ধ্রুব এষ

ধ্রুব এষ

সরোজিনী ড্রয়িং: এ নিউ হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান

রেজা ঘটক

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০

সরোজিনীর জীবনকে কতভাবে যে তুলে ধরা হয়েছে `সরোজিনীর ড্রয়িং` উপন্যাসে, তা না পড়লে কেউ জানতে পারবেন না। সহজ-সরল ছোট ছোট বাক্যে ধ্রুব এষ যেভাবে গল্প বলেন, সেই গল্পের ভেতরে একবার প্রবেশ করলেই যে কোনো পাঠকের ঘোর লাগবে। ঘোর লাগার প্রধান কারণ ফিকশন। ঘটনার পর ঘটনা। একটার চেয়ে আরেকটা আরো আকর্ষণীয়। এক ঘটনার রেশ না ফুরাতেই লেখক নিয়ে যান অন্য ঘটনায়।

পাঠককে আটকে রাখার যত ধরনের কৌশল রয়েছে, সবগুলো জোড়া দিয়ে ধ্রব এষ এই উপন্যাসে এমন একটি আলাদা ক্রাফট তৈরি করেন যে, একবার আপনি পড়া শুরু করলে, শেষ না করে উঠতে পারবেন না। সরোজিনী ব্রোকেন পরিবারে বড় হওয়া একটি মেয়ে। যে কিনা নিজের মাকে একদম সহ্য করতে পারে না। বাবাকে কিছুটা বিশ্বাস করে। যদিও বাবার জীবনটা আবার নতুন নতুন ফিকশনে ভরপুর।

কিন্তু বাবা-মা`র জীবনের বাইরে সরোজিনীর নিজের জীবনটায় কত যে বৈচিত্র্য, তা টের পাওয়া যায় গল্পের বাঁকে বাঁকে। ব্রোকেন পরিবারের একটি মেয়েকে জীবনে যে কত ঝড় ঝাপটা পাড়ি দিতে হয়, একটি ঝড় শেষ না হতেই আবার অন্য ঝড়ে আক্রান্ত হবার যে সম্ভাবনা, কিংবা একটি ঝড় থেকে নতুন আরেকটি ঝড়ের মধ্যে সরোজিনী নিজেই যেন অভ্যাসমত আটকে যায়।

সরোজিনী`র জীবনটাই যেন একটা মরু ঝড়। সেই ঝড়ে একে একে সরোজিনীর জীবনে আসে অনেক পুরুষ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে দুই দুইবার সংসার গড়েও সরোজিনী সুখী হতে পারে না। জীবনে তার ঝড়ই মুখ্য হয়ে থাকে।

সরোজিনী স্যাজিটেরিয়াস। যৌবনের শুরুতে হুরু আংকেলের কাছে মিরকেট হবার পর তার জীবনের যে বাঁকবদলের শুরু, সেই জীবনে একে একে আসে আনন্দ, কপিল, অধ্যাপক রিশাদ হাসান এবং সবশেষে নিখিলেশ। এরমধ্যে আনন্দকে হুট করে বিয়ে করার পর একটি ছেলের মা হয় সরোজিনী। ছেলের নাম সৌর। আবার নিখিলেশকে বিয়ে করার পর একবার মিসকারেজ হয়েছে।

আর্টিস্ট স্বামী আনন্দের বন্ধুদের মধ্যে কপিল, পান্থ, দারা, নাজমুল ভাই এবং সরোজিনী`র নিজের বন্ধুদের মধ্যে মনিকা, পৃথা, শাহরিন আর পরিবারের বাবা-মা, কাজের মানুষ ও অন্যদের সাথে সরোজিনীর জীবনে ঘটে যাওয়া নানান রসায়ণ এই উপন্যাসে যেভাবে উঠে এসেছে, তা এককথায় এক জটিল ফিকশন। কিন্তু এই জটিল ফিকশন ধ্রুব এষ এমন সহজভাবে বয়ান করেন যে, পাঠক বুদ হয়ে যেতে বাধ্য।

সরোজিনী নিজের বন্ধুদের সাথে যৌবনে আনড্রেস পার্টি করতো। আর আনন্দকে বিয়ে করার পর সরোজিনী`র জীবনে একে একে ঘটতে থাকে নানান ঘটনা পরম্পরা। অনেক ঘটনার পর স্বামী আর্টিস্ট আনন্দ সন্ধ্যা ছয়টায় তিতিরকে বিয়ে করেছে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বাসায় ফিরেছে এবং নির্বিকারভাবে শুয়েছে সরোজিনী`র সঙ্গে। সেই রাতেই সরোজিনী আনন্দের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা পেয়েছে।

অথচ সকালবেলায় সকল সম্পর্ক ব্রেকআপ করে তিতিরের সাথে আলাদা বাসা নিয়ে চলে যায় আনন্দ। পরবর্তীকালে আনন্দ আর তিতির কানাডা চলে গেলেও তাদের মধ্যে যদিও ব্রেকআপ হয়। কিন্তু একমাত্র ছেলের মা হিসেবে সরোজিনী`র সাথে একটা সম্পর্ক শেষপর্যন্ত থেকেই যায়!

লোডশেডিং আর ইলেকট্রিসিটি আসার মত সরোজিনী`র জীবনে বারবার পুরুষ এসেছে। কিন্তু সুখ আসেনি। সুখ এসে আবার সেখানে লোডশেডিং হয়ে গেছে। সরোজিনী`র জীবনের সেসব কাহিনীর যে ক্যানভাস ধ্রুব এষ এঁকেছেন, সেখানে দৈনন্দিন জীবনের কোলাহলের ভেতরে সরোজিনী`র সেক্সুয়াল ডিজায়ারের জন্য হাপিত্যেস, পুরুষসঙ্গীর জন্য আকুলতা, ব্রোকেন ফ্যামিলির দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার পাশাপাশি এক নাতিদীর্ঘ জীবনের খোলস উন্মুক্ত হয়।

শেষপর্যন্ত নিখিলেশের সাথে পালিয়ে সরোজিনী`র জীবনে স্থিতি আসার লক্ষণ স্পষ্ট হয়। কিন্তু পুরুষের চরিত্রের ভেতরে যে আদিম লালসা, সেই লালসা পরীক্ষা করতে বা দেখতে গিয়ে সরোজিনী নিজেই যেন বারবার ফাঁদে পা দেয়। কখনো নিজের ইচ্ছায় কখনো বা প্রয়োজনে।

মোদ্দাকথা, সরোজিনী যেন সমকালীন প্রগতিশীল মাইন্ডের এক ঝলক রোদ্দুর। যে নিজেই রোদ্দুর হতে গিয়ে বারবার জীবনকে নানাভাবে পুড়িয়ে নিজের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করে। খড় না হওয়া পর্যন্ত সরোজিনী`র সেই এক্সপারিমেন্ট যেন থামতেই চায় না। আলো, লোডশেডিং, সেক্স, সবমিলিয়ে সরোজিনী`র হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান, যেন সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় সরোজিনী এই সমাজের উঁচু ঘরের মেয়ে হয়েও সেক্সচুয়াল ফ্রাসট্রেশনে ভুগতে থাকা একটি চরিত্র। নিজের জীবনকে সে নানা কায়দায় এক্সপারিমেন্ট করে।

বাবা ও মায়ের চরিত্রে যে বাস্তবতা, সেই একই বাস্তবতায় সরোজিনী যেন নিজেই এক্সপারিমেন্ট করে জীবনকে। পুরুষের মন, পুরুষের সেক্সচুয়াল ক্ষমতা, সেক্সচুয়াল ডিজায়ার, ব্রেকআপ, মোর দ্যান ব্রেকআপ, আবার পুরুষকে নিয়ে খেলা, সবই সরোজিনী করে নিজের খেয়াল খুশি মত। যেন সরোজিনী নিজেই একটা নিউ হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান।

ব্রোকেন ফ্যামিলির বাবা ও মায়ের লম্পট চরিত্রের মত সরোজিনীও একসময় নিজেকে নিয়ে সেই চিরায়ত খেলায় মেতে ওঠে। জীবনের নন্দনতত্ত্বের খেলায় সরোজিনী হারতে চায় না। বারবার বিজয়ী হতে গিয়েই সরোজিনী যেন ফাঁদে পা দেয়। শেষপর্যন্ত সকল তামাশা শেষে কুম্ভকর্ণের মত এক ছাপোষা মৎস্য অফিসার নিখিলেশের সাথেই পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায় সরোজিনী।

সরোজিনীর ড্রয়িং উপন্যাসটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সব্যসাচী হাজরা। প্রকাশক করেছে বিদ্যাপ্রকাশ।। দাম একশো পঞ্চাশ টাকা।

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

একুশে বইমেলা ২০১৮