সাজেদা হোমায়রার ভ্রমণগদ্য ‘কাশ্মীরের গল্প’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২১
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীরকে দেখিয়ে বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে তা এখানেই আছে! এখানেই আছে! এখানেই আছে!
পৃথিবীর স্বর্গখ্যাত এই কাশ্মীর দেখার আকাঙ্ক্ষা আমার দীর্ঘদিনের। প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা! তিনি আমাকে তাঁর সৃষ্টি এ সৌন্দর্যপুরী দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। ভারতের সবচেয়ে উত্তরে চির বিতর্কিত জায়গা কাশ্মীর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফিট উপরে সবুজ উপত্যকা আর শান্ত হ্রদ ঘেরা এক অতুলনীয় সৌন্দর্যপুরী।
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর। শহরটি ঝিলাম নদীর তীরে কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থিত। শীতকালে শ্রীনগরে প্রবল শীতের কারণে কাশ্মীরের রাজধানী ছয় মাসের জন্য জম্মুতে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০১৯ সালের ১ জুন। আমার স্বপ্ন যাত্রা শুরু হলো! দিল্লী থেকে শ্রীনগর। আকাশ পথে শ্রীনগরকে এত সুন্দর লাগছিল!
শ্রীনগর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার ১০-১৫ মিনিট আগে প্লেনের সব জানালা ঢেকে দেয়া হয় নিরাপত্তার জন্য। শ্রীনগর এয়ারপোর্টটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর মালিকানাধীন। ২০০৫ সালে এটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট হিসেবে মনোনীত হলেও হজ্জ ফ্লাইটগুলো ছাড়া এখান থেকে কোনো ইন্টান্যাশনাল ফ্লাইট পরিচালিত হয় না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তপ্ত পরিস্থিতি হলেই এ এয়ারপোর্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম। মুগ্ধ চোখে কাশ্মীর দেখছিলাম। এই সেই কাশ্মীর! সেই স্বপ্ন রাজ্য! উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়, নীল আকাশে মাথা গুঁজে থাকা পর্বতজুড়ে মেঘেদের খেলা, দুরন্ত ঝর্ণার নাচ, ছুটে বেড়ানো ঘোড়ার দল, স্বচ্ছ পানির নদী, বনভূমি, নয়নাভিরাম ফুল আর ফলের বাগান... সবকিছুর এক অনন্য সংযোজন! যেন পৃথিবীর সব রূপ সৌন্দর্য ভিড় করেছে এখানে! সত্যিই এক স্বপ্নের ভূস্বর্গ!
কাশ্মীরের সৌন্দর্যের আধার ধরে রেখেছে যে জায়গাগুলো তাদের মধ্যে শ্রীনগর অন্যতম। ঝিলাম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দর এই শহরটির চারিদিক ঘিরে আছে বরফ মাখা বিশাল সব পাহাড়। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৫ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁর শ্রীনগর থাকাকালীন সময়ে ঝিলাম তীরে ছিলেন। তিনি তাঁর বলাকা কবিতায় ঝিলাম নদীর দুর্দম গতীময়তার কথা বলেছেন।
ঝিলাম পাঞ্জাবের পাঁচটি বড় নদীর একটি। এটি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর উৎপত্তি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে। শ্রীনগরের মূল আকর্ষণ `ডাল লেক`। পুরো ডাল লেকটাই যেন এক ভাসমান শহর। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়ের পাদদেশে ডাল লেকের অবস্থান। ৩ কি.মি. প্রস্থ ও ২২ কি.মি. দীর্ঘ এ লেকটি নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
এ লেকের পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। লেকের পাড়ে বিশাল আকৃতির চিনার ও পাইন গাছ লেকের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই লেকের উপর ভেসে আছে শত শত হাউজ বোট আর শিকারা নামক নৌকা। ভেসে আছে সবজি বাজার, চায়ের দোকান, মার্কেট, অপরূপ ফ্লোরা আর ফাউনার বাগান! লেকের মাঝে মাঝেই রয়েছে কৃত্রিম ফোয়ারা। লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানো পানকৌড়ি, সাদা বক ও মাছরাঙা লেকের অপরূপ সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে!
শিকারা নামক নৌকাগুলো দেখতে খুবই চমৎকার। যেন সাজানো বাসর ঘর! শিকারায় করে অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী এই ডাল লেক ঘুরে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম... কী মায়ায় আকাশ ছোঁয়া পাহাড়গুলো মেঘের সাথে মাখামাখি করে দাঁড়িয়ে আছে! কী অসাধারণ মুগ্ধতা! কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার টানে শত শত বছর ধরে মুঘল বাদশাহদের ছুটি কাটানোর প্রিয় জায়গা ছিলো এটি। শ্রীনগরে রয়েছে বেশ কিছু মুঘল বাগান।
মোঘল স্থাপত্যকীর্তিটির অপূর্ব নিদর্শন এ বাগানগুলো। চশমাশাহী, পরিমহল নিশাতবাগ ও শালিমার বাগান। বাগানগুলোতে এত রঙের ফুল! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মোঘল বাগানের স্থাপনাশৈলিতে ইরানীয় শৈল্পিক ছাপ সুস্পষ্ট। অপূর্ব স্থাপত্যকলা ও পুষ্পময় বাগানের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম প্রচণ্ড! শ্রীনগরে রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় টিউলিপ বাগান। এপ্রিলে যখন টিউলিপ ফুল ফোটে, সেসময় এ বাগান পর্যটকদের কাছে এক বড় আকর্ষণ।
পাহাড়ের ভিতর আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম গুলমার্গ ও সোনমার্গে। এ দুটো জায়গাই বরফের জন্য বিখ্যাত। চারিদিকে শুধু বরফের ছড়াছড়ি! বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়া, বরফগলা পাহাড়ি নদী, ঝর্ণা....কী অনিন্দ্য সুন্দর! সোনমার্গ যেতে পুরো পথেই সাথে ছিলো সিন্ধু নদের উচ্ছ্বসিত চিৎকার! গুলমার্গে বরফাচ্ছাদিত পর্বতে ক্যাবল কার থেকে দেখেছিলাম পাকিস্তানের `আজাদ কাশ্মীর সীমান্ত`। কাশ্মীরের আরেকটি অসম্ভব সুন্দর জায়গা `প্যাহেলগাম`। শ্রীনগর থেকে একশো কি.মি. দূরে নদী উপত্যকা শোভিত স্বর্গীয় একটি গ্রাম প্যাহেলগাম।
স্থানীয় ভাষায় প্যাহেলগাম শব্দের অর্থ `ভেড়াওয়ালাদের গ্রাম`। আমরা যে পাশমিনা শাল দেখি এগুলো এখানকার ভেড়ার পশম দিয়েই তৈরি। প্যাহেলগাম যেতে পথে পথে দেখেছি সারি সারি আপেল বাগান, পাইন গাছ, বরফে ঢাকা পাহাড় আর জাফরান ক্ষেত। প্যাহেলগামের কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলাম বিখ্যাত `লিডার নদী`। পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা এ নদীর সৌন্দর্য হৃদয়কাড়া! নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ প্যাহেলগামকে মনে হচ্ছিলো আসলেই কোনো এক স্বর্গ রাজ্য!
প্যাহেলগাম থেকে ৬ কি.মি. দূরে অসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা `বাইসারান`। দুর্গম উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিলাম বাইসারান। সারি সারি পাইন গাছের মাঝ দিয়ে পাথুরে রাস্তায় পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে ছুটে চলছিলো ঘোড়া। যতই উপরে উঠছি, ততই বাঁ দিকে নিচে চলা নদী আরো নিচে চলে যাচ্ছে! পথ এখানে প্রায় ৩০ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেল করে উঠে গেছে। প্রতি পদে পদে ছিলো বিপদ, ভয়। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মাটিতে পড়ে যাবো। এত শক্ত করে ঘোড়ার লাগাম ধরেছিলাম, তাও ধুকফুকানি বেড়েই চলছিল। পুরোই একটা অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ! এখন মনে হলে কেমন গা শিউরে উঠে!
বাইসারানে পৌঁছে যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, অবাক করা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছিলাম! দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের চূড়া আর চূড়া! তার সামনে কী অপরূপ পাইন গাছের সারি। এত সৌন্দর্যের মাঝেও কষ্ট লেগেছিল, দরিদ্র পেহেলগামবাসীদের দিকে তাকিয়ে। যেখানে আমাদের ঘোড়ার পিঠে চড়েও উপরের দিকে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল! সেখানে আমাদের ঘোড়ার সাথে থাকা ছেলেগুলো ঘোড়া সামলিয়ে, আমাদের দিকে খেয়াল রেখে হেঁটে হেঁটে এতো উঁচু পাহাড় বেয়ে উঠলো। খুব মায়া লাগছিলো। উপার্জনের জন্য তাদের কতো কষ্ট করতে হয়। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিছুক্ষণ পরপর বলছিলো, `আপ খুশ হো?`
৯৯% মুসলিমের দেশ কাশ্মীর। বাংলাদেশের মানুষকে তারা খুব পছন্দ করে...পছন্দ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে! কাশ্মীর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নয়, খাবারেও ভূবনখ্যাত। নানান রকম সুস্বাদু খাবারের সমাহার এখানে! কাশ্মীরের অন্যতম বড় রহস্যময়তা হচ্ছে এর আবহাওয়া। এই রোদ তো এই বৃষ্টি আবার কিছুক্ষণ পরই হয়তো তুষারপাত! কাশ্মীরের ঈদ দেখেছি। ঈদের আগের দিনগুলোতে পুরো কাশ্মীর জুড়েই ছিলো একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। মার্কেট, এটিএম বুথ, গোশতের দোকান, কনফেকশনারিতে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। দোকানে দোকানে ঈদ উপলক্ষে বানানো হচ্ছিল কাশ্মীরি বিস্কুট। ঈদের নামাজ পড়েছিলাম বিখ্যাত হযরত বাল মসজিদে।
সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত এখানেই হয়েছিল। ৫০ হাজারেরও বেশি মুসলিম এখানে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন। ঈদের দিন রাস্তার দু`পাশে বিভিন্ন কাশ্মীরি খাবারের পসরা বসেছিলো। ভালো লেগেছিলো খুব! ঋতুভেদে কাশ্মীর উপত্যকা সাজে ভিন্ন রূপে। প্রত্যেকটি রূপই অবর্ণনীয় সুন্দর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সাথে মানুষের তৈরি অসাধারণ স্থাপত্য শিল্প যোগ হয়ে এক অনন্য রূপ লাভ করেছে কাশ্মীর। অতুলনীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি কাশ্মীর আমার মন খারাপও করে দিয়েছিল! কাশ্মীরজুড়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশাল উপস্থিতি চোখে পড়েছিল। রাস্তায় তারা শক্তি নিয়ে টহল দিচ্ছে। পথে পথেই সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। তারা সতর্কতার সাথে অস্ত্র নিয়ে সজ্জিত। কাশ্মীরের রাস্তার দেয়ালজুড়ে লেখা We want Freedom!
বাড়িঘরের সামনে মেশিনগানধারী সৈন্য, সাজোয়া গাড়ি, ট্যাংক... এসব দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাশ্মীরের ছোট ছোট কিউট বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগছিল। কী আতঙ্কময় এক পরিবেশে বড় হচ্ছে তারা। কী ভয়াবহ অশান্ত এক পরিবেশ! কাশ্মীর আমাকে টানে বারবার। সেখানের নির্মল প্রকৃতির বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে খুব। কাশ্মীরের প্রকৃতির মতোই সুন্দর। সেখানের মানুষগুলোকে আবার কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কাশ্মীরের কথা মনে হলেই ভেসে উঠে মুগ্ধতা, ভেসে উঠে আতঙ্ক! প্রকৃতপক্ষে এ দুটি রূপই কাশ্মীরের বাস্তবতা। ভালো লাগা আর মন খারাপ জড়িয়ে থাকা এই কাশ্মীর ভ্রমণ আমাকে মায়ার জালে আটকে ফেলেছে! খুব মিস করি এ মায়াময় কাশ্মীরকে!