সাইয়্যেদ কুতুবের চিন্তাধারায় ইসলাম, রাজনীতি ও পশ্চিমা মতবাদ

এম সাদ্দাম হোসাইন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২২

সাইয়্যেদ কুতুবের চিন্তাধারায় ইসলামের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক বিশ্লেষণের আগে তার সম্পর্কে কিছুটা বলে নিই। সাইয়্যেদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬) ছিলেন মিশরীয় চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত মৌলিক চিন্তাবিদ। গ্রামে তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।

স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯২০ সালে তিনি রাজধানী কায়রোতে চলে আসেন। ১৯৩৩ সালে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম থেকে ব্যাচেলর সম্পন্ন করে শিক্ষক হিসেবে সেখানেই কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিক্ষা পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে এলিট সেক্যুলার হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। লেখেন শতাধিক কবিতা, বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ ও বই।

১৯৪৮-১৯৫০ দু`বছরের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে পড়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। এসময় তিনি পশ্চিমা শিক্ষানীতির সারমর্ম অনুধাবন করেন, এবং তাদের সমাজের বর্ণবাদ ও অবাধ যৌনাচার দেখে বিস্মিত হন। সফর শেষে The America I Have Seen বইয়ে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার বেশ শক্তিশালী সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে পশ্চিমারা তাকে কট্টরপস্থি হিসেবে চিহ্নিত করে।

লেখালিখি ও সরকারের সমালোচনার কারণে তাকে কারাগারে যেতে হয়। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বই রচিত হয়েছে কারাগারে। সাইয়্যেদ কুতুবও কারাগারে বসেই তাফসির ফি জিলালিল কুরআন নামক কুরআনের তাফসির লেখেন। ১৯৬৫ সালে তিনি Ma`lim fil tariq নামক বইয়ের মাধ্যমে ইসলামিক বিপ্লবের ধারণা তুলে ধরে বিপ্লবের ডাক দেন। যা Milestones নামে ইংরেজিতে এবং `আগামী বিপ্লবের ঘোষণাপত্র` নামে বাংলায় অনুদিত হয়েছে। বইটি এযাবৎকালের মুসলিম পাঠকদের সর্বাধিক পঠিত বইয়ের একটি, এবং এ বই লেখার কারণেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

১৯৬৪ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফের সুপারিশে তাকে কারাগার মুক্তি দিলেও নিজ বাসভবনে পুলিশি প্রহরায় রাখা হয়। কিন্তু বছর না যেতেই Ma`lim fil tariq বইয়ের কারণে আবারো তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে সামরিক ট্রাইবুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে তার জীবনবৃত্তান্ত।

এবার তার চিন্তাধারাতে আসা যাক। সাইয়্যেদ কুতুব পাশ্চাত্যের উদ্ভাবিত রাজনীতি, অর্থনীতি এবং তাদের জীবন-বিধানকে সমালোচনা ও বাতিল ঘোষণা করে মানবজাতির সামনে কল্যাণময় জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন। একইসাথে ইউরোপীয়ানদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভাকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অনুধাবন করেন, পশ্চিমা খ্রিস্টবাদ ও ইসলাম এক নয়। সেখানে ধর্মের পরিধি ব্যক্তি ও চার্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাংস্কৃতি, কিংবা রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তারা তাদের এই সিস্টেম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে।

সাইয়্যেদ কুতুবের চিন্তার সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায়, পাশ্চাত্যের কাছে `খৃস্টবাদ` পাশ্চাত্যবাদের কাছে আশ্রিত ইশ্বরের কাছে প্রার্থনার একটি মাধ্যম মাত্র। তাদের উদ্ভাবিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ খেতে মিষ্টি লাগলেও, আল্টিমেটলি তা মানবসভ্যতাকে বিপদগ্রস্ত করছে।

গণতন্ত্রের কথাই ধরি, যা বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত রাজনৈতিক পদ্ধতি। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল `গণতন্ত্র` নামক এই পদ্ধতিকে সর্বোত্তম না বলে সবচেয়ে কম খারাপ শাসন পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চার্চিলের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মনুষ্য সৃষ্ট সকল তন্ত্রই খারাপ, এবং গণতন্ত্র সবচেয়ে কম খারাপ। গণতন্ত্র সম্পের্কে অনেক কথাই বলা যায়, সেসব বলে লেখার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করবো না, তবে দুটো কথা না বললেই নয়।

এক. গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছের প্রাধান্যতা দেয়ার যে কথাটি বলা হয়, তা আদৌ কতটা বাস্তবায়ন হয়? নির্বাচিত ব্যক্তিরা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করে, নাকি সংখ্যালঘু বিত্তবান এবং বিশেষ শ্রেণির মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করে? পাঠকের কাছেই সে প্রশ্ন রেখে গেলাম।

দুই. রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্য ও দক্ষ প্রতিনিধি বাছাই করার যোগ্যতা কি সকল নাগরিকের আছে? না, অধিকাংশ নাগরিকেরই সে জ্ঞান এবং যোগ্যতা নেই। অযোগ্য ব্যক্তি কখনোই যোগ্যকে বাছাই করতে পারে না। কিন্তু গণতন্ত্র অযোগ্য এবং অজ্ঞ নাগরিকদেরও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ দেয়। যাদের দ্বারা রাষ্ট্রের জন্য যোগ্য ও জ্ঞানী প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব নয়। সর্বজনীন অধিকার পেয়ে আত্মতৃপ্তির সঙ্গে পশ্চিমা তন্ত্র গ্রহণ করা হলেও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারায় পদে পদে মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

যদিও বাস্তবিক অর্থে বর্তমান বিশ্বে কাগজ-কলমের বাইরে সমাজতন্ত্রকে বিলুপ্তই বলা যায়। তবুও গণতন্ত্র নিয়ে বলার পর সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে একটু বলা দরকার। ইউরোপীয় সমাজের চার্চভিত্তিক মানব শোষণ বন্ধে ধর্মহীন, সাম্য ও শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতন্ত্র নামে যে রূপরেখা দাঁড় করানো হয়েছিল তা কি আসলেই মানুষের কল্যাণ করতে পেরেছে? যদি তাই হতো, তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে গেল? এ প্রশ্নের উত্তরে আলাদা একটা লেখা হতে পারে। আপাতত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের `ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ` বইটা পড়ার পরামর্শ দেই। যিনি কোনো প্রকার ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই তার এ বইতে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির এক হওয়ার মাধ্যমে পূর্ব জার্মানির সমাজতন্ত্রের পতন থেকে শুরু করে তৎকালীন ইউরোপে সমাজতান্ত্রের অধীনে আসা বিভিন্ন দেশ ঘুরে এবং সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলে সমাজতান্ত্রিক শাসনের ভয়াবহ রূপ তুলে ধরেছেন।

গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র যাই বলেন, বর্তমানে প্রতিটা রাষ্ট্রের আইনই মনুষ্য সৃষ্টি। যেখানে জাতীয়তাবাদের ঢেঁকুর তুলে প্রতিটা রাষ্ট্রই কেবল নিজের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। অন্যরা বাঁচুক-মরুক সেটা কারোই বিবেচ্য বিষয় নয়। যে সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে মিত্রতা রয়েছে তাও নিজ স্বার্থে, প্রকৃতপক্ষে প্রতিটা রাষ্ট্রই পরস্পরের শত্রু। এই শত্রুতা আল্টিমেটলি প্রাণ ও পরিবেশ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থাৎ মানুষ নিজের সৃ্ষ্টি আইন দ্বারা নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা থেকে পশ্চিমা তন্ত্র-মন্ত্রের ফাঁক-ফোকর কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। পাশ্চাত্যের কাছে ধর্ম রাষ্ট্রের সেই অংশ, যার পরিধি ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই ইসলামের একটি অংশ। রাষ্ট্র যখন ইসলামের অংশ তখন এর রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, সবই ইসলামের অর্থাৎ আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী চলবে। রোবট ততটুকুই পারে যতটুকু প্রোগ্রাম করে দেয়া হয়, এবং কিভাবে ব্যবহার করলে এটা ভালোভাবে কাজ করতে পারে তা ওই ব্যক্তিই বলতে পারবে যিনি রোবট বানিয়েছে। নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা রোবটের নেই। একইভাবে মানুষের জ্ঞানও ততটুকুই যতটুকু তার স্রষ্টা তাকে দিয়েছেন। নিজেকে পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পদ্ধতি বাছাইয়ে মানুষও অজ্ঞ ও দুর্বল। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে লোভ ও আত্মকেন্দ্রিকতা, সে নিজের এই প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারে না। এই লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকায় তার দ্বারা পৃথিবীর সামগ্রিক কল্যাণের চিন্তাও অসম্ভব, এরই মধ্যে মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র সেটাই নির্দেশ করে।

তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়কেই স্বীকার করতে হবে, আল্টিমেটলি কিসে নিজের কল্যাণ তা নির্ধারণের জ্ঞান ও যোগ্যতা কোনোটিই তাদের নেই। নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দাবি করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগে নিজের ইচ্ছেমতো চলতে গেলে নিজের দ্বারা নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কেবল তিনিই জানেন মানুষের জন্য কোনটা সর্বোত্তম এবং কিসে মানুষের কল্যাণ। তাই মানুষের সামগ্রিক কল্যানের জন্যই তিনি `লোভি ও আত্মকেন্দ্রিক` এই সৃষ্টির ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। পৃথিবীর সামগ্রিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর আরোপিত সেই বিধিবিধানই ইসলাম। নিজের কল্যাণের জন্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্র, উভয়কেই আল্লাহর এই বিধান অনুসরণ করতে হবে, নিজেকে স্বাধীন সার্বভৌম না বলে তাঁর আনুগত্য ও অধীনস্থতা মেনে নিতে হবে।

সাইয়্যেদ কুতুবের মতে, ইসলাম সকল দিক থেকেই মানুষের জন্য একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির নির্দেশনা প্রদান করে, যা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাওয়া যায় না। পশ্চিমা সভ্যতা থেকে ইসলামের শেখার কিছুই নেই। ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ মৌলিকভাবে আলাদা। ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্র চাইলেই কি সব করতে পারে, নিজের মতো করে চলতে পারে? না পারে না, অথচ তারা নিজেকে সার্বভৌম বলে দাবি করে। আসলে সার্বভৌমত্ব বিষয়টাই মানবজাতির জন্য নয়। পরম সার্বভৌমত্ব শুধুই এক আল্লাহর, যিনি তার ইচ্ছেমতো সবকিছুই করতে পারেন।

সাইয়্যেদ কুতুব আরো বলেন, সমসাময়িক বিশ্বের সকলেই, এমনকী মুসলিম দেশগুলোও নতুন ধারার জাহেলিয়াতে নিমগ্ন। বর্তমান জাহেলিয়াত ইসলামপূর্ব জাহেলিয়াতের প্রতিচ্ছবি বা তারচেয়ে আরও খারাপ অবস্থানে রয়েছে। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সবই জাহেলিয়াতে নিমগ্ন। যা আরববিশ্বেও জনপ্রিয় হয়েছে। মানুষের স্বাধীনতার কথা বললেও এগুলো এক মানুষের ওপর অপর মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও আনুগত্যের দাবি জানায়। অথচ মানুষের আনুগত্য থাকবে শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতিই।

যারা এ স্বীকৃতি না দিয়ে ইসলামের পরিধিকেও খৃস্টবাদের আদলে কেবলমাত্র ব্যক্তি জীবনে আবদ্ধ করার কথা বলে, পবিত্র কুরআনের ভাষায় তারা হচ্ছে সেই লোক যারা নিজেদের ঈমানদার দাবি করে, অথচ তারা মোটেই ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে। প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের সাথেই ধোঁকাবাজি করে, কিন্তু তারা তা অনুভব করতে পারে না।