সাইয়িদ আতিকুল্লাহর গল্প ‘বুধবার রাতে’
প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০১৮
রিকশার পেছন ধরে লোকটা যেভাবে টান দিয়েছিল তাতে ছিটকে পড়বার কথা। রিকশাওয়ালাও বেকুব আমিও বেকুব। তখন পর্যন্ত লোকটির চেহারা দেখিনি। ওই উঁচু আসনে বসে থাকলে ভালোভাবে দেখা হবে না। মনে এমনকি দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল। ভাবলাম নেমে দেখি ব্যাপার কি। রিকশাওয়ালাও বোধ হয় আমার মতো ভেবে থাকবে। আরোহী এবং চালক দু`জনে প্রায় এক সাথে নেমে পড়লাম। কারো মুখে কিন্তু কোনো কথা নেই।
রিকশাওয়ালা দেখতে এমনিতেই বিষণ্ন প্রকৃতির। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে প্রায় নিবে যাওয়ার উপক্রম করছে। অভাবিত অবস্থায় পড়ে আমরা দু`জন মনের দিক থেকে খুব কাছাকাছি হয়ে আছি। অন্তত কিছুক্ষণ ধরে তাই মনে হচ্ছিলো। রিকশাওয়ালার করুণ মুখ দেখে আমার মন খচখচ করছিল, ওকে একটু অভয় দেয়ার উদ্দেশ্যে বেশ দৃঢ়তার সাথে হাসলাম। শব্দ করে নয়, কেননা আমার ভেতরে উৎকণ্ঠা আছে।
নামবার সঙ্গে সঙ্গে যে লোকটি রিকশা টেনেছিল সে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাকে আগাগোড়া দেখলো বারবার। টান দেয়ার ধরন দেখে বুঝেছিলাম লোকটির স্বভাবে দৃঢ়তার ছেয়ে উগ্রতা বেশি।
চেহারা দেখে নিশ্চিন্ত হলাম, আমার অনুমান মিথ্যা নয়। লোকটি বিশেষভাবে কি চায় জানিনে, তবে এটুকু বুঝতে পারছি দাবি আদায় করার চেয়ে উল্টে পাল্টে দেখার দিকে লোকটির ঝোঁক প্রবল।
আর সে কি চেহারা। আমি অন্য চিন্তায় তন্ময় ছিলাম বলে ওকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠিনি। শরীরে মনে এত অবসাদগ্রস্ত ছিলাম যে শুরু থেকে অনেকটা সময় পর্যন্ত বিস্ময় ছাড়া অন্য কোনো ভাব মনে আসেনি। অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম,
: কি চাও।
লোকটি কোনো কথা বলছে না।
রাস্তাঘাটে এসব উন্মাদদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে প্রায়ই দেখি। দেখতে দেখতে উৎসাহ কমে গেছে। কোনো বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে যা হয়। তাছাড়া দেখেছি পাগলরা অনেকটা সুস্থদের মতো। পুনরুক্তিতে ভরা। সে কারণে আমার কৌতুহল নেই ওদের সম্পর্কে।
লোকটিকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
: কি চাও। বলো না! পয়সা?
লোকটি সজোরে আমার গালে এক চড় বসিয়ে দিল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললো,
: হ্যাঁ, পয়সা, পয়সা চিনেছিস খুব!
খেয়াল করিনি, আশপাশে দু`চারজন লোক এসে মজা দেখবার ফিকিরে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের নিশ্চিত ভাব দেখে বুঝলাম এই পাগলটিকে তারা ভালোভাবে চেনে -- হয়তো সারাক্ষণ তাদের ভেতরেই আছে। কাজেই গা-সহা। আমাকে চড় মারবার সাথে সাথে তারা সশব্দে হেসে ওঠে।
আমি কিছু বুঝতে পারছিনে বলেই তখন পর্যন্ত অপমানিত বোধ করিনি। স্বল্প সংখ্যক দর্শক। আমার চড় খাওয়াতে তাদের এত আনন্দিত হবার কি আছে ভেবে পাচ্ছিলাম না। অপ্রস্তুত লাগছিল। সে কারণে একটু রুষ্ট স্বরে লোকগুলোকে বললাম,
: হাসছো যে বড়ো?
এ কথা বলতে কোন লাভ হলো না। লোকগুলো আরো বেশি করে হাসতে থাকে। আশ্চর্য! সত্যি তারা আমার সাথে এই পাগলের ভয়ানক সম্পর্কটা উপভোগ করছে। গ্লানিবোধে মাথা হেঁট হয়ে আসে। লোকগুলোর দিকে আর তাকাতে সাহস হয় না।
রিকশাওয়ালা আবার আমার পড়শীও। এক পাড়াতে থাকি আমরা। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বেচারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আরো কত কি যে অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কা করছে। ওকে সাহস দেওয়া দরকার, না হলে এক্ষুণি হয়তো রিকশা এবং আমাকে ছেড়ে পালাবে। বললাম,
: ডরাসনে কালু।
কালু কিছু বললো না।
দর্শকদের ভেতর মধ্যবয়সী একজন লোক ফিক্ করে হেসে ফেললো আমার কথা শুনে। টিটকিরি দিয়ে খুব নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে পাশের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
: চাচা! আপন প্রাণ বাঁচা।
বুঝলাম যার হাতে পড়েছি সে উন্মাদ হলেও সহজ ব্যক্তি নয়। একটু একটু ভয় করছিল। বুকের ভেতর দুপদাপ হচ্ছে। বাইরে তখন পর্যন্ত ভেঙে পড়ার আগে নকলবীরদের মতো একটা তাচ্ছিল্য ভাব টিকিয়ে রাখা গেছে। তার জন্য চেষ্টা করতে হয়েছে বিস্তর।
যমের মতো দেখতে পাগলটা আমার চারদিকে অবিরাম পাক খাচ্ছে। অস্থিরতা ছড়াচ্ছে আর উচ্চস্বরে পাকিস্তানের প্রশংসা করছে। লোকগুলো একটু যেন ঝিমিয়ে পড়েছে, কিংবা যাকে বলা যায় হতাশ হয়ে পড়েছে। পাগলকে উস্কে দেয়ার জন্যে এক ছোকরা মতন লোক বলল,
: ভদ্রলোক মানুষ। ছেড়ে দাও দরবেশ বাবা।
যে ভঙ্গিতে কথাগুলো বলা হলো তাতে আমি একটু শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। বলার ধরন থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দরবেশ বাবার বিশেষ আক্রোশ আছে ভদ্রলোকদের ওপর -- আশ্চর্য, এদিক থেকে ইতর মেয়েদের সঙ্গে উন্মাদজনের খুব মিল আছে। দরবেশ বাবা নিজমূর্তি ধরলো, সে দাঁতে দাঁতে ঘষলো। হাসলো, বুক চাপড়ালো। শেষে বললো,
: শালা ফুরফুর করে হাওয়া খাও না?
আমি উত্তর খুঁজে পাইনি। হঠাৎ ওসব হাওয়া বিলাসীদের কথা কেন। হাঁ বললে বিপদ হতে পারে। না বললে নিরাপদ থাকবো কিনা কে জানে। অতএব মূক হয়ে রইলাম -- কথায় বলে বোবার শত্রু নেই। দেখা যাক।
দরবেশ বাবা শুরু করলো, তোর বাচ্চার চুলে আগুন। ধেই ধেই করে জ্বলছে। তুমি শালা হাওয়া খাও মাছের বাজারে।
হাওয়া খাওয়ার জন্যে মাছের বাজার কোনো সঠিক জায়গা নয়। কাজেই হাওয়া বিলাসী নয়, বলা হচ্ছে কোনো দুর্বিনীত ও দায়িত্ব জ্ঞানহীন লোকের কথা। লোকেরা হাততালি দিতে থাকে। আর সে কি পৈশাচিক হাসি। এতক্ষণে অবস্থা সম্পর্কে ধারণা হয়। মাঝে মাঝে এই উন্মাদ লোকটি অনেক রাতে ঘরমুখো একজনকে ধরে আসর জমায়। লোকেরা হাসে। হাততালি দেয়। ভদ্রলোক হলে উন্মাদের সুবিধে, তার চেলাদের জন্যও। তাদের প্রতিভা সহজে বিকশিত হয়। আমাকে নিয়ে দরবেশ বাবার এ খেলা কখন শেষ হবে কে জানে। অধৈর্য লাগছে। আবার এতো ক্লান্ত হয়ে আছি যে, এই খেলায় অংশ নেবার মতো উৎসাহ নেই, কৌতুহল যা ছিল তারও কোনো চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছিনে। বিশেষ করে চড় খাবার পর থেকে। রিকশাওয়ালা দেখলাম ভিড়ের ভেতর বেশ ঢুকে গিয়ে নিজেকে একেবারে অচেনা করে তুলেছে। বেশ বুদ্ধিমান লোক। হাওয়া বুঝতে পারে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত দেড়টা।
পাগল লোকটি আমার চারদিকে ঘুরছে তো ঘুরছেই। এতক্ষণ বোধ হয় ওর ভেতর নাচের আমেজ এসে গেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি তার চেহারা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। চোরের মতো লোকগুলোর মুখের দিকে তাকাতে দেখি তারা সবাই খুশি। যা চেয়েছিল তাই পাওয়া যাচ্ছে বিস্তর পরিমাণে। এর ভেতরে হঠাৎ নিজের দুই উরুতে জোর দুই চাপড় লাগিয়ে পাগলটি চিৎকার করে উঠলো,
: ইয়া আলি।
ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাকে কি বলবো ভেবে কুল-কিনারা করে উঠবার আগেই ভারী ওজনের আরেকটি চড় লাগলো আমার বাঁ কানের উপর। দু`হাত দূরে ছিটকে পড়লাম, শুনলাম, পাগল লোকটি বলছে,
: রাজার হুকুম।
বিনা অজুহাতে মার খাওয়ার কথা আগে জানতাম না। অবশ্য এতে মনে করবার কিছুই নেই। কেননা দর্শকরাও যেমন জানেন, আমিও জানি, লোকটি বদ্ধ উন্মাদ। তার মনের আনাচে-কানাচে কি সব ভাব নড়া-চড়া করে সে কথা আমাদের জানা নেই বলে ওর কথায় বা কাজের বিচার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে দর্শকের সাথে আমার একটা তফাৎ লক্ষ্য করছিলাম। যারা দেখছে,, আমার বিশ্বাস এমন ঘটনা ওরা প্রায়ই দেখে থাকে, তারা পাগলের প্রতিবেশী। সে কারণে আত্মীয়তা জন্মে গেছে ওর সাথে। ওরা জানে, অন্যরকম কিছু না ভাবা পর্যন্ত পাগল লোকটি তাদের সাথে থাকবে। কাজেই তারা তাকে মেনে নিয়েছে, ওর ভেতর থেকে কথা উপভোগ করার মতো দিকগুলো তারা বেছে নিয়েছে। আর আমার বেলা! আমি এদের সকলের অচেনা। সেই অর্থে বিদেশি। কাজের জন্যে এ বাজারের পথ দিয়ে যাই এবং এই গভীর রাতে পাগলের হাতে ক্রীড়ণক, একান্ত অসহায় লোক যে অত্যাচারিত হচ্ছে। এ পাগলের সাথে আর হয়তো কোনোদিন দেখাও হবে না।
গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে এসব কথা মনে হচ্ছিলো। কেন জানি না হয়তো নিজের অসহায়তার জন্যই মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও কোন জেদ নেই -- প্রতিবাদ নেই। ক্ষমা করা কি সহজ এখন। সত্যি কথা বলতে কি আমি পাগলকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত হয়ে গাত্রোত্থান করলাম।
এই নিষ্ঠুরতার পর লোকগুলো আরো ঘনীভূত হয়েছে, একে অন্যের আরো কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। হাসছে সবাই, তবে শব্দ করে নয় আর।
উন্মাদ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পড়ে গিয়েছিলাম, ঝটকা দিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম। ঠিক করলাম এবারে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো যদিও মারপিট করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে প্রয়োজন হলে করবো। সেই আমার কাল হলো। পাগলটি অবিরাম কিল চড় ঘুষি দিচ্ছে। আমি দুহাত দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।
লোকেরা আবার হাততালি দিচ্ছে। এই পর্যায়ে একটা জিনিস মনে আছে। পাগল লোকটি বারবার চেষ্টা করছিল আমাকে ঠেলেঠুলে দর্শকদের দলে ভিড়িয়ে দেবার জন্য। আমি বাধা দিলাম এবং যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকবার চেষ্টা করলাম। এজন্য যে পাগলামির দর্শক হতে আমি অনিচ্ছুক, ভাবতেও গা ঘিন ঘিন করে।
পাগলটা দাঁতে দাঁত ঘষছিলো, রাজার হুকুম।
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি, বললাম, কোন রাজা।
বল্লো, নতুন রাজা।
দর্শকদের ভেতর কখন দু`জন পুলিশ কনস্টেবল এসে জুটেছে। তারাও গা ঢাকা দিয়ে মজা দেখছিল। রাজার হুকুমের কথা শুনে পুলিশ কনস্টেবল দু`জন হেসে উঠলো। লোকেরা আবার হাততালি দিলো এলোমেলো। পাগলের মার থেমেছে। এখন তার গোঁ সে আমাকে লোকদের ভেতর ভিড়িয়ে দেবে। এ ইতরামির অর্থ আমি জানি। সে জন্য তাকে প্রাণপণে বাধা দিচ্ছি। পুলিশ দু`জন লাঠি হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো। পাগলের দিকে লাঠি উঠিয়ে বললো, বাবা দরবেশ। ভালোয় ভালোয় পথ দেখো।
পুলিশের উপদেশ কাজে লাগে। পাগল আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ দু`জন ভিড় ভেঙে দিলো। আমার রিকশাওয়ালা বিনীত ভঙ্গি করে এসে আমার সামনে দাঁড়াতে বললাম, চলো। পুলিশ দু`জন রিকশার মুখ ঘুরিয়ে পাশের গলি দেখিয়ে দিলো। বলল, এ পথ দিয়ে যাবেন না। ওই মোড়ে দেখলাম আরো দু`জন পাগল রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। এ খবর জানানোর জন্য কনস্টেবল দু`জনকে ধন্যবাদ জানালাম। বললাম, ভারী সময়মতো এসেছিলেন। না হলে কি যে হতো। একজন আমার কথা শুনে হেসে ফেললো, কি আর হতো। আরও মার খেতেন। তারপর ওই দলে ভিড়ে যেয়ে হাততালি দিতেন। কিন্তু যে গলি দিয়ে যাচ্ছেন। একটু সতর্ক থাকবেন। বললাম, কেন?
এ গলি দিয়ে গেলে একটু পরেই বেশ্যাপাড়া। বেশ্যাপাড়া ছাড়ালে কবরখানা।
আমার রিকশাওয়ালার আপত্তি নেই। সে ওই গলির পথ ধরলো।
ঘটনা দেড় বছর আগেকার এক বুধবারের রাতে। ডায়েরিতে তার উল্লেখ আছে, একটু বর্ণনাও লিখেছিলাম।