সাঈফ ইবনে রফিকের কবিতা ‘রবার্ট ফিস্ক’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৭, ২০২০
ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ১৯৪৬ সালের ১২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা বিশেষ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধাভিযানের সংবাদ সংগ্রহ এবং নিরপেক্ষতার সাথে তা পরিবেশনার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। রবার্ট ফিস্ক ডাবিলেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। ল্যাঙ্কাসটার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাংবাদিকতায় সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭১-৭৫ সময়ে তিনি লন্ডন টাইমস পত্রিকার আইরিশ প্রতিনিধি হিসেবে বেলফাস্ট থেকে রিপোর্ট করতেন।
১৯৭৬ সালে তিনি লেবানন যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য বৈরুত চলে যান। সে সময় থেকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয় নিয়ে সংবাদ সরবরাহ করেন। এর মধ্যে রয়েছে লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসন (১৯৭৮-৮২), ইরানের বিপ্লব (১৯৭৯), ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮), আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৮০), উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯১)। এছাড়া তিনি বসনিয়া যুদ্ধের ওপর রিপোর্ট করেন। ২০০৮ সাল অবধি তিনি ৩২ বছরে কমপক্ষে ১১ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেন।
১৯৭৬ সালে ২৯ বছর বয়সে বৈরুতে চলে যান ফিস্ক। তিনি গিয়েছিলেন তিন বছরের জন্য, কিন্তু সেখানেই তিনি কাটিয়ে দেন ২৫ বছর। বিয়েও করেন সেখানে। স্ত্রীর নাম লারা, তিনিও সাংবাদিক। লারা কাজ করতেন টাইম পত্রিকায়। লেবানন যুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৃষ্ঠিভঙ্গি অনুধাবনের গুরুত্ব অনুধাবন করেন।
একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তিনি সাংবাদিক নিরপেক্ষতার প্রতীকে পরিণত হন। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও সাহসিকতার জন্যই তিনি সমধিক খ্যাত। বলা হয়, তিনি শুধু সাংবাদিক নন, তিনি নির্যাতিত ও বিবেকবান মানুষের কণ্ঠস্বর। তার যেকোনো প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী সাগ্রহে পঠিত এবং আলোচিত হয়। ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর ফিস্ক ৭৪ বছর বয়সে সন্দেহজনক স্ট্রোকে ডাবলিনের সেন্ট ভিনসেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মারা যান। মহৎপ্রাণ এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে সাঈফ ইবনে রফিকের শোকগাথা—
ভালোবাসা নিও হে রবার্ট ফিস্ক,
জায়োনিজমের কালোযাদুতে
যখন আরবদের বর্বর ভাবছে ওয়েস্ট
এবং এর প্রোপাগান্ডায় বুঁদ পুরো পৃথিবী—
তখন ঘুরে দাঁড়ালো তোমার কলম।
ইরাক যুদ্ধে এমবেডেড সাংবাদিকতা নিয়ে
তামাশা তামাশা করে
বলে ফেললে— ওটাতো
`হোটেলরুম জার্নালিজম`!
আমি ভেবেছিলাম,
তুমিও সিআইএ`র কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।
আরবদের মাথা চিবিয়ে খেতে
ভুলভাল বকছো এভাবে। নতুবা তিন তিনবার
বিন লাদেনের ডেরায়
যাও, আবার আসো!
এটাও কি এমবেডেড?
ভুল ভাঙালেন
এডওয়ার্ড সাইদ। যখন দেখলাম,
মানবাধিকারের থিওরি ডিঙিয়ে
তুমি কথা বলছো দুর্বলের পক্ষে।
পশ্চিমমুখী আরব শাহির সমালোচনা
অথবা গল্পের ছলে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে
ভেড়ার বাচ্চা হারানো মায়ের সাক্ষাৎকার,
আলজেরিয়ার সাহারায় পথ হারানো
বিদ্রোহী বেদুইন, নীলনদের মাঝি বা
লোহিত সাগরে ফিলিস্তিনি ফিশিংবোটে
স্বপ্নের জালবোনা গাজার যুবকের মুখ
ইন্ডিপেনডেন্টের পৃষ্ঠায়।
সিনাই থেকে খান ইউনিসের
সিঁদকাটা চোরা টানেলে অথবা
লেবাননের অভিজাত কফিশপে
আরবি-ফরাসি-ইংরেজি মিলিয়ে তুমুল আড্ডায়
যে আরব আমাকে চেনালে তুমি—
মধ্যপ্রাচ্য আজও নিজেকে চেনেনি অতটা।
রবার্ট ফিস্ক নিজেই আজ ইতিহাস।
কোনো অনারব
এভাবে দেখেনি সাম্প্রতিক আরবকে।
কোনো অমুসলিম
এভাবে দেখেনি সাম্প্রতিক মুসলিম বিশ্বকে।
ইরানি বিপ্লব থেকে
বসনিয়ার গণধর্ষণ, কসোভো গ্রাস
আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন
অথবা নাবলুসের গলিমুখে
ইজরায়েলি সৈন্যের পাহারা—
কোথায় নেই তুমি?
যেখানেই নিপীড়ন,
সেখানেই তোমার জার্নালিজম।
সেতো থিওরি ছাড়িয়ে এক্টিভিজমে
আরও এক অনন্য উচ্চতায়।
সিরিয়ায় শিশু মুহাম্মদকে
নবি শনাক্তকারী গির্জার কসম,
শুধু আরব নয়,
শুধু মুসলিম নয়,
পশ্চিমা আগ্রাসনের শিকার
প্রতিটি জনগোষ্ঠী মনে রাখবে
ফিস্কের কলাম, তার ত্যাগ, অনুসন্ধান
আর মহতী জার্নালিজম।