সরকার আবদুল মান্নানের প্রবন্ধ ‘শিক্ষা সংস্কৃতি স্বপ্ন’

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৭, ২০২২

সত্তরের দশকের কথা, তখন আমাদের বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু সেই সময়ের যে স্মৃতি আমাদের মনে এখনো জাগরুক আছে সেই স্মৃতি কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। তখন আমরা দেখেছি পাশাপাশি বসবাস করতেন মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। কোথাও কোথাও বৌদ্ধ ধর্মেরও কিছু লোক বসবাস করতেন। আমাদের গ্রামের নাম জহিরাবাদ এবং অমাদের পাশের গ্রামের নাম সানকিভাঙ্গা। আমাদের গ্রামে কয়েকটি হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিল। কিন্তু ফসলের মাঠ পেরিয়ে পূর্ব দিকে যে গ্রাম উত্তরে-দক্ষিণে প্রসারিত, সেই গ্রামের নাম ছিল নমজহিরাবাদ এবং নমসানকিভাঙ্গা। ওই গ্রাম দুটিতে মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করতেন। তবে দু-একটি মুলিম পরিবারও ছিল। আমরা শৈশবে, কৈশোরে বা যৌবনে কখনো তাদের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি, বিদ্বেষ-বিসংবাদ বা পারস্পরিক প্রতিহিংসা লক্ষ করিনি। তখন আমরা দেখেছি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে মানবীয় গুণাগুণগুলি মুখ্য ছিল। সেই সম্পর্কের মধ্যে আত্মীয়তা ছিল, সেই সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগাভগি করার সংস্কৃতি ছিল। এবং আমরা এও দেখেছি যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যেসব অনুষ্ঠান হতো- সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নানা রকম পূজা-পার্বণ এবং মুসলমানদের ঈদ ও অন্যান্য উৎসবে সব ধর্মের লোকেরাই আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করত।

কখনো কখনো আমরা এরকমটাও দেখেছি, সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা, বিশেষ করে মহিলারা বেশ ছুতমার্গী ছিলেন। তারা সাধারণত মুসলমানদের স্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। তারা হয়ত পুকুর বা খাল থেকে কলসিতে করে জল নিয়ে ফিরছেন। এ সময় কোনো দুষ্ট মুসলমান ছেলে কলসি ছুঁয়ে দিচ্ছে। তখন তারা রাগ করে কলসি উপুর করে জল ফেলে দিতেন। মুসলমানরা তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকুক সেটা তারা চাইতেন না। তবে ঘরের বাইরে ভিটিতে বসে চলত নাস্তাপানি খাওয়া, পান খাওয়া এবং হুকা টানা। কিন্তু ছোঁয়াছুঁইর বিষয়টি তারা পছন্দ করতেন না। এইসব নিয়ে তারা যে খুব একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতেন, তা কিন্তু নয়। কেননা এই ধরনের দুষ্টুমিগুলো সাধারণত করত দেবরগোছের বা ঠাট্টার আত্মীয়রা। কখনো কখনো এসবের ভেতর দিয়ে একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি হতো। আবার বিরক্ত হলেও খুব সরাসরিভাবে প্রতিবাদ করতেন না। বিবেচনায় রাখতেন, মুসলমানরা যাতে করে কষ্ট না পায়, যাতে করে বিষয়টি নিয়ে কোনো সামাজিক সংঘাত তৈরি না হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ছোট-খাটো এইসব বিষয় নিয়ে কখনোই সামাজিক সংঘাতের বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখিনি কখনোই।

সে সময় সমাজে এক ধরনের পারস্পরিক সহনশীলতা, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং মমত্বের বিষয় সর্বদাই বিরাজমান ছিল। পোশাক-পরিচ্ছদে, খাদ্যাভাসে, জীবনযাপনে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব বড় ধরনের পার্থক্য কখনোই দেখা যায়নি। বলা যায় মুসলিম নারীগণ যে ধরনের পোশাক পরতেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী মহিলারাও একই ধরনের পোশাক পরতেন। তবে হিন্দু বিধাব মহিলারা সাদা সাড়ি পরতেন। কিন্তু মুসলমান বিধাব মহিলারা সচরাচর তা করতেন না। তারা সব রঙের সাড়িই পরতেন। হতদরিদ্র ওই গ্রামীণ জীবনে সাড়ির নিচে ব্লাউজ ও পেটিকোট পরার তেমন কোনো সামর্থ্য বা প্রথা ছিলনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো কোনো বয়স্ক পুরুষদের ধুতি পরতে দেখেছি, এখনো এই ধুতি পরার প্রচলন আছে। কিন্তু কম বয়সের কাউকে ধুতি পরতে দেখিনি। তারা লুঙ্গিই পরত। পাকিস্তান শাশিত সেই গ্রামীণ জীবনে কারো পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে বিতর্ক ও অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হতে দেখিনি। কটূক্তি করা বা হেনস্তা করার প্রশ্নই ওঠে না। এই ধরনের ঘটনা আমরা আমাদের শৈশবে এবং যৌবনে কখনোই দেখিনি।

আরেকটি বিষয় আমার স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে যাবে না। বাড়িতে নতুন ভাবি এসেছেন, পালকিতে চড়ে। লম্বা ঘুমটা টানা। মুখ দেখা যায় না। শাড়ির ভেতর থেকে কী করে সে দেখছে সে এক চিন্তার ব্যপার ছিল আমাদের, শিশু-কিশোরদের। তাকে দাঁড় করানো হলো একটি পিড়ির উপর। তার মাথায় ধান-দুর্বা দেওয়া হলো। আর পিঁড়িব সামনে একটি পত্রে পানি রাখা হয়েছিল। আর সেই পানিতে ফুলের পাঁপড়ি এবং আর কী কী ছিল যেন। সেই পানিতে ভাবি তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলঠি ছোঁয়লেন। কোথাও থেকে গরু কিনে নিয়ে আসার পরেও এই ধরনের উৎসব করার রেওয়াজ ছিল। গুরুর মাথায় ধান-দুর্বা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার প্রথা তখন ছিল। নববধূ ও গরু নিশ্চয়ই একই তাৎপর্যের বিষয় ছিল না। তবে কৃষিপ্রধান সমাজব্যবস্থায় গবাধি পশু, বিশেষ করে গরু ছিল প্রধান বাহন। আর গৃহবধূরা ছিল গৃহলক্ষ্মী। সংসারকে কেন্দ্র করে যে বিপুল কর্মজগৎ নিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত হতো, তার সঙ্গে গৃহপালিত পশুদের ছিল মমত্বের বন্ধন। দুয়েরই গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আর এই সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরোনো।
গত শতকের আশির দশকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমি ছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন আমাদের সহপাঠী মেয়েরা শাড়ি পরত বা ছালোয়ার-কামিজ পরত। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওগ্রাফি বিভাগের একজন সহপাঠী বোরকা পরত। ওই একজনই। কিন্তু তার বোরকা পরা নিয়ে কেউ কখনো বিন্দুমাত্র কটূক্তি করেছে এমন কোনো নজির নেই। অধিকন্তু আর দশজনের মতো সেও একইভাবে সবার সঙ্গে মিশেছে, সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। তবে বোরকা পরার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তাকে চিনত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পোশাক পরার বিষয়টি তখনো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সেটা কোনে ধর্মেই ছিল না।

আজকে যেমন আমরা দেখি ভারতে মুসলমান মেয়েদের বোরকা পরা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েরা কী ধরনের পোশাক পরবে সেটা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা পাকিস্তানিদের শাসনামলে কিংবা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কখনোই লক্ষ্য করা যায়নি।  ষাটের দশকে কিংবা সত্তরের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছবি এখনো বিরল নয়। বিশেষ করে আর একটু পিছিয়ে গিয়ে ৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে মিছিল-মিটিংয়ে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মেয়েদের প্রচুর ছবি এখনো দেখতে পাওয়া যায়। মূলত শাড়িই ছিল তখন মেয়েদের পোশাক। এবং শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ- ফুল হাতা, সর্ট হাতা এবং স্লিপলেস। সেইসব পোশাকে তাদের বেশ স্মার্ট, মার্জিত ও শোভন-সুন্দর দেখাতো। ধর্মভিত্তিক পোশাকের প্রচলন তখনো হয়নি। রাস্তায়, পথে-ঘাটে বোরকা পরা বয়স্ক মহিলাদের কখনো কখনো দেখা যেত। কিন্তু এই নিয়ে কারো মধ্যে কোনো অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করিনি। সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা কতটা পরিচ্ছন্ন ছিলো, কতটা আমাদের জাতিগত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সেই পরিচয় তাদের পোশাকে-আসাকে ও জীবনাচরণে বেশ পরিলক্ষিত হতো। আমরা কি কখনো বলতে পারব যে, সেগুলো শোভন ছিল না, সেগুলো সুন্দর ছিল না, শালীন ছিল না। তা মনে হয় আমরা কেউই বলতে পারব না। কেন আমরা একজন মানুষের ব্যক্তিগত রুচি, তার ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধ, তার ব্যক্তিগত ভালোলাগা, তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আমরা কেন হস্তক্ষেপ করতে যাব?

আমার খুব বলতে ইচ্ছে হয় যে, একটি মানদণ্ড তৈরি হয়ে যায় একটি দেশের সংস্কৃতিতে, একটি দেশের ইতিহাসে একটি দেশ ঐতিহ্যে। তেমনি একটি মানদণ্ড তৈরি হয়ে যায় পোশাকের ক্ষেত্রেও। সেখানে জোর করে কোনো কিছু প্রয়োগ করার কোনো অর্থ হয় না। জাতিগত সংস্কৃতির সঙ্গে ধমীয় সংস্কৃতির সংঘাত তৈরি করে যারা করে তার হয় বিষয়টি জানে না কিংবা তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে।  আমরা দেখতে পাচ্ছি বিষয়গুলোকে খুব সরলীকরণ করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা মোটেই সরল নয়। মোটেই সহজ নয়। এবং এর ভেতরে যে হিসাব-নিকাশগুলো আছে তার তাৎপর্য অনেক গভীরে প্রোথিত। সহজভাবে দেখলে খুব ভুল করা হবে। শতাধিক দেশের লোক বসবাস করে আমেরিকায়। তাদের ধর্ময় ও জাতিগত পরিচয় ভিন্ন। সেখানে এইসব সমস্যা তো ভয়াবহ রূপ ধারণ করার কথা। কিন্তু ক্বচিত তা দেখা য়ায়।

আমার মনে হয়, আমাদের কোনো একটা বড় সমস্যা হয়েছে। আমার বারবারই বলতে ইচ্ছা হয়, এই সমস্যাটা হয়েছে আমাদের শিক্ষার ভেতরে। আমাদের শিক্ষার প্রয়োগ ও পদ্ধতির ভেতরে । শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থার ভেতরে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের যেভাবে আমরা মানুষ করছি, যেভাবে আমরা অনুপ্রাণিত করছি, যেভাবে আমরা তাদের গাইড দিচ্ছি, যেভাবে আমরা তাদের মানুষ করতে চাচ্ছি, সেই সমগ্র প্রস্তুতিটা, সেই সমস্ত লক্ষ্যটা সঠিক নয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত আমরা একজন শিক্ষার্থীকে কীভাবে এই যাত্রা পথে ছেড়ে দেবো? সেখানে আমাদের উদ্দেশ্য কী, আমাদের লক্ষ্য কী, আমরা কী চাই? এই বিষয়গুলো নতুন করে ভেবে দেখা দরকার। কেননা গত ৫০ বছর ধরে আমাদের ভাবনাগুলোতে কিছু ত্রুটি আছে। কাউকে বা কিছুকে দোষারোপ না করে আমরা বলতে পারি, সেই ত্রুটিগুলো এখন সংশোধন করা দরকার। শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যেভাবে চাপ প্রয়োগ করছি, সেখান থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিষ্ঠার পেছনে আমরা যেভাবে ছুটে বেড়াচ্ছি, সেখান থেকেও আমাদের সরে আসতে হবে। আমাদের সন্তান-সন্ততিদের আমরা প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। আমরা তাদেরকে বড় চাকুরে হিসেবে হিসেবে দেখতে চাই; আমরা তাদেরকে বড় ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাই, আমরা তাদের বড় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চাই, তাদের আমরা বেশ ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। প্রচুর অর্থকড়ির মালিক হিসেবে তাদের আমর দেখতে চাই। এই চাওয়াগুলোর মধ্যে মানবিকতাবোধ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। এই চাওয়াগুলোর মধ্যে ব্যক্তি মানুষটির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা-  এই বিষয়গুলোকে মোটেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু এই চাওয়াগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুরভাবে, গোপন ভাবে, প্রচ্ছন্নভাবে স্বার্থপরতা প্রবলভাবে কাজ করছে। ফলে অনিবার্যভাবে এই ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে মানুষগুলো তৈরি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত তারা অমানবিক পরিশ্রম করছে, অসাধারণ ফলাফল করছে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু খুব ভালো মানুষ হিসেবে যে বেড়ে উঠছে না সেই দিকটির প্রতি কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

সারা পৃথিবীতেই শিক্ষার প্রতি মানুষ এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? কেন মনে করা হচ্ছে যে, শিক্ষর্থীরা যত গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে তাহলে টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত হবে। কেন মনে করা হচ্ছে শিক্ষার্থীকে যদি স্বাধীনভাবে, তার ইচ্ছার অনুকূলে, তার ভালো লাগার অনুকূলে শিখতে অনুপ্রাণিত করা হবে এবং সেক্ষেত্রে অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা হবে তাহলে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সহজ হবে। এবং যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মধ্যে প্রতিনিয়ত রাখা হবে সেই উদ্দেশ্য এবং সেই লক্ষ্য সাফল্যমত হয়। কিন্তু মুশকিল হলো, যে শিক্ষাব্যবস্থা বহুকাল থেকে আমাদের দেশে প্রচলিত হয়ে এসেছে, সেই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর এই ভেতরগত প্রতিভাকে, সৃষ্টিশীলতাকে, তার নতুন সব ভাবনাকে, তার প্রেরণা ও উৎসাহের জগৎকে অবাধ এবং উন্মুক্তভাবে বিকশিত হওয়ার কোনে সুযোগ রাখা হয়নি। এমনকি শিক্ষার্থী তার অতি সাধারণ নৈমিত্তিক কিছু কিছু ব্যতিক্রমীধর্মী ভাবনাকেও তার শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে উপস্থাপন করতে পারে না। কেননা এমনতর উপস্থাপন, এমনতর নতুনত্ব, এমনতর সৃষ্টিশীলতা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোটেই প্রচলিত নয়। কোনো শিক্ষকই এই ধারার প্রতিভাকে বুঝতে চাননা, মূল্যায়ন করতে চান না, মর্যাদা দিতে চান না। কারণ ব্যবস্থাটাই এমন যে, কোনো একজন শিক্ষক যদি এই সৃষ্টিশীলতাকে মূল্যায়ন করতে চান তা হলে তিনি কী করবেন? কিছুই করার সুযোগ তার নেই এবং সেই ধরনের কোনো  প্রশিক্ষণও তার নেই। ফলে অনিবার্যভাবেই পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে যা কিছু লেখা থাকে, শিক্ষক ক্লাসরুমে যা কিছু বলেন কিংবা বাড়িতে ও কোচিং সেন্টারগুলোতে যেভাবে তাকে শেখানো হয় তার বাইরে যাওয়ার সমস্ত পথ তার কাছে রুদ্ধ হয়ে যায়।

এমন একটি ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে একজন শিশু যখন বেড়ে উঠে তখন তার ভেতরে সৃষ্টিশীলতার জগৎটি চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। তার চিন্তার গড়নের মধ্যে, তার ভাবনার গড়নের মধ্যে এমন একটি অপ্রতিরোধ্য সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়, যেখান থেকে কখনোই বের হয়ে আসতে পারে না সে। ফলে যে জীবন সে যাপন করে সেই জীবন নিয়ে তার কোন প্রশ্ন থাকে না, তার কোন জিজ্ঞাসা থাকে না, তার কোন কৌতূহল থাকে না এবং সে কোনো একটি ঘটনাকে কোনো একটি টেক্সটকে, কোনো একটি প্রতিবেদনকে, কোনো একটি প্রশ্নকে, কোনো একটি মন্তব্যকে সে কখনোই প্রশ্ন করতে পারেনা। কখনোই মনে করতে পারে না যে, যৌক্তিকতার আলোকে নতুন কিছু বলা যায়, নতুন কিছু ভাবা যায়, নতুন কিছু ব্যক্ত করা যায়, নতুন কিছু উপস্থাপন করা যায়। তার মধ্যে এই বোধের উদ্বোধন ঘটে না যে নতুন ভাবে, নতুন পথে, নতুন পদ্ধতিতে, নতুন প্রজ্ঞায়, নতুন চিন্তায়, নতুন এক জীবন রচনা করা যায়, নতুন জবনাকাঙ্ক্ষা তৈরি করা যায়, নতুন কোনো সুন্দর সৃষ্টি করা যায়। ফলে এক জীবন তাকে এই নিয়তি বহন করতে হয় যে, ধর্মের বিন্দুমাত্র জ্ঞান আহরণ না করে কিংবা সামান্য ধর্মজ্ঞান নিয়ে ধর্মের সঙ্গে বসবাস করা। আর তখন যে সমস্যাটি তৈরি হয় তা হলো অযৌক্তিকতার পরিতোষণ করা, প্রথাগত ধারণার অনুগত থাকা; প্রথাগত কুসংস্কার, প্রথাগত পশ্চাদপদতা, প্রথাগত অন্ধত্ব তাকে এমনভাবে গ্রাস করে যে, সে কিছুতেই আলোর স্পর্শ পেতে চায় না। সে কিছুতেই জীবনকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে, বহুত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারে না। সে কিছুতেই ভাবতে পারে না যে, বিশ্বব্রহ্মা- বৈচিত্র্যের সমাহার, পৃথিবীর প্রতিটি স্থান বৈচিত্র্যে ভরপুর, প্রতিটি মানুষ বহুতর বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এই বৈচিত্র্যকে উপভোগ করতে হয়, এই বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হয় এবং এই বৈচিত্র্যকে ভালবাসতে হয় এবং সর্বোপরি বৈচিত্র্যে মধ্যে ঐক্য সংস্থাপিত করতে হয়।

সে ভাবতে পারেনা যে, প্রাণিজগৎ, উদ্ভিদ জগৎ এবং ভৌগোলিক জগৎ যেমন বৈচিত্র্যময় ও তার ঐক্য সৌন্দর্যময়, তেমনি প্রতিটি মানুষ একেকটি আলাদা সত্তা এবং বৈচিত্র্যময়। সেই বৈচিত্র্য তার দেহের গড়নে, তার বর্ণে, তার উচ্চতায়, তার বিশ্বাসে, তার অবিশ্বাসে, তার আনন্দে, তার বেদনায়, তার রুচিতে, তার বোধে, তার মননে এবং অবশ্যই তার পোশাকে। সর্বত্রই অফুরন্ত বৈচিত্র্য নিয়ে, অফুরন্ত আলাদাত্ব নিয়ে সমাজের বিচিত্র একজন মানুষকে আপন করে নেওয়া শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের অনেকের মধ্যেই থাকে না। আমরা কিছুতেই বুঝতে চাই না যে, ধর্মীয় দিক থেকে যেমন মতাদর্শের দিক থেকেও তেমনি প্রতিটি মানুষ আলাদা এবং আমার ধর্ম যাই হোক না কেন, যে মতাদর্শ আমি লালন করি না কেন অন্যের মতাদর্শকে, অন্যের ধর্মকে, অন্যের আদর্শকে আমি কিছুতেই হেয় করতে পারি না, আঘাত করতে পারি না। অধিকন্তু বৈচিত্র্যের এই যে বিপুলতা তাকে সম্মান করা, তাকে শ্রদ্ধা করা প্রতিটি মানুষের মানুষ হিসেবে দায়। আমি কারো পোশাক নিয়ে, ধর্মাচরণ নিয়ে, মতাদর্শ নিয়ে, রুচি নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে কিছুতেই কটূক্তি করতে পারি না, বিবাদ-বিসংবাদে জড়াতে পারি না। আর ওই যে দায়বোধের কথা বলা হলো তা তৈরি হয় শিক্ষার ভেতর দিয়ে। কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে আলোকিত এই মানুষ তৈরি করার কোনো সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি।

পেপার-পেন্সিল টেস্ট-এর ভেতর দিয়ে, নানা রকম পরীক্ষার ভেতর দিয়ে, পাঠ্যপুস্তকের ভেতর দিয়ে, শিক্ষক ও অভিভাককের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের ভেতর দিয়ে, অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠাপ্রবণ প্রবল চাপের ভেতর দিয়ে আলোকিত ওই মানুষ তৈরি করা যায় না। এর জন্য দরকার উন্মুক্ত-উদার এক পরিবেশ, এর জন্য দরকার প্রকৃতির মতো আবহ এবং সর্বোপরি এর জন্য দরকার এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যে ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে একজন শিশু একটি বৃক্ষের মতো নিজেকে বাড়িয়ে তুলবে; শাখা-প্রশাখা, প্রত্রপল্ল ও ফুল-ফলের মতো আপনা থেকে বিকশিত হয়ে উঠবে। আর এর জন্য দরকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষার্থী-মূল্যায়নে নতুন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করা। সেই পথ এবং পদ্ধতি কী? সেই পথ এবং পদ্ধতি হলো প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীকে নার্সিং করা। বীজ বপন থেকে অঙ্কুরিত একটি বৃক্ষকে যেমন প্রতিনিয়ত পরিচর্যা করে করে তাকে বড় করে তোলা হয় এবং বৃক্ষটি পত্রপল্লবে, ফুলে-ফলে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে, তেমনি একজন শিশুকে তার জন্মপূর্বকাল থেকে বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতিতে নার্সিং করা প্রয়োজন। তার প্রতিদিনের কর্মের ভেতরে, তার প্রতিদিনের খেলাধুলার ভেতরে, তার প্রতিদিনের লেখপড়ার ভেতরে এবং তার প্রতিদিনের জীবনাচরণের ভেতরে এমনভাবে মূল্যায়ন করা দরকার যাতে তার সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার পথ পায়।

বিদ্যালয়ে শিশুকে মূল্যায়নকরা হয়। মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে একজন শিশু বেড়ে ওঠে। কিন্তু মূল্যায়ন মানে শুধু তাকে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা? মোটেই কিন্তু তা নয়। মূল্যায়ন মানে হল প্রতিনিয়ত তাকে বিকশিত হওয়ার পথ করে দেওয়া, তাকে সুনাগরিক করে তোলা, ভালো মানুষ করে তোল, দক্ষ ও যোগ্য মানুষ করে তোলা এবং প্রতিনিয়ত সে যাতে নিজেকে অতিক্রম করতে পারে তার জন্য ভেতরে প্রেরণা সঞ্চারিত করা। অন্যকে অতিক্রম করার দায় তার নয়। যখনই অন্যকে অতিক্রম করার জন্য তাকে বলা হবে তখন তার মধ্যে দানা বাঁধবে পরশ্রীকাতরাত ও প্রতিহিংসা। এই পথ আনন্দের নয়।

সে যথাসময়ে স্কুলে আসে কিনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিদান করে কি না, যথাসময়ে ক্লাসরুমে থাকে কি না, ক্লাসে শিখন-সেখানোর বিচিত্র কর্মযজ্ঞে সে অনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে কি না, বিধি-বিধান অনুসরণ করে সহপাঠীদের সঙ্গে, শিক্ষকের সঙ্গে এবং প্রতিষ্ঠানের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আচরণ করে কি না, খেলাধুলায় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে কি না, যেই বিষয়গুলোকে সে ভালোবাসে ও পছন্দ করে সেই বিষয়গুলোতে সে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় কিনা এবং সর্বোপরি তার সৃষ্টিলতার জায়গাগুলো প্রশংসিত হচ্ছে কি না-  এই বিষয়গুলো দেখভাল করাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের প্রধানতম দায়িত্ব। সুতরাং স্পষ্টতই অনুধাবন করা যাচ্ছে যে, শিক্ষকদের কতটা মানবিক ও দক্ষ হওয়া দরকার।

পেপার-পেন্সিল টেস্টের ভেতর দিয়ে এই দায়িত্ব কিছুটা পালন করা যায়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সবটুকু নয়। আমাদের শিক্ষকদের বুঝতে হবে যে, প্রতিনিয়ত শেখানো তাদের দায়িত্ব নয়। শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতি সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়েই শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখন এমন এক সময় এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি যখন জ্ঞানকাণ্ডগুলো বিকশিত হতে হতে বিপুল আকার ধারণ করেছে। সুতরাং এই বিপুল জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ শিক্ষকের নেই। সেই সময় শিক্ষকের নেই, সেই সময় শিক্ষার্থীরও নেই। তাহলে কেন শেখানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা? আমার খুব মনে হয়, শেখানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা না চালিয়ে যদি একজন শিক্ষার্থীকে শেখার পদ্ধতি সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সারাটা জীবন সে শিখতে পারে। একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক শিক্ষার্থীদের কবিতা পড়ানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তুকে কয়েকটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাহলে শিক্ষকের দায়িত্ব হলো পাঠ্যভুক্ত ওই কটি কবিতা কিভাবে পড়তে হবে সেই পথ বাতলিয়ে দেওয়া এবং ওই কয়টি কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে পরবর্তী জীবনে সে যেন সকল কবিতার পড়তে পাড়ে, বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে সেই সামর্থ্য তৈরি করে দেওয়া। কেননা রাজ্যের সমস্ত কবিতা শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ শিক্ষকের নেই। তেমনিভাবে জ্ঞানকাণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রয়োজন শিক্ষার্থীকে শেখার পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

জ্ঞানকাণ্ডের বিচিত্র শাখার সঙ্গে এই পরিচয়ের ফলে তার মধ্যে শেখার এক ধরনের প্রেরণা তৈরি হবে। কেননা কোন বিষয় কীভাবে শিখতে হয়-  এই কৌশল তার জানা আছে। ফলে এক জীবন পড়াশোনা করার একটি সংস্কৃতি তার মধ্যে তৈরি হওয়া সম্ভব। যদি স্কুলজীবন থেকেই গ্রন্থপাঠের এই সংস্কৃতি তৈরি করা যায় তাহলে ইতোমধ্যে বৈপরীত্যের সঙ্গে বৈরিতার যে কথাগুলো বলা হলো সেগুলো অনেকাংশে কমে আসবে বলেই মনে হয়। পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানার্জনে, বিজ্ঞানচর্চায় ও মানবিকতার চর্চায় যথেষ্ট অগ্রগামী, সেই সব দেশে লোকালয়ে প্রচুর লাইব্রেরি থাকে এবং অধিবাসীরা সময় পেলেই লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করে এবং অধিকাংশ সময় তারা গ্রন্থপাঠের ভিতর দিয়ে অবসর সময় অতিবাহিত করে। যানবাহনে, স্টেশনগুলোতে এবং অবসর যাপনের কেন্দ্রগুলোতে এই দৃশ্য নিত্যদিনের। ফলে অনিবার্য হবেই তাদের মধ্যে যে বোধের উদ্বোধন ঘটে সেই বোধ মানবিক বোধ, সেই যৌক্তিকতার বোধ এবং সেই বোধ বিজ্ঞানমনস্কতার বোধ। আমরা যদি পারিবারিক ও শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে পারি, তাহলে এখন সামাজিকভাবে যেসব বিতর্ক-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায় তা অনেকাংশে কমে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক