সরকার আবদুল মান্নানের গল্প ‘এক বিকেলের গল্প’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫

এখন বিকেল ৪টা বাজে। আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিমের অর্ধেক আকাশটা দেখা যায়। ওই আকাশের নিচে যে পৃথিবীটা আছে, সেই পৃথিবীটাও এখান থেকে দেখা যায়। অন্যরকম একটি পৃথিবী। পূবদিকে সারে-সারে অনেকগুলো বিল্ডিং। প্রতিটি বিল্ডিং ১৪ তলা তো হবেই। সেখানে আলো পড়েছে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলো। সেই আলোয় ওই সৌধগুলো আনন্দিত হয়ে উঠেছে। মনে হয়, ওরা আনন্দে উড়ে বেড়াবে।

আর পাশে যে ছোট ছোট অসংখ্য বিল্ডিং আছে, সেগুলোর মাথা ছুঁয়ে গেছে অস্তগামী সূর্যের রৌদ্রচ্ছটা। আর বস্তিবাসীদের টিনের ঘরগুলো এরই মধ্যে অন্ধকারে ডুবে গেছে। আলো যতই থাকুক না কেন, ওদের এই ঘরগুলোতে সেই আলো যাওয়ার খুব একটা পথ পায় না। তবে একদম পূর্বদিকে দোতলা যে বস্তিটা দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথায় আলো পড়েছে। অন্য বস্তিদের পাশে বেশ একটা ইয়ার্কি মারছে যেন।

চারদিকে যে গাছগুলো আছে, সেগুলোর কোনো কোনো অংশে আলো পড়েছে। মনে হয় সবুজ আলো। কোথাও সে আলোর সঙ্গে মিশে গেছে হলদে আভা। নারকেল গাছের ওপর যে আলো পড়েছে, সেই আলো চিরল চিরল। আর দেবদারু গাছের আলোগুলো যেন অনেক উপরে উঠে আকাশ ছুঁয়ে নেবে। প্রতিটি গাছের মধ্যে এই সন্ধ্যার আলো ওই গাছগুলোর মতো হয়ে উঠেছে। এও কী সম্ভব! আলোর তো কোনো গড়ন নেই। আলোর রং আছে। সেই রঙ আমরা দেখতে পাই না। কারণ ওই রঙের কোনো আশ্রয় নেই। আশ্রয় ছাড়া কি কোনো আলোর রং হয়? হয় না।

আলো কোথাও পড়তে হবে, কোথাও না কোথাও পড়তে হবে; তবেই তো রং। রং তো আর এমনিতে এমনিতে হয় না। আকাশ ভরাই তো আলো আছে। আমরা কি সেই আলোর রং দেখতে পাই? না, পাই না। এজন্য যে, ওখানে আলোর কোনো আশ্রয় নেই। ওখানে আলো কোথাও পড়ে না। ওখানে আলো শুধু আশ্রয়ের জন্য উড়ে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু যখনই আলো পৃথিবীতে এসে আশ্রয় নেয়, তখন ওই বস্তুর রং সে ধারণ করে। কিংবা বলা যায়, আলো থেকে রং নিয়ে ওই বস্তু, ওই প্রাণী, ওই উদ্ভিদ, বৃক্ষ, বিটপী, মরুত রঙিন হয়ে ওঠে।

এই সন্ধ্যায় আমি দেখতে পাচ্ছি, সৌধগুলো আলোকময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই আলো কী রং ওদের দিয়েছে, সেটা খুব স্পষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ এই সৌধগুলো সন্ধ্যার আলোর প্রভাবে কেমন একটা রঙ ধারণ করে নিয়েছে,  খুব মায়াবী, খুব নরম, একদম আদুরে।

পূর্বদিকের বৃক্ষগুলোতে খুব ভোরে যে পাখিগুলো দেখেছিলাম, উদীয়মান সূর্যের আলোক রশ্মিতে যাদের পালকগুলো ঝলমল করে উঠত, সেই পাখিগুলো এখনও আকাশে উড়ছে। এই বিকেল বেলায় ওদের সেই ওড়াটা সকালের মতো অফুরন্ত প্রাণের কোলাহলে উচ্ছ্বল নয়। প্রাণভারে আলো পান করার যে উৎসবে ওরা সকালের আকাশটাকে উৎসবমুখর করে তুলেছিল, এখন আর সেই উৎসব নেই।  সারাদিন শেষে ওদের শরীরে মনে হয় ক্লান্তি এসেছে।

এরপরও আকাশের অনেক দূর উপরে উঠে গিয়ে একটি অসাধারণ ছন্দময় ঘূর্ণন শেষে ওরা যখন নিচে নেমে আসে, তখন মনে হয়, এই দৃশ্য যারা না দেখেছেন, তাদের জীবনে একটি দেখা বাকি আছে। তারপর বিচ্ছিন্নভাবে যখন ওরা গাছগুলোতে, ঝোপঝাড়গুলোতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে, সেই যাওয়ার মধ্যে না আছে ছন্দ, না আছে তাল-লয়-সংগীত। কিন্তু রং আছে। সেই রং উদীয়মান সূর্যের আলোয় উড়ে বেড়ানোর রং নয়। সেই রং অন্ধকারের দিকে চলা আলোর রং।

সারাদিনের রোদের গন্ধ ওদের শরীরে নিশ্চয়ই লেগে আছে। আজ রাত পর্যন্ত সেই গন্ধ, সেই উষ্ণতা আর সেই আরাম নিয়ে ওরা হয়তো ভালোই থাকবে। কিন্তু শত শত কপোত কপোতিদের তো এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। ঘরে ফেরার এই সন্ধ্যায় তারা গেল কোথায়? কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে। দলবদ্ধভাবে নয়। বলাকার মতো পুষ্পমালার গ্রন্থনের মতো নয়। বিচ্ছিন্নভাবে একাকী তারা এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বস্তিটার উপর যে খোলা জায়গাটুকু আছে, যেখানে কোনো উঁচু অট্টালিকা নেই, যেখানে বিদ্যুতের কোনো খাম নেই, সামান্যতম কোনো প্রতিবন্ধকতা যেখানে নেই, সেই খোলা জায়গাটার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কপোত-কপোতির দল। শুধু তারা একা নয়; এখানে কাক আছে, শালিক আছে, কোথা থেকে যেন কয়েকটি সাদা বক উড়ে গেল ঝোপজারের দিকে। এরা এলো কোথা থেকে? সম্ভবত পাশে যে একটি খাল আছে, জঘন্য নোংরা খাল, ওখানে কী মাছ আছে? জানি না, থাকতেও পারে।

বকগুলো কী ওই নোংরা জলে মাছ শিকার করে? হয়তো করে কিংবা করে না।  কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আমার এই বাসার পাশে বিশাল যে বস্তিটা আছে, ঠিক তার মাঝখানে একটি ছোট্ট পুকুর আছে। সেই পুকুরের অনেকটা অংশ নিয়ে বাঁশের মাচানের উপর রিক্সা গ্যারেজ। আর তার নিচে স্বচ্ছতোয়া জলের একটি পুকুর। পুকুরটিতে মাছ চাষ হয়। এই পুকুরে কোনো ময়লা-আর্বজনা ফেলা হয় না। হতদরিদ্র রিকসা চালক, মুদির দোকানদার, ভিখারি, গার্মেন্টস কর্মী, হকার, বাসের হেলপার, টেম্পুর হেলপার আর উদ্বাস্তুদের ঘিরে এই যে বস্তি, সেই মানুষগুলো কী করে পুকুরটিকে এমন স্বচ্ছতোয়া জল করে রেখেছে, তা আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে।

এখানে কি বকেরা বাস করে? জানি না। এইসব ভাবতে ভাবতে এখন দেখছি সূর্য যতই অস্ত যাচ্ছে, তার আলো ততই উপরের দিকে উঠছে। গাছগুলো থেকে আলো সরে যাচ্ছে। এখন শুধু উঁচু সৌধগুলোর মাথায় আলো পড়ছে। সেখানেও এতক্ষণ যে ঔজ্জ্বল্য ছিল, তা কমে গেছে। এক ধরনের ম্লানিমা যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। ওই আকাশের নিচের পৃথিবীটাকে আমার খুব ভালো লাগে।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ