সরকার আবদুল মান্নানের গল্প ‘ভূতচাষ’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২২
শিবলু আর পলি গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছিল ঢাকায়। রিচি, শুচি ও শাওনদের বাসায়। এক সপ্তাহ ছিল ওরা। সেই দিনগুলি রিচিদের জন্য কি যে অনন্দের ছিল, তা আর বলবার নয়। কত গল্প শিবলুদের! মাঠের গল্প, পুকুরের গল্প, নদীর গল্প, কুকুর-বিড়ালের গল্প, খেলার মাঠের গল্প, পাখি শিকারের গল্প, মাছ ধরার গল্প, সাঁতার কাটার গল্প। গল্পের আর শেষ নেই। আর সব গল্পের সেরা গল্প হলো ওদের ভূতের গল্প।
আশ্চর্য সব ভূত গ্রামে বসবাস করে। আর সেই সব ভূতদের দিন শুরু হয় রাতে। শিবলুরা রাতে ভূতদের সঙ্গে খেলে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এক বাড়ির ওঠানে জড়ো হয়। একজন ভূত বলে চিৎকার করলে সবাই ভূত ভূত বলে হৈচৈ শুরু করে আর এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে দৌড়ায়। ভয় আর আনন্দ মিলে তখন ওদের কি যে মজা হয়!
তার পর মনে হয় ভূতটা দেখেছিল কে, তাকে খুঁজে বের করা দরকার। কোথায় দেখেছিল, দেখতে কেমন, এই সব জানা দরকার। তখন এক জন বলবে, সে দেখেছে। নুরুন আপাদের দুই ঘরের মাঝখানে যে বাঁশঝার আছে, ওটার মাথায়। ভূতটার মাথা তাল গাছটার উপর দিয়ে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে আর ওর এক পা মেঘনার তীরে আর আরেক পা পুবের বিলে। গণ্ডারের মতো ওর মাথায় একটা শিং। বুক থেকে বেরিয়েছে একটা হাত আর নাক থেকে বেরিয়েছে একটা চোখ।
একজনে দেখলেই হলো, সেটা একদম সত্য। সবার কাছে। কেউ বলবে না, ‘গণ্ডারের মতো একটা শিং, কী করে জানলি, তুই কি গণ্ডার দেখেছিস?’ শিবলুরা অনেকে এ রকমই দেখেছিল। কেউ বলবে, আমিও দেখেছি, একদম এ রকম। অন্য জনে বলবে, আমিও দেখেছি, একদম এ রকম, আমিও...
এই ভাবে হৈচৈ আর আনন্দের মধ্যে তাদের ভূত দেখার পর্ব এক সময় শেষ হয়। পর দিন সন্ধ্যার পরে আবার শুরু হয় ভূত দেখার পালা। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো গল্প নেই। পাখি শিকারের গল্প, মাছ ধরার গল্প, হৈহৈ রৈরৈ করে শহরময় ঘুরে বেড়ানোর গল্প, কোনো গল্পই নেই। আর ভূতের গল্প তো চিন্তাই করা যায় না। ঢাকা শহরে কোনো ভূত নেই, বিশেষ করে এই নিয়ে রিচি, শুচি ও শাওনের মনে অনেক দুঃখ। তারা কখনো ভূত দেখেনি। ভূত দেখার ভয় বা আনন্দ কী জিনিস, তারা তা জানে না। তাই তারা ভাবছে, কীভাবে ঢাকা শহরে ভূত চাষ করা যায়। এর জন্য গবেষণা প্রয়োজন। তাই ভূত নিয়ে গবেষণা করছে শুচি, রিচি আর শাওন। গবেষণার বিষয় হলো, ঢাকাতে কোনো ভূত নেই কেন? ঢাকাতে কী সমস্যা? ভূত ছাড়া একটি শহর কীভাবে শিশুদের উপযোগী হয়- এই সব। এই গবেষণার লক্ষ্য হলো, এক দিন ঢাকা শহরকে ভূতের শহর বানানো।
শাওন বলল, ঢাকাতে ভূত থাকবে কীভাবে? ঢাকার বায়ু তো দূষিত। আর ভূত তো থাকে বায়ুতে। আমাদের মতো ওরা তো ঘরের মধ্যে থাকে না।
শাওনের কথার প্রতিবাদ করে শুচি। বলে, ফালতু কথা। বায়ুতে না-থাকে কে? আমরা কি আসমানে থাকি? আমরা তো বায়ুতেই থাকি। তোর কি মনে হয়, আমাদের ঘরে বায়ু নেই? এটা কোনো কথা না, বুঝলি। সমস্যা হলো আলো। ভূতেরা আলোতে বাঁচতে পারে না। যেখানে আলো থাকে সেখানে ভূত থাকে না। আমাদের শত্রু যেমন তপন স্যার, তেমনি ভূতের শত্রু হলো আলো।
রিচি মহা পণ্ডিত। সে কখনই আগে কথা বলে না। সে বলে সবার পরে। এতে ওর সুবিধা হয়। শুচি আর শাওনকে হারিয়ে দিতে পারে সহজেই। কিন্তু অসুবিধাও আছে। শেষ পর্যন্ত শুচি আর শাওন এক হয়ে রিচির বিরুদ্ধে লাগে। তবুও রিচি মনে করে, সে একাই একশ।
রিচি বেশ একটা বিজ্ঞের ভান করে। বলে, শোন, তপন স্যার আমাদের শত্রু না। স্যারকে শত্রু বললে আল্লাহ গুনা দেবে, বুঝলি? পড়া না পারলে স্যার কি আদর করবে? করবে না। আর বায়ু বা আলো ভূতের জন্য কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো মানুষ। এত মানুষের মধ্যে ভূত কী করে থাকবে? কোথায় থাকবে? ভূত বলে ওদের কি কোনো প্রাইভেসি নেই? সেই জন্যই ঢাকা শহর ভূতদের জন্য মোটেই উপযোগী না।
শুচি আর শাওন এক হয়ে গেল। কারণ, রিচি ওদের দুজনকেই আক্রমণ করেছে। দুজনকেই নাকোচ করে দিয়েছে। শাওন রিচির উপর রেগে যায়। বলে, তপন স্যার শত্রু না হলে কে আমাদের শত্রু, তুই? পড়া না পারলে আদর করে বলেলই তো হয়। তার জন্য সারাক্ষণ বকাবাদ্য করতে হবে? সে দিন কী বলল, আমি নাকি ভূতের মতো বসে আছি, কথা বলছি না। বল, এটা কি কোনো কথা হলো? মানুষ কখনো ভূত হতে পারে? আর তুই যে বললি, ভূতের জন্য আলো কোনো সমস্যা নয়, এটা একদম ঠিক না। আলো অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। তুই কখনো শুনেছিস, দিনের বেলা কাউকে ভূতে ধরেছে। ছোট কাকুর সেই ভূতটার কথা তুই ভুলে গেছিস? ভূতের তিনটি পা মাটিতে, দুটি পা মক্তবের পাশের পুকুরে আর মাথাটা উঁচু তাল গাছটার উপরে। ভূতটা কাকার মাথায় পাকা তাল ছুড়ে মারছিল। ভুলে গেছিস সেই আজব ভূতটার কথা? কাকাও কি কম যায়! পাকা তাল ছুড়ে ভূতের পা থেতলে দিয়েছিল। সারা রাত ভূতের সঙ্গে লড়াই হলো কাকার। কিন্তু যখনই দিনের আলো ফুটতে লাগল, তখনই পালিয়ে গেল পাজি ভূতটা। তার মানে কি, ভূতের শত্রু আলো। আর ঢাকা শহরে তো আলো নিভেই না। রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে, কলকারখানায় সারা রাত আলো থাকে। তা হলে ভূত থাকবে কোথায়? এই জন্যই ঢাকা শহরে কোনো ভূত নেই।
শুচিও যুক্তি দাঁড় করাল। বলল, রিচি, তোর মাথায় গোবর। মানুষ কী করে ভূতের শত্রু হয়? মানুষ ছাড়া কখনো ভূত হতে পারে? মানুষ আছে বলেই তো ভূত আছে।
শাওন শুচির কথা কেড়ে নিয়ে বলে, একদম ঠিক বলেছিস। মানুষ ছাড়া আবার কিসের ভূত। আর মানুষ নেই কোথায়? গ্রামে কি মানুষ নেই? শহরে মানুষ আছে, গ্রামেও মানুষ আছে। মানুষই যদি ভূতের শত্রু হয়, তা হলে তো গ্রামে বা শহরে, কোথাও ভূত থাকতে পারত না। কী বলিস শুচি, তাই না?
শুচি আর শাওনের যুক্তির কাছে রিচি দাঁড়াতে পারছে না। সে একটু দমে যায়। কিন্তু রিচি বলে কথা। সে ওদের বুঝতে দেয় না যে, সে একটু বেকায়দায় আছে। বলে, মানুষ ছাড়া ভূত হয় না- সেটা ঠিক। তাই বলে এত্তো মানুষ! আরে বাপরে বাপ! কত রাস্তা, কত বাজার, সপিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ। আর বিল্ডিং, বিল্ডিং, বিল্ডিং। ভূত থাকার তো জায়গা থাকতে হবে। সবখানে তো থাকে মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তোরা বল, ভূত কোথায় থাকবে?
শুচি বলে, ‘ঠিক বলেসিছ, এত মানুষ ভূতের জন্য সমস্যা। কিন্তু মানুষ থাকতে হবে। আর থাকতে হবে বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় আর অন্ধকার।
শাওন বলল, অন্ধকার ঠিক আছে। অন্ধকার ছাড়া ভূত বাঁচে না। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ভূতও দেখা যাবে না।
শাওনের কথা শুনে রিচি খুব মজা পায়। বলে, তোর মাথায় তো দেখছি অনেক বুদ্ধি! সত্যি তো, ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভূত দেখা যাবে না। তার জন্য দরকার কুয়াশার মতো আলো।
শুচি বলে, নিশ্চয়ই। দাদা বাড়িতে দেখিস নি, রাতেও আলো থাকে। হালকা আলো। আকাশে চাঁদ থাকলে তো কথাই নেই। মিষ্টি আলো ছড়িয়ে থাকে সবখানে। গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে গলিয়ে চাঁদের আলো কয়েনের মতো ছড়িয়ে থাকে গাছের তলায়। দেখিসনি? আর আকশে চাঁদ না থাকলেও অনেক আলো থাকে। তারার আলো। রাতের ঘন অন্ধকারে হালকা আলো মিশে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। ভূতদের জন্য এমন রাত খুবই ভালো। ওদের জন্য সুখের দিন।
রিচি বিরক্ত, বলে, তোর বক্তৃতা রাখ। এখন বল কীভাবে ঢাকা শহরে ভূতের চাষ করা সম্ভব।
শাওন বলল, একদম সোজা। কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী বলবে। সোজা বলে বেশ বেকায়দায় আছে শাওন। তার পর ইতস্তত করে বলল, ‘শুচি, তুই বলল।
শুচি বলল, সোজা বললি তুই। এখন তুই বল।
শাওন বুঝতে পারছে না কী বলবে। ফসলের চাষ হয়, ফলের চাষ হয়, মাছের চাষ হয়। এই সব চাষের বইও পাওয়া যায়। কিন্তু ভূত চাষ? শাওন বোকা বোকা ভাব নিয়ে বলে, আচ্ছা শুচি, ভূত চাষের কি কোনো বই আছে?
রিচি বলে, ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে দেখা যায়। কি বল শুচি?
শুচি জোর দিয়ে বলে, নাহ্, ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে ভূত চাষের বই পাওয়া যাবে না। আমরা বরং মেজো কাকুকে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে বলি।
শাওন বলে, কী স্ট্যাটাস?
শুচি বলে, আমরা লিখব, গল্পের বই পড়ে আমরা আর ভূতের গল্প শিখতে চাই না। গ্রামের শিশুদের মতো আমরা ভূত দেখতে চাই, দেখে দেখে ভূতের ভয় পেতে চাই। তার জন্য ঢাকা শহরকে ভূতদের থাকার উপযোগী করে তুলতে হবে।
আহ্ হা! তা তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা কীভাবে? রিচি মহা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
রাত দশটার পরে ঢাকা শহরে একটি বাতিও জ্বলবে না। ঢাকা শহরকে ব্ল্যাক আউট করে দিতে হবে। এটা হলো এক নম্বর।
শাওন বলে, ব্ল্যাক আউট কী শুচি?
ব্ল্যাক আউট হলো বিদ্যুৎ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। বুঝলি ক্ষুদে পণ্ডিত।
ব্লাক আউট হলে পড়ব কীভাবে, টিভি দেখব কীভাবে? হতাশ হয়ে বলল শাওন।
ঢাকা শহরে ভূতের চাষ করতে হলে রাত দশটার পরে টেলিভিশন দেখা যাবে না। পড়তে চাইলে মোমবাতি, হারিকেন বা কুপির আলো দিয়ে পড়বি।
শাওন বলে, আচ্ছা।
দুই নম্বর হলো, ঢাকা শহরের সর্বত্র থাকবে গাছ আর গাছ। প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ের চারদিকে থাকবে...
শাওন শুচির কথা কেড়ে নিয়ে বলে, বুঝেছি। ঢাকা শহরকে বৃক্ষের শহর বানাতে হবে।
রিচি বলে, সাধু ভাষা বলছিস কেন? বল, ঝোপ-ঝাড়-ঝঙ্গলের শহর।
শুচি বলে, ঠিক তাই। ঘন গাছগাছালির ভিতরে বিল্ডিংগুলোকে মনে হবে তুচ্ছ। তা হলেই আমরা ভূতের দেখা পাব। গ্রামে গিয়ে আমরাও শিবলু আর পলিকে ভূতের গল্প শোনাতে পারব। আর তিন নম্বর হলো...
শাওন বলে, আর কী? আকাশে তারা থাকতে হবে আর চাঁদ উঠাতে হবে? তাই না?
বোকার মতো কথা বলিস না তো শাওন। আকাশের তারা কি আমাদের ইচ্ছায় হবে। আর অমরা কি কখনো চাঁদ উঠাতে পারব। কখনই সম্ভব না। বিরক্ত হয়ে বলে শুচি।
শাওন বলে, আচ্ছা, আচ্ছা, বল তিন নম্বরে কী।
তিন নম্বর হলো, ঢাকাতে যত পুকুর ছিল, খাল ছিল সেগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে- একদম আগের মতো করে দিতে হবে।
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর আরিফকে ধরে বসে তার মেয়ে রিচি ও ছেলে শাওন এবং তার বড় ভাইয়ের মেয়ে শুচি। বলে, তোমার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে হবে।
ঘটনা শুনে আরিফ খুব মজা পায়। বলে, আমার একাউন্টে দিয়ে তো লাভ নেই। তোমাদের তিন জনের নামে একটি একাউন্ট খুলে দিই। তোমাদের স্ট্যাটাস তোমরা দাও।
শুনে রিচি, শুচি আর শাওনের আনন্দের সীমা থাকে না।
কীভাবে স্ট্যাটাস দিতে হবে আরিফ ওদের শিখিয়ে দেয়। ওরা তিন জনে স্ট্যাটাসের একটি ড্রাপ তৈরি করে খাতায়। তার পর নিজেরা বেশ কয়েকবার কারেকশন করে নেয়। যখন তিন জন একমত হয় ‘এখন চলবে’ তখন স্ট্যাটাসটি লিখে পাবলিক করে দেয়।
পরদিন সকালে মোবাইল নিয়ে আরিফ চলে যায় অফিসে। অন্য কারো মোবাইলে এক্সেস নেই ওদের। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত অক্ষোয় থাকতে হয় রিচি, শুচি ও শাওনের। আরিফ বাসায় ফিরলে এই তিন শিশু ধরে বসে তাকে। আরিফ বলে, তোমাদের পাসওয়াড দাও। দেখি কী রেজাল্ট হয়েছে।
ওদের টাইম লাইনে গিয়ে দেখা গেল, স্টেটাসটি হাজার বার শেয়ার হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ লাইক পড়েছে। তিন দিনের মধ্যে স্টেটাসটি সামাজিক মিডিয়াগুলোতে হৈ চৈ ফেলে দেয়। শুচি, রিচি আর শাওন রাতারাতি দেশময় পরিচিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি সংসদে ওঠে। সকল সংসদ সদস্য একমত হন যে, ঢাকা শহরকে ভূতের বাসোপযোগী করতে হবে। গাছ-গাছালি ও জঙ্গল দিয়ে ভরে দিতে হবে ঢাকা শহর এবং তার নিচে থাকবে প্রচুর খাল আর পুকুর। বিল্ডিংগুলো কিছুতেই গাছের চেয়ে বড় হতে পারবে না।
রিচি, শুচি ও শাওন এক দিন নিশ্চয় ঢাকা শহরে ভূত ভূত খেলতে পারবে এবং গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ভূতের গল্প করতে পারবে।