষ্যে আগাইতেছেন সেইটা কি তারা বুইঝা-শুইনা আগাইতেছেন? নাকি না বুইঝাই ফাল পারতেছেন? বুইঝা আগাইলে ঠিক আছে। আমি মনে করি, ফ্যাসিবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের দার্শনিকভাবে আরও দূরদর্শী হওয়া উচিত।
বিএনপি যখন থেকে আমেরিকার সঙ্গে কাজ করতেছে, তখন থেকেই বিএনপি একধরনের ধোঁয়াশাপূর্ণ চেহারায় থাকতে বাধ্য আছে। মানে তারা কি রাজপথ, নাকি সংলাপ, নাকি নিতান্তই চুপ থাকা— এই ধরনের একটা আধাখেঁচড়া পোষাক তাদেরকে পইরা থাকতে হইতেছে। সমস্যার ব্যাপার হইলো, বিএনপির এই অপরিষ্কার চেহারা বা বাস্তবতারে আমাদের ফ্যাসিবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা কখনোই অনুবাদ করতে চায় নাই দেশের মানুষের কাছে। বা পারে নাই।
বিএনপি ধোঁয়াশার ভিতরে কী সত্য লুক্কায়িত আছে, সেই সত্য দেশের মানুষ চায় কি চায় না— এইসব প্রশ্ন তারা গণমাধ্যমে কখনো বলতে চেষ্টা করে নাই। ‘বিএনপি রাজপথ কাঁপাইতে পারলো না’ মূলক কিছু সরল দোষের ভিতরে তারা সব আলোচনা-সমালোচনা সমাপ্ত কইরা দিছে। ফলে মোদ্দা যেই প্রশ্ন, আমেরিকার সঙ্গে জোট করার বাস্তব অর্থ কী, এইটা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয় নাই, আর তা না হইলে মানুষের বোধগম্য হওয়ার কোন কারণই নাই যে বিএনপি ক্যানো এই আধাখেঁচড়া কর্মপন্থার ভিতর দিয়া যাইতেছে।
বিএনপি রাজপথে নাই কারণ বিএনপি এখন শুধুই বিএনপি না। একটা সরাসরি প্রো-আমেরিকান পার্টি, যে নিজের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটাইতেছে। এই দলের কাছে আগের আমলের `রাজপথ` চাইতে থাকা বোকামি।
বিএনপি আমেরিকার সঙ্গে কাজ করতে যাওয়ার একেবারে প্রথমেই এই বিষয়টা নির্ধারিত হইয়া গেছিলো। দলটা আর যাই হোক এখন থেকে স্ব-শাসিত দল হিসাবে ফাংশন করবে না। তাদের মূর্তি যতই স্বনির্ভর দেখাক, বাস্তবে তারা তা নয়। আমেরিকার সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে—কূটনীতির ভিত্তিতে নয়—এই দলের নেতারা কাজ করবে। এখন এই বিষয়টা বিএনপির জন্য `অনালাপযোগ্য` বিষয় কইরা রাখাটা ঠিক হইতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের কাছেও এইটা ‘অনালাপযোগ্য’ বিষয় থাকার দরুণ আমাদের বড় রাজনৈতিক ক্ষতি হইতেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ‘আমেরিকার পেটে গেলে যামু’ তবু ‘আওয়ামী লীগের পেট থেকে বাইর হই’ ধরনের কিছু চিন্তাভাবনা করলেও বিএনপিরে এখনো একটা সার্বভৌম দেশের স্বনির্ভর পার্টি হিসাবে কল্পনা করতেছে, এবং তাদের পুরোনো পরিচিত বাংলাদেশের রাজপথের কাণ্ডারি হিসাবে বিএনপিকে দেখতে চাইতেছে। তা দেখতে না পাইয়া মনে মনে আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের কাছে স্যাডিস্ট মনোভাব নিয়া ফিরার কথাও ভাবতেছে। মানে তাদের পুরা পরিশ্রমটাই হইতেছে অস্বচ্ছতার ভিতরে ও যন্ত্রণায়।
দ্বিতীয়ত, আসন্ন মার্কিন সেমি-ঔপনিবেশিকতায় বাংলাদেশের চেহারা ক্যামন হবে তার ব্যাপারে মানুষের স্পষ্ট কোন ধারণা তৈরি হইতেছে না। ফলে দেশের ভিতরে আদৌ তারা সেই আমেরিকান ঔপনিবেশিক বাস্তবতা চায় কিনা, নাকি এই ভারতরে মাইনা নিয়া—যেটারে ‘ঔপনিবেশিক’ বলা যায় না—ভারতের ছত্রছায়ায় দীর্ঘ আওয়ামী-ফ্যাসিবাদের আন্ডারেই থাকতে চায়, এর কোন গণতান্ত্রিক বিহিত হইতেছে না।
তৃতীয়ত, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, আমেরিকা যেহেতু শীঘ্রই এই দেশে নিশ্চিতভাবে হাজির-নাজির হবে, সেই ‘আমেরিকান বাংলাদেশ’কে মোকাবেলার জন্য এইখানকার মানুষের কোন অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না।
৪আমি ব্যক্তিগত মতামতের জায়গা থেকে ইতিমধ্যেই বলছি, আমাদের এবার সার্বভৌমত্বের ধারণার খর্ব নিজেদের ঘটাইতে হবে। ঘটাইয়া আমেরিকার সেমি-উপনিবেশ-রে বরণ করতে হবে এবং বাংলাদেশরে আধা-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ধইরা নিয়াই ভবিষ্যতের রাস্তা বাইর করতে হবে। এই দেশে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির আর কোনও রাস্তা নাই।
কিন্তু মরার সার্বভৌত্বের ‘বিকার’ এই দেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে ভিতর থেকে সর্বস্বান্ত কইরা দিছে। রাজনৈতিক ডায়লগগুলা তারা এর বাইরে ভাবতেই পারতেছে না। বিএনপিরে তারা যুগপৎভাবে রাজপথে না থাকার জন্য বিষোদগার করতেছে এই `বিকারে`র ফলেই। এখনো তাদের সার্বভৌম স্বপ্ন হইলো—বিএনপি রাজপথে নাইমা গিয়া গণবিপ্লব কইরা আওয়ামী লীগরে মসনদ ঘেকে টাইনা নামাইয়া নিয়া আসবে, আর তার জন্য খুশি হইয়া মহান আমেরিকা বিএনপিরে এই গণঅভ্যুত্থানের জন্য লাল গোলাপ উপহার দিয়া নিজ দেশে ফিরা যাবে। এতদিনে তারা আমেরিকারে এত `ভালো` চিনছে।
বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক যুগে প্রবেশ করছে। আরো আগেই এই প্রবেশ সম্পন্ন হইছে। আমাদের রাজনৈতিক আলাপ থেকে এইটারে লুকাইয়া রাখার আর সুযোগ নাই। বিএনপিরে মৌলিক পরিচয়ের জায়গা থেকেই একটা প্রো-আমেরিকান পার্টি হিসাবে দেখতে হবে। কার্যত আওয়ামী লীগও ক্ষমতা হারাইবার পরে তার ন্যারেটিভ হবে প্রো-সার্বভৌম জাতীয়তাবাদ এবং প্রো-ভারতীয়তা।
এই নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতারে চেতনার বিচারে থেকে ত্যাগ বা পরাজয় বললে বলা যাইতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং চিরফ্যাসিবাদী মনস্তত্ত্ব নিজেই এই নতুন রাজনীতিরে ক্রয় কইরা নিয়া আসছে।
বিএনপিরে অবশ্যই রাজপথে দেখা যাইতে পারে, বা বলা যায় যাবেই। ব্যাপারটা আমেরকা কীভাবে আগাবে তার উপর নির্ভর করে। আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোরে এখনো তার কব্জায় ধইরা রাখতে সক্ষম হইছে, ফলে এখন রাজপথে আন্দোলন কইরা বিশেষ কোন ফল উঠাইতে পারবে না বিএনপি ও আমেরকা।
ব্যাপারটারে বিএনপির তারেক রহমানের দেশে ফিরতে পারার বাস্তবতার সঙ্গে সমান্তরাল কইরা দেখা যায়। তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারলে তখন সম্ভবত আমেরিকা বিএনপিরে মাঠে নামতে বলবে। হাই বিএনপি সমর্থকস, আপনারা আসলেও আপনাদের নতুন বিএনপি এন্ড দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে পারতেছেন তো? আপনাদের প্রিয় বুদ্ধিজীবীরা আপনাদেরকে এইসব বলবে না।
লেখক: কবি