সরকার আবদুল মান্নানের স্মৃতিগদ্য ‘একজন মোজাম্মেল চাচা’
প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০২৩
আশির দশকে যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন তারা জানেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কী অসাধারণ ছিল! প্রচুর গাছগাছালি সর্বত্র। তখন আকাশ দেখতে হতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রাস্তা থেকে একটু সরে গেলে বিপুল বৃক্ষরাজির ফাঁকফোর গলিয়ে দেখা যেত নীল আকাশ। আর ছিল বিশাল বিশাল জলাশয়। জলাশয়গুলো তখন জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ছিল। রাতের তারার মতো তখন শাপলা আর পদ্ম ফুটে থাকত জলাশয় জুড়ে। পাখপাখালিও ছিল প্রচুর। প্রজাপতির আনাগোনা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র। বিশেষ করে শীতের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহু গুণে বেড়ে যেত। তারুণ্যের সেই দিনগুলোতেও পর্যাপ্ত শীতের কাপড়া ছাড়া আমরা রুম থেকে বের হতে পারতাম না। কিন্তু যখনই ঢাকায় পৌঁছতাম, তখন আর সেই শীত অনুভূত হতো না। পর্যাপ্ত কাপড় তখন বোঝা হয়ে যেত।
এমনই এক শীতের বিকেলে আমি গায়ের জাম্পার খুলে হাতে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি থেকে ফার্মগেটে নামি। ঢাকার প্রাচীনতম ফুটবার ব্রিজটি তখন ফার্মগেটে। প্রশস্ত এই ব্রিজ দিয়ে শতসহস্র মানুষ রাস্তা পারাপার হতো। বিকেলে ব্রিজে তিলধারণের ঠাঁই থাকত না। আর এর মধ্যেই নানা কিসিমের ভিক্ষুক সুবিধামতো ব্রিজের সিঁড়ি দখল করে ভিক্ষা মাগত।
প্রশস্ত ওই ব্রিজের সিঁডিগুলো পার হয়ে উপরে সমতল জায়গায় যখন পৌঁছলাম তখন পেছন থেকে কে একজন আমার বাবার নাম করে আমাকে ডাকছিলেন। “এই হাকিমের পুতে না?” আমার বাবার নাম আবদুল হাকিম সরকার। ‘হাকিম’ কথাটা কানে যেতেই আমি পিছন ফিরে তাকাই, দেখি বেশ স্বাস্থ্যবান শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল একজন অর্ধবয়স্ক ভিক্ষুক আমাকেই ডাকছেন।
আমি বললাম, আমাকে ডাকছেন?
লোকটি বললেন, তুই হাইক্কাইজুর (হাকিম ভাইজু) পুত না?
আমি বললাম, আমার বাবার নাম আদুল হাকিম সরকার। ভিক্ষুকটি যাতে আমার পুরো পরিচয় জানতে পারেন তার জন্য পরিষ্কার করে বললাম, আমাদের বাড়ি মতলব, গ্রাম জহিরাবাদ।
তিনি বললেন, হ, তোর বড় ভাইয়ের নাম রুলামিন (রুহুল আমিন)।
এখন আমার আর কোনো দ্বিধা থাকল না। তিনি আমাকে ঠিকই চিনেছেন। কিন্তু আমার বাবাকে চিনতে পারা অস্বাভাবিক নয়। বড় বাইকেও চিনতে পারা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সঙ্গে কখনো এই ব্যাক্তির দেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলাম না যে, তাকে আমি কখনো দেখেছি কিনা।
তিনি বললেন, আমার নাম মোজা। আমাগো বাড়ি একলাশপুর। তোর বাহে আমার দোস্ত ছিল। বয়সে আমার বড়। কিন্তু আমরা একলগেই থাকতাম, খেলতাম। তিন-চার বছর আগেও একবার দেহা হইছিল। আছে না ভালা তোর বাহে?
আমি বললাম, জি চাচা, বাবা ভালো আছেন।
রাস্তার একজন ভিক্ষুকের সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এই দৃশ্যটি অনেকেই বেশ কৌতুকের সঙ্গে এবং কৌতূহলের সঙ্গে দেখে দেখে আমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমিও বিষয়টি বেশ উপভোগ করছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যৌবনের সেই দিনগুলোতে যখন মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছি, তখন এই ধরনের একজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলাটাকে গৌরবেরই মনে হতো। মনে হতো, অতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে, নিরন্ন ও অসহায় মানুষের সঙ্গে, সর্বস্বান্ত মানুষের সঙ্গে এই যে মিশতে পারছি, এর নিশ্চয়ই মাহাত্ম্য আছে। সুতরাং পথিকরা যাই মনে করুক না কেন, ওই ভিক্ষুকের সঙ্গে আমি রীতিমতো আড্ডা বসিয়ে দিলাম।
কিন্তু পরের ঘটনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি যখন “চাচা ভালো থাকবেন” বলে বিদায় নিয়ে হাঁটা নিচ্ছিলাম, তখন তিনি
আবার আমাকে ডাকলেন। বললেন, এই মন্নান, আয় এদিকে আয়।
আমি আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, তার ভিক্ষার পাত্রটি থেকে মুঠ ভরে টাকা নিয়ে তিনি হাত উঁচিয়ে রেখেছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, নে,ধর।
আমি বললাম, চাচা, কী করেন আপনি? আপনাকে আমার টাকা দেওয়া দরকার, আর আপনি দিচ্ছেন আমাকে।
তিনি কিছুতেই মানছিলেন না। বললেন, যখন চাকরি-বাকরি করবি, কাম-কাইজ করবি, তখন দিস।
আমি তখন চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। সেই মুহূর্তে বুঝতেও পারছি না, আমার কী করা দরকার। আমি তাকে আবারো বললাম, চাচা, আমার জন্য দোয়া কইরেন, টেহা দিতে অইব না। বলে আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। খুব মন খারাপ হলো। মানুষের ভালোবাসা ও মমত্ববোধকে আমি চিরকালই যথেষ্ট সম্মান করি। কিন্তু আজ তার ব্যত্যয় ঘটল। আমার উচিত ছিল, ওই ভিক্ষুকের ভিক্ষাপাত্র থেকে দেওয়া সামান্য কিছু টাকা গ্রহণ করা। তাহলে তিনি খুশি হতেন। তার ভিক্ষুকজীবন সান্ত্বনা পেত এই ভেবে যে, ভিক্ষুক হয়েও তিনি একজন ছাত্রকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে পেরেছে। আমি তার এই আবেগের জায়গাটাকে একেবারেই গুরুত্ব দিলাম না। আমি রীতিমতো তাকে অপমান করলাম।
অনেকদিন পর বাবাকে এই ঘটনা বলেছিলাম। বাবা বললেন, ওহ্, মোজাম্মেল ! আমার দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই। অনেক আগেই বাাড়িঘর, জায়গা-জমি গেছে নদীতে। তারপর কি একটা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যায়। ঢাকা গেলে দেখি ওর সঙ্গে দেখা হয় কিনা।
বাবার সঙ্গে মোজাম্মেল চাচার আর কোনোদিন দেখা হয়েছে কিনা, জানি না। বাবা পরলোকগত হয়েছেন প্রায় একযুগ। আমার সঙ্গেও আর দেখা হয়নি মোজাম্মেল চাচার। যখনই ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করেছি তখনই চাচাকে মনে মনে খুঁজেছি। অন্যত্রও খুঁজেছি। দেখা হয়নি। তারপর কতটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। চাকরি-বাকরিও শেষের দিকে। কিন্তু মোজাম্মেল চাচার সঙ্গে আর দেখা হলো না। জানি না তিনি এখনো বেঁচে আছেন কিনা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক