সরকার আবদুল মান্নানের গল্প ‘আগুন নিয়ে খেলা’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪
আগুন নিয়ে রিফাতের খুব আগ্রহ। যখন অবুঝ ছিল, তখন কতবার যে আগুনে হাত দিয়েছে রিফাত, তার হিসেব নেই। প্রথমে তার ডান হাতের দুটি আঙুল সামান্য পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে ওর আক্কেল হয়নি। তবে আক্কেল একেবারে যে হয়নি, তা নয়। এখনও রিফাত আগুনে হাত দেয়। কিন্তু দ্রুত হাত সরিয়েও নিয়ে আসে। এ যেন ওর এক খেলা। রিফাতের কাছে মনে হয়, আগুন একটা আজব জিনিস। তরল না, কঠিন না। কিছুই না। কিন্তু তেজ কত মারাত্মক। সব কিছু পুড়ে ফেলে। ছাই করে ফেলে। কী আছে আগুনের মধ্যে? কী দিয়ে আগুন এমন করতে পারে?
ফোরে পড়ে রিফাত। কিন্তু পড়বে কী? এত কৌতূহল নিয়ে কি পড়া এগোয়? এগোয় না। ফারাবি ওর চাচাতো ভাই। পড়ে সিক্সে। এই ফারাবির সঙ্গেই ওর যত খাতির। আর রাজ্যের সব প্রশ্নও ফারাবির কাছে। এরও কারণ আছে। মাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল রিফাত, মা আগুন কী দিয়ে তৈরি?
এমন আজব প্রশ্নের জন্য মা একদম প্রস্তুত ছিল না। বলল, আগুন আবার কী দিয়ে তৈরি? আগুন কি পায়েস যে চাউলের গুড়া, দুধ আর চিনি দিয়ে তৈয়ার অইব?
কিন্তু এমন অদ্ভুত উত্তরের পরও রিফাত দমে যায়নি। ‘তয় কও কী দিয়ে তৈরি?’
মা খুবই বিরক্ত হয়। বলে তোর মাতা দিয়া তৈরি? মাইরা কিছু রাখতাম না, বুঝলি? পড়ার বেলায় ঠনঠন, আর ফালতু কতার বেলায় উস্তাদ। যা আমার সামনে থিকা।
মাকে এই সব প্রশ্ন করা নিরাপদ নয় ভেবে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ে রিফাত। বাবাকেও একবার প্রশ্ন করে বকা খেয়েছিল রিফাত। জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা বাবা, বাতাস তো গায়ে লাগে। পাতা নড়ে। ঝড়ের সময় তো গাছপালা বাড়ি-ঘর ভেঙেই ফেলে। কিন্তু দেখা যায় না কেন?
বাবা ভাবে, বাতাস দেখা যায় না। দেখা যায় না বলেই দেখা যায় না। এটা আবার প্রশ্ন হলো নাকি? বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, বাতাস দেখন দিয়া তোর কী কাম? বাতাস দেখা না গেলে কি কোনো সমস্যা আছে? এই সব আজব চিন্তা বাদ দিয়া পড় গা।
সুতরাং ফারাবিই ওর একমাত্র অবলম্বন। যত প্রশ্ন, কৌতুক-কৌতূহল সব ফারাবির কাছে।
আচ্ছা ফারাবি ভাইয়া, আগুন কী দিয়া তৈয়ার হয় বলতে পারবা?
ফারাবি হলো সবজান্তা। অন্যের কাছে না-হোক, রিফাতের কাছে সেই তাই। রিফাতের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে ফারাবির। না-হলে ছোট ভাইয়ের কাছে মান-মর্যাদা থাকে কীভাবে। সুতরাং তার উত্তর ভুল কি শুদ্ধ, সেটা কোনো বিষয় নয়। উত্তর একটা হলেই হলো। আর ভুল-শুদ্ধ নিয়ে রিফাতেরও কোনো চিন্তা নেই। ফারাবি যে প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয়, সম্মান করে এতেই ওর আনন্দ।
রিফাতের প্রশ্ন শুনে ফারাবি হাসে। বলে, সহজ। একদম সহজ। সব কিছু দিয়াই আগুন তৈয়ার হয়। কাঠ দিয়া, খড়কুটা দিয়া, লতাপাতা দিয়া, কেরাসিন দিয়া। শুধু পানি দিয়া আগুন তৈয়ার হয় না। পানি অইল আগুনের শত্রু।
রিফাত খুশি হয়। ‘তাই তো! একদম সহজ। আমি কেন বুঝতে পারলাম না?’
কিন্তু তার পরও কোথায় যেন রিফাতের মনে একটা সন্দেহ আছে। কাঠে আগুন ধরে, এ কথা ঠিক। কিন্তু ধরার পরে যে আগুনটা দেখা যায়, সেটা কী? কী দিয়ে তৈরি? এইসব ভাবে রিফাত।
প্রতিবেশি সবুজ পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফিজিস্কে। অনেক দিন পরে বাড়ি এসেছে সবুজ। রিফাতকে খুব আদর করে। সুযোগ বুঝে এক সময় রিফাত জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা সবুজ ভাইয়া, কাঠে, কেরোসিনে আগুন ধরে, তাই না?
সবুজ বলে, হা, তাই?
এই আগুন কী দিয়া তৈয়ার হয়, সবুজ ভাইয়া?
খুব সুন্দর প্রশ্ন। তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। প্রশ্নটা একটু কঠিন রে ফারাবি।
আচ্ছা সবুজ ভাইয়া আমার মাথায় অনেক বুদ্ধি অইল ক্যামনে? আমি তো প্রশ্ন করি। উত্তর তো জানি না।
সবুজ বলল, প্রশ্ন করতেও বুদ্ধি লাগে। বুঝলি? তুই যে প্রশ্নটা করলি, এটা হলো বুদ্ধির প্রশ্ন। প্রশ্নটা সহজ না। কঠিন। উত্তরটাও কঠিন।
একটু চিন্তা করে নিয়ে সবুজ বলে, তুই যে বললি, কাঠে-কেরোসিনে আগুন ধরে। তার মানে কাঠের মধ্যে বা কেরোসিনের মধ্যে আগুন ধরার একটা কিছু আছে, তাই না। এই জিনিসটার নাম কার্বন। তা হলে আগুনের একটা উপাদান জানলি, তাই না? বলতো রিফাত জিনিসটার নাম কী?
রিফাত বলল, কার্বন।
কিন্তু কার্বন কী জিনিস, এটা আবার এখন জানতে চাস না। ঠিক আছে?
রিফাত বলল, আচ্ছা ভাইয়া, তুমি শুধু আগুনের কথা কও।
সবুজ খুশি হয়। হাসে। তার পর রিফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, লক্ষ্মী ছেলে। ভেরি গুড। এখন বল, কী দিয়ে আগুন নেভানো যায়?
রিফাত বল, কেন, পা দিয়া চাপ দিলেই আগুন নিভ্যা যায়।’
একদম ঠিক বলেছিস। কোনো কিছু দিয়ে চাপ দিলে আগুন নিভে যায়। তার মানে হলো, আগুনে যদি বাতাস লাগতে না দিস, তা হলে আগুন নিভে যাবে। বাতাসে আছে অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া আগুন হয় না। আরও একটা জিনিস লাগে। সেটার নাম হাইড্রোজেন।
রিফাত কেমন মনে রাখতে পারে তা একটু যাচাই করে নিতে চায় সবুজ। জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা রিফাত, তিনটি বস্তুর কথা আমি বললাম। বল তো দেখি বস্তু তিনটি কী?
রিফাত গড়গড় করে বলে ফেলল, অক্সিজেন, কার্বন আর হাইড্রোজেন।
সবুজ খুব খুশি। বলে, গুড। ভেরি গুড। আর এগুলো একত্র হলে ঝামেলা তৈরি হয়। আর সেখান থেকে তৈরি হয় আগুন। আমি যেটাকে ঝামেলা বললাম, বড় হয়ে জানবি সেটাকে বলে বিক্রিয়া। আগুনের কিন্তু আরও মজার ব্যাপার আছে। জানিস রিফাত?
না ভাইয়া। কী মজার জিনিস আছে, বলো?
সবুজ বলল, রাতে আগুন ধরালে কী হয়?
রিফাত বলল, আলো হয়। অন্ধকার দূর হয়।
সবুজ খুব খুশি। বলল, এই হলো আমাদের বুদ্ধিমান রিফাত। তুই একদম ঠিক বলেছিস। আগুনের একটা অংশ আছে সেটা দিয়ে সে শুধু পোড়ায়। তোর ডান হাতের আঙ্ল পুড়ে গিয়েছিল না, রিফাত?
হা ভাইয়া। খুব জ্বলেছে। অনেক কষ্ট পাইছি।
ঠিক। তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিলি। এটা কিন্তু আগুনের দোষ ছিল না। তুই হাত দিয়েছিলি বলেই আগুন তোকে কষ্ট দিয়েছে। সেই কষ্টের কথা এখনো তোর মনে আছে। কিন্তু আগুন দিয়ে প্রতিদিন যে রান্নাবান্না হচ্ছে, মজার মজার খাবার তৈরি হচ্ছে, সেটা কি মনে রাখিস?
রিফাত যেন নতুন একটা জগতের সঙ্গে পরিচিত হলো। বলল,ঠিক বলেছ ভাইয়া। আগুন যেমন আলো দেয়, তেমনি সুস্বাদু খাবারও দেয়।
একদম ঠিক বলেছিস রিফাত। আমার সঙ্গে আয়, তোকে আরেকটা মজার ঘটনা দেখাই।
রিফাত মহা কৌতূহল নিয়ে সবুজের পিছু নিল। সবুজ রিফাতকে একটি জানালার কাছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো কী?
রিফাত বলল লোহার সিক।
ভেরি গুড। দেখ, ওই শিকগুলোতে মরিচা ধরেছে। তার মানে শিকগুলো পুড়েছে।
রিফাত তাজ্জব হয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল, বলো কী ভাইয়া? এখানেও আগুন আছে?
সবুজ বলল, তুই ঠিক ধরেছিস। এখানেও আগুন আছে। এই আগুনের আলো নেই। কিন্তু তাপ আছে।
রিফাত বলল, কী যে বল ভাইয়া? কোথায় তাপ? আমাদের হাতে তো লাগে না?
রিফাত, তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের হাতে লাগে না। কারণ এই তাপ খুবই কম। এত কম তাপ যে, আমরা হাত দিয়ে অনুভব করি না। কিন্তু অনেক দিন ধরে পুড়তে পুড়তে এক সময় দেখবি কঠিন লোহাটি ঝুড়ঝুড়ে হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রং দিয়ে যদি বাতাস লাগতে দেওয়া না-হয়, তা হলে আর পুড়বে না। মরিচাও ধরবে না।
রিফাত খুব খুশি। আর খুব অবাক। সবুজ ভাই কত জানে! এত কিছু জানে কী করে? জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ভাইয়া, তুমি এত কিছু জান ক্যামনে?
আমি যে অনেক বড় হয়েছি তাই। আর অনেক বড় ক্লাসে পড়ি। তুই যখন বড় হবি আর অনেক পড়বি তখন তুইও অনেক কিছু জানতে পারবি। আমার চেয়েও অনেক বেশি।
ঠিক বলেছ ভাইয়া। আমিও তোমার মতো বড় হব। অনেক পড়ব।
নিশ্চয়ই। তবে আরও কথা আছে। সেটা কী জানিস?
রিফাত বলল, কোন কথা?
সবুজ বলল, আগুন আমাদের অনেক উপকার করে, তাই? কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে হয় না। কেন, জানিস?
হা ভাইয়া। আগুন লইয়া খেললে আমাদের অনেক ক্ষতি হইতে পারে। গায়ে আগুন ধরে যেতে পারে। বাড়ি-ঘরে আগুন ধরে যেতে পারে।
তুই অনেক বুদ্ধিমন ছেলে রিফাত। তুই অনেক বড় হবি।