সরকার আবদুল মান্নানের গল্প ‘জলের স্বপ্ন’
প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২৪
মেয়েটির নাম নিতু, নিতু শ্রাবন্তি। ছিপছিপে লম্বা। ফর্সা। মায়াবি চোখ। অস্থির। কী যেন খুঁজছে সারাক্ষণ। পিঠ ছাড়িয়ে চুলগুলো হাঁটুর কাছে পৌঁছেছে। প্রথমে দেখলে মনে হয়, হাঁটু পর্যন্ত চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে, সে কেউ নয়। শুধু চুলের পুতুল। দীর্ঘ সেই চুল শুকায় না কখনোই। শুকানোর সময় কই? নিতু সারাক্ষণ পানিতে থাকতে ভালোবাসে। উত্তরের পুকুরে সাঁতার কাটে। দক্ষিণের পুকুরে সাঁতার কাটে। খালে সাঁতার কাটে। বিলে সাঁতার কাটে। কখনো কখনো দূরের মেঘনা নদীতে চলে যায় সাঁতার কাটতে।
অবাক করা বিষয় হলো, নিতুর সাঁতার কাটতে দলবল লাগে না। যদি কেউ থাকে ভালো, না-থাকলেও মন্দ নয়। বরং একা একা সাঁতার কেটেই নিতু শান্তি পায়। নির্জন পানির সঙ্গে প্রাণখুলে ও যেন কথা বলতে পারে। পানির শরীরে মিলিয়ে দিতে পারে নিজেকে। লতানো শরীরটাকে।
বিলের জলে সাঁতার কাটে নিতু। ডুব দেয়। স্বচ্ছ জলের তলে তখন শেওলা-শালুক স্রোতের সঙ্গে ঢেউ তোলে। স্রোতের সঙ্গে গা এলিয়ে দেয়। স্রোতের সঙ্গে ঘুরে, ঢেউ তোলে, পাক খায়।
নিতুও যেন জলকন্যা। জলের সঙ্গে সেও ঢেউ তোলে, গা এলিয়ে দেয়, ঘুরে, পাক খায়। আর সেই নির্জন জলের তলে ওর দীর্ঘ চুলগুলো মেঘের মতো ছায়া হয়ে ওর সঙ্গে চলে ঢেউ তোলে, ঘোরে, পাক খায়।
জলজ উদ্ভিদগুলো ওকে চেয়ে চেয়ে দেখে। আর অবাক হয়। আর ভাবে, আমরা তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে জলের মর্জি মতো চলি। নিতু নামের ওই জলজ মানুষটা তো তা নয়! ও কত স্বাধীন! আমাদের ছুঁয়ে যায়, ছাড়িয়ে যায়, ফিরে আসে, ফিরে যায়, উপরে যায়, নিচে যায়, ডানে যায়, বায়ে যায়। আপন মনে কত কী করে! আর আমরা সারা জীবন জলের ইচ্ছায় চলি, স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দিই।
জলজ উদ্ভিদেরা ভাবে বটে, কিন্তু নিতুকে ঈর্ষা করে না। ভালোবাসে। নিতু পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়লেই ওরা বুঝতে পারে নিতু এলো। জলের শরীরে নিতুর গায়ের মিষ্টি গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়ে। ওর শিশু হৃদয়ের পরিচ্ছন্ন কম্পন যেন প্রাণচঞ্চল করে তোলে জলের জগৎ। মাছেরা বলে, ওই তো ওই, নিতু এসেছে। জলজ উদ্ভিদেরা বলে, তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও। নিতু এসেছে। খেলতে হবে ওর সঙ্গে। জলের নিচের নরম মাটিরা বলে, পচা শামুক, ভাঙা ঝিনুক, কাঁটার ডাল আর পাথরের টুকরো তোমরা সবাই সরে যাও। আমাদের নিতু এসেছে। ওর নরম পায়ে গিয়ে বিঁধো না যেন। তোমাদের জন্য আমাদের নিতু ব্যথা পায় না যেন। সরে যাও সবাই, সরে যাও।
পচা শামুক সরে যায়। আর বলে, কী কুক্ষণে যে জন্ম আমার! শামুক হলেও হতো। হলাম কিনা পচা শামুক! নিতুর সঙ্গে খেলতে পারি না।
ভাঙা ঝিনুকও দূরে সরে যায়। কষ্ট বুকে নিয়ে বলে, নিতু আজ নয়। তবে একদিন তোমার হাতে আমি যাবই। সে দিন কাঁচা আম কেটে খেতে আমাকে নিশ্চয়ই লাগবে। পাথরে ঘষে ঘষে আমার বুকটা তুমি যখন ফুটো করে নেবে, তখন আমি দুঃখ নেব না। আনন্দে তোমার হাতের কাটারি হব। সেদিন নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ভালোবাসবে। কাঁটার ডাল আর পাথরেরা মনের দুঃখ মনে রেখে দূরে সরে যায়। নিতুর বন্ধু হওয়ার কোনো পথ খুঁজে পায় না তারা।
নিতু জলের মধ্যে সংগীতের সুর তুলে সাঁতার কাটে, ডুব দেয়। মাছেরা সবাই আনন্দিত হয়ে ওঠে। জলের মধ্যে শুরু হয় মাছেদের কোলাহল। জলজ ঘাস আর লতাগুল্মের শরীরে গা ঘেঁষে নেয় মাছেরা। তার পর লুটপুটি খায় আর বুক দেখায় আর পেট দেখায়। চকচকে সাদা সেই বুকে-পেটে সূর্যের আলো পড়ে। জলের জগতে শুরু হয় মিষ্টিমধুর আলোর খেলা। আলোর সেই প্রতিবিম্ব প্রকৃতির অনেক রহস্য আর সৌন্দর্যের মতো বাতাসে ঘুরে বেড়ায়।
হিজলের ডালে বসে থাকা ফিঙে পাখিটি খোঁজ পায় তার। চঞ্চল হয়ে ওঠে তার লেজ আর চঞ্চু। জলের দিকে তাকিয়ে সে বিস্মিত হয়। আরে আরে! এ তো দেখছি আমাদের নিতু! মাছেদেরে সঙ্গে সাঁতার কাটছে। আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে জলের অলিগলিতে। তারই রূপ আর রেখা আর রস ছড়িয়ে পড়ছে সব দিকে। ফিঙে ভাবে, আমিও যদি নিতুর মতো সাঁতার কাটতে পারতাম! আহ্! কী যে মজা হতো!
মাছরাঙা বসেছিল কাছের একটি ডুমুর গাছের মগডালে। মাছ শিকার করার ফন্দি আটছিল। একটি রঙিন পুঁটির দিকে নিশানাও ঠিক করেছিল সে। কিন্তু মাছরাঙা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল, মাছেদের মধ্যে কোনো ভয়-ডর নেই। নেই কোনো সতর্কতা। আনন্দে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিতুর সঙ্গে। কত রঙের মাছ যে নিতুকে ঘিরে স্বচ্ছ জলের তলে উৎসব শুরু করেছে তার হিসাব নেই। জলের ভেতরে স্রোতের বাঁকে শুরু হয়েছে রঙের খেলা। আর সেই আনন্দে মাছরঙ্গার মধ্যেও রং লেগেছে। শিকার ভুলে সেও মেতে ওঠেছে আনন্দে।
পড়াশোনায় একদম আগ্রহ নেই নিতুর। মুখস্থ করে করে খাতায় লিখলে কী যে লাভ হয়, নিতু বুঝতে পারে না। অঙ্ক পরীক্ষা দিতে গেছে নিতু। যেসব অঙ্ক তার কমন পড়েনি সেগুলো করতে চেষ্টা করে করে সময় পার করে দেয় নিতু। বাড়িতে ফিরলে মা জিজ্ঞাসা করে, ‘নিতু, পরীক্ষা কেমন হয়েছে, সোনা?’
‘ভালো হয়নি মা। আজব প্রশ্ন হয়েছে। যেগুলো আমি বাড়িতে করেছি, দেখি সেগুলোই এসছে। এই অঙ্কগুলো তো আমি করেছি-ই। আবার এগুলো কেন করব? এটা কোনো প্রশ্ন হলো!’
বাবা শিক্ষিত মানুষ। তিনি বুঝলেন, এই মেয়ের পড়াশোনা হবে না। ও যেভাবে পড়তে চায়, পরীক্ষা দিতে চায়, সেভাবে সম্ভব না। তাই মেয়েকে কাছে নিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে মা, একদম ঠিক করেছো। বাড়িতে লিখলে ওগুলো আবার পরীক্ষার হলে গিয়ে লেখার দরকারটা কী। কিন্তু এ সব কথা তোমার মাকে বলতে যেও না।’
আচ্ছা’ বলে নিতু দেয় ছুট।
মুখস্থ করার ক্ষমতা নিতুর খুবই কম। এ জন্য সবখানে ওর অনাদর। মা সারাক্ষণ বকে। মাঝে-মধ্যে চড়চাপড়ও দেয়। স্কুলে শিক্ষকরাও বকে। মারও দেয় কখনো কখনো। এই সব ভালো লাগে না নিতুর। ও ভাবে, আহা! পাখিদের জীবন কত সুন্দর। মাছেদের জীবন কত আনন্দের। ওদের কোনো বারণ নেই। কোনো নিষেধ নেই। পাখিদের ওড়ে বেড়ানোর কোনো সীমা নেই। মাছেদের ঘুরে বেড়ানোরও কোনো বাধা নেই। আমার জাীবন যদি পাখিদের মতো হতো! কোথায় কোথায় ওড়ে বেড়াতাম তার খোঁজ যদি কেউ না রাখত। বাড়ি ফেরার তাড়া যদি না থাকত! হাজারটা জেরার মুখোমুখি যদি হতে না হতো প্রতিদিন!
অনেক দিন নিতু স্বপ্নে পাখির মতো ওড়ে বেড়িয়েছে। রংবেরঙের অনেক পাখির সঙ্গে ওর সখ্য হয়েছে। কিন্তু সত্যি সত্যি উড়ার স্বাদ কি আর স্বপ্নে ওড়ে পাওয়া যায়? যায় না।
এর মধ্যে আবার এক দিন হলো কী, স্বপ্নে উড়ে উড়ে আকাশের অনেক ওপরে উঠে গিয়েছিল সে। আর ঠিক তখনই মনে হলো, তার পাখা খসে গিয়েছে। আর সে নিচে পড়ছে তো পড়ছেই। সেই পড়া আর শেষ হচ্ছে না কিছুতেই। ঘুমের ভেতরে নিতুর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আবস্থা। ঘুম ভেঙে যায় নিতুর। থরথর করে সে কাঁপতে থাকে। সে রাতে আর ঘুম হয়নি নিতুর। এর পর সে আর স্বপ্নে উড়ার স্বপ্ন দেখে না কখনই। এখন সে উড়ার স্বাদ লাভ করে জলে ভেসে, জলে সাঁতার কেটে, জলের গভীরে ডুব দিয়ে।
সে বছর বর্ষায় জল বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে ঘরের খুব কাছাকাছি চলে আসে জল। নিতুর আনন্দের সীমা থাকে না। চারদিকে শুধু জল আর জল। নিতু অবাক হয়ে যায়। ভাবে, এত জল ছিল কোথায়? এক সময় জল ওদের বাড়ির ওঠোনে গিয়ে ওঠে। নিতু খুব অবাক হয়। ও জানে, জল থাকে খালে বিলে পুকুরে আর নদীতে। বাড়ির ওঠোনে জল আসতে দেখেনি নিতু কোনো দিন। ওঠোনের জলে সারাদিন শিশুরা খেলে। নিতুও খেলে। কাগজের নৌকা, কলাগাছের খোল, সুপারি গাছের ঠোঙা ভাসিয়ে দেয় জলে। কিন্তু সাঁতার কাটার সেই পরিচিত খাল বিল পুকুর কোথায় যেন হারিয়ে যায়। বন্যার জলে সব একাকার হয়ে গেছে। কোথায় খাল, কোথায় বিল আর কোথায় পুকুর, কিছুই খুঁজে পায় না নিতু। সব কিছু কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়। আর এই বিপুল জলরাশি নিতুর খুবই অপরিচিত। এই অপরিচিত জলে নিতু আর সাঁতার কাটার সাহস পায় না। ও এখন সারাক্ষণ ঘরেই থাকে আর ওঠোনের জলে এটা ওটা ভাসিয়ে দেয়। কিছুই ভালো লাগে না নিতুর।
উঠোনের জল আরও বাড়তে থাকে। দস্যুর মতো এখন জল পৌঁছে গেছে ওদের ঘরের ভেতরে। হাট-বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। রান্নাবান্নাও বন্ধ। পশ্চিমের গ্রামগুলোতে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড কোলাহল আর হৈচৈ। চিরকালের দেখা শান্ত মেঘনা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড স্রোত আর স্রোতের ঘূর্ণিতে বালির বাঁধের মতো তলিয়ে যাচ্ছে সব। খাল বিল পুকুর নদীতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ছবির মতো সবুজ গ্রাম আর ফসলের মাঠ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি, হাস-মুরগি আর গবাধি পশু নিয়ে কে কেথায় চলে যাচ্ছে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কেউ কাউকে সাহায্য করার সুযোগ নেই। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। যে যেভাবে পারছে ছোট ছোট নৌকো করে পালাচ্ছে। শত শত বছরের আত্মীয়ের বন্ধন শেষ হয়ে যাচ্ছে নিমেশের মধ্যে।
এক সময় নিতুদের গ্রামেও শুরু হলো মেঘনার ভাঙন। নিতুর বাবা কোথা থেকে একটি নৌকা জোগাড় করে পরিবার-পরিজন আর ঘরদোড় নিয়ে রওয়ানা দেয় নিরুদ্দেশে। বর্ষার সময়টুকু থাকার জন্য আশ্রয় নেয় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের পোড়োবাড়িতে। বর্ষা শেষ হলে এই পরিবারটি চলে যায় উত্তরের লালমাটির দেশে। এখানে নদী নেই, খাল নেই, বিল নেই। আছে শুধু দু’একটি ডোবার মতো ছোট পুকুর আর ডিপ টিউবলের পানি। নিতুর কিছুই ভালো লাগে না। ওর চোখে সারাক্ষণ জেগে থাকে জলের স্বপ্ন আর স্বপ্নের জল।