মারিয়া সালাম
সাংবাদিকতা করেই সাংবাদিকতা জানলাম না, বাপ্পারাজ কিভাবে জানবে?
প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২৩
সবাই দেখছি বাপ্পারাজকে ধুমিয়ে বকাবকি করছে। সাংবাদিকদের ওপরে করা তার মন্তব্য নিয়ে অনেকেরই আপত্তি। যে নিজেই সারা জীবন নেকুনেকু অভিনয় ছাড়া একটাও ভালো চরিত্রে অভিনয় করতে পারলো না, সে আবার সাংবাদিকতা নিয়ে মন্তব্য করে কোন সাহসে বা যোগ্যতায়? কথা ১০০% ঠিক আছে।
কিন্তু, বর্তমানে হাউজে হাউজে যে সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে, যে ধরনের সাংবাদিক তৈরি করা হচ্ছে, সে বিবেচনায় বাপ্পারাজ কি খুব বড় কোনো ভুল কিছু বলেছে?
গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে দেখেন। কম্পিউটার কম্পোজের বা ফটোস্ট্যাটের দোকানে বসেই একেকজন একেকটা অনলাইন খুলে বসেছে। সেগুলোর ইউটিউব আর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে যেসব ভিডিও কনটেন্ট প্রচার করা হয়, তাতে সাংবাদিকতার নৈতিকতা কতটা মেনে চলা হয়! সেসব তথাকথিত সাংবাদিক বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে মোবাইল নিয়ে শুরু করে ভিডিও। সেগুলোর মূল বিষয় কে কী খেল, কার রুমে কে আড্ডা দিল, কার ঘরে রাতের বেলায় কে যাচ্ছে...
সম্প্রতি নওগাঁতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারী সহকর্মীকে যৌন নির্যাতন করছেন। ওই নারী সহকর্মী এই নির্যাতনের বিষয়টা গোপন রেখেছিলেন, তিনি কাউকে অভিযোগও দেননি। সেটা কে বা কারা ভাইরাল করে দেয়। এতে তেমন দোষ দেখি না। কারণ হয়তো চাকরি বা মানসম্মান হারানোর ভয়ে ওই শিক্ষিকা ব্যাপারটা গোপন করছিলেন। কিন্তু, এরকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি বিধায় সেটা প্রকাশ করা যেতেই পারে। এ ধরনের ঘটনায় ভিক্টিমের চেহারা ব্লার করে সংবাদ প্রচার করা উচিত। কিন্তু, স্থানীয় প্রচারমাধ্যমগুলো এককাঠি সরেস। তারা সেই শিক্ষিকার ফেসবুক থেকে ছবি নামিয়ে ভিডিও কনটেন্টে তা জুড়ে দিয়েছে। এর নামই কি সাংবাদিকতা?
মফস্বলের কথা বাদই দিন। ঢাকাই সাংবাদিকতার অবস্থা কি একই রকম না? হাজারটা উদাহরণ আছে। ভিডিও কনটেন্ট ক্রিয়েটের নামে আর হিট কামানোর জন্য যেসব বানানো হচ্ছে, সেগুলোই আজকাল সাংবাদিকতা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে যারা সাংবাদিক নন বা সাংবাদিকতা বিষয়ে যাদের সামান্য ধারণা নাই, তারা কি বাপ্পারাজের মতো করেই আমাদের পেশা ও কর্মকাণ্ডকে দেখবেন কিনা, সে প্রশ্ন এখন নিজেদেরই নিজেদের করা উচিত।
সম্প্রতি নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটা মোটামুটি মানের ইংরেজি পত্রিকার চাকরিচ্যুত এক সাব-এডিটরকে দেওয়া হচ্ছে আরেকটা পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব। তাতে সমস্যা নাই, কেউ যে কম অভিজ্ঞতা বা কনিষ্ঠ পদমর্যাদার হলেই তার যোগ্যতা কম হবে বা যে বার্তা সম্পাদক হতে পারবে না, সেটা আমি মনে করি না। আমি নিজেও তুলনামূলক অল্পবয়সে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করে এসেছি।
সমস্যা হলো, সেই লোক যখন মুখ খুললেন। প্রথমেই সে বলে বসল, সব বড়বড় পত্রিকায় (প্রিন্ট) একমাত্র রিপোর্টাররা ছাড়া সবাই সকাল দশটার মধ্যে অফিসে ঢুকে যায়, রাত আটটায় পেজ ছেড়ে বের হয়। কথাটা আমাকেই খোঁচা দিয়ে বলল। কারণ আমি তিনটার আগে অফিসে যেতাম না। আর সে আমার জায়গায় যেকোন মূল্যে বসতে চায়, তাই মালিক যাতে খুশি হন।
আমি এতবছরের অভিজ্ঞতায় প্রিন্টে এরকম জীবনেও দেখিনি। সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক আর প্রধান প্রতিবেদকদের দেখেছি বেলা বারোটা বা একটার মধ্যে মিটিং করে সেদিনের সংবাদপ্রচার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। সেটা তবু বড় পত্রিকায়। কিন্তু ছোটখাট পত্রিকা যেগুলোতে এত লেয়ার নাই, একজন বার্তা সম্পাদক, একজন প্রতিবেদক আর একজন মেকআপম্যান, চার-পাঁচটা নিউজ ছাড়া বাকি সব আসে এজেন্সি থেকে, তারা কোন দুঃখে সকালে যেয়ে অফিসে বসে থাকবে? সেটা আমার মাথায় আসল না।
তো তার কথা শুনে ভিমড়ি খাওয়ার দশা। আমি বললাম, এত সকালে এসে কি কাজ করবেন?
সে বলে, নিউজ এডিট করব, পেজ মেকআপ করব।
এত সকালে নিউজ পাবেন কোথায় থেকে? বাসি নিউজ দিয়ে পেজ ভরবেন?
কেন? বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে ডেস্কে বসে বানাবো।
আচ্ছা, আট পেইজের একটা পত্রিকায় কয়টা কনটেন্ট যায়, বলেন তো?
তার উত্তর নাই। আমি বললাম, কম হলেও ডেইলি ৫০টা। মফস্বল, বিনোদন, খেলা, আন্তর্জাতিক, স্বাস্থ্য, জাতীয়— এসব একা বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে বানাবেন? ইভেন্টের নিউজ কি করবেন? এত সকালে ছবি পাবেন কোথায়? রাত আটটায় মেইল ধরালে, এরপরে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা কিভাবে দেবেন? তারপরে আপনি না হয় বানাতে বসলেন, মেকআপে যিনি থাকবেন, তার কাজ কি এত সকালে?
সে বলল, সে পেজ রেডি করতে থাকবে, নিউজ হবে আর বসাতে থাকবে।
এপর্যায়ে আমি ধমক খেয়ে চুপে গেলাম। কথাবার্তা আর বেশিদূর এগুলো না। আলাপ দীর্ঘ হলে, সাংবাদিকতা বিষয়ক আরো জ্ঞান অর্জন করতে পারতাম।
বের হয়ে আসছি, এমন সময় প্রতিবেদক সাহেব যিনি বিভিন্ন পত্রিকার বাংলা প্রতিবেদন গুগলে ফেলে ইংরেজি করে জমা দেন, তিনি বললেন, আর যাবার আগে ডেভেলপারকে বলে যাবেন এমন সিস্টেম করতে যেন ই-পেপার ঠিক রাত বারোটা একমিনিটে সাইটে উঠে যায়।
আমি বললাম, এটা আপনি ওয়েবসাইট যে দেখে তাকে বলুন, সে ফাইনাল মেকআপের কপি হাতে পেলে স্কেজুল করে রাখবে।
উত্তর আসল, এটা ডেভেলপারের কাজ, একটা সিস্টেম আছে, অটো বারোটা একমিনিটে ই-পেপার সাইটে উঠে যায়।
আমি বললাম, অটো হয় না রে ভাই, কাউকে না কাউকে আপলোড দিতে হয়, এটা অনলাইনে যিনি আছেন, উনি করবেন।
প্রতিবেদক মাথা ঝাকিয়ে বললেন, আপনি জানেন না আপা, অটো সিস্টেম আছে, জেনে নিয়েন। আমি আচ্ছা বলে হাঁটা ধরলাম। এতবছর সাংবাদিকতা করে আমিই সাংবাদিকতা জানলাম না, বাপ্পারাজ সেটা কিভাবে জানবে?
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী