সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রৌদ্রস্নাত স্কুল’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০২৩

স্কুল সংলগ্ন বাজার। উত্তর দিকে। বিশাল বাজার। স্কুলের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি দক্ষিণে কোথায় চলে গিয়েছে সেই রাস্তাটিই বাজারের মাঝ দিয়ে উত্তর দিকে ফরাজিকান্দী হয়ে নিরুদ্দেশ। বাজারে ঢুকার আগেই ওই রাস্তাটির একটি অংশ চলে গেছে আমাদের গ্রামের দিকে।

 

আমাদের গ্রামের দিকে বললাম বটে, কিন্তু বিষয় ওরকম নয়। পাড়াবেড়ানো মহিলাদের মতো এই রাস্তাটি টো টো করে বেড়িয়েছে নানা দিকে। ওই নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো ওই বাজারটিকে। ঢুকতেই বিশাল একটি বটগাছের নিচে বাজারের দক্ষিণ অংশ।

 

তারপর দুই রাস্তার উভয় দিকে চার সারি দোকানের এই বাজরটি রহস্যের আকর। বাজার বলে যে খুব হৈচৈ ছিল তা কিন্তু নয়, বিস্তৃত বাজারটিতে এক ধরনের নির্জনতা ছিল, মনে হতো চুপিসারে কোলাহলের বিস্তৃত পরিসর।

 

প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, তা নয় বরং বিস্মিত ও হতাশই হয়েছিলাম। বিশাল দীঘি, দীঘির পার ঘেষে প্রশস্ত ভূমি, তার পাশে স্কুল আর সেই স্কুলের পেছনে ফসরের বিস্তৃত মাঠ এবং চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ- কত রকমের ফলের গাছ যে তাদের সকল দক্ষিণা আমাদের জন্য উজার করে বিছিয়ে রেখেছিল, সেই সানকিভাঙ্গা প্রইমারি স্কুল থেকে এই স্কুলে গিয়ে হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

 

দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত খালের মোড়টি ঘেষে চরকালিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনে হলো স্কুলটি খুব অভিমান করে বাজারের সঙ্গে আড়ি দিয়ে সে পুবে-পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে বাজরটিকে পিছনে ফেলে। দক্ষিণমুখো স্কুলটি বন্ধ করে দিয়েছে বাজারে আলো-বাতাস ঢুকার সব পথ। প্রথমে দেখে তাকে আমার স্কুল মনে হতো না, মনে হতো যেন বাজারেরই একটি আলাদা অংশ। যেন বাজারের জায়গা ছেড়ে দিয়ে স্কুল বানানো হয়েছে। বাজারটির নাম গৌরাঙ্গ বাজার। কিন্তু চরকালিয়া বাজার বলেই আমি চিনতাম।

 

বাজারে কোলাহল হয়, স্কুলেও কোলাহল হয়। কিন্তু দুই কোলাহল কি এক? নিশ্চয়ই নয়। বাজারের কোলাহল প্রয়োজনের, স্বার্থের, দরদামের, কেনাকাটার এবং কোলাহল যারা করেন তারা পৃথিবীর অনেক কিছু বুঝে শেষ করেছেন। তারা অধিকাংশই সংসারী, গৃহী- প্রবীণ। আর স্কুলের কোলাহল নতুন প্রাণের। ওই কোলাহল নরম কণ্ঠে মধুর। ওই কোলাহলের অন্তরে আলোর হাতছানি।

 

ঘণ্টা পড়ে যখন ক্লাস শুরু হয় তখন জ্ঞান দানকারী শিক্ষকের কণ্ঠ সবার উপরে। শিক্ষার্থীরা গুরুর সামনে বিনম্র ও বিনয়বাচনে সলজ্জ। পুরো স্কুল জুড়ে তখন মধুর নির্জনতার ভেতরে বিদ্যাচর্চার বেহাগ ধ্বনি। তার মধ্যে বাজারের বিচিত্র শব্দে ছন্দপতন।

 

ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠলে অন্য রকম কোলাহলে মুহূর্তের মধ্যে স্কুল প্রাঙ্গণটি মুখর হয়ে ওঠে। ক্লাস চলার নির্জনতার সুযোগে ওই দিকে তখন বাজারের শব্দ প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতি আপনা থেকে কিছু নিরাময় তৈরি করে। ওই নিরাময় তৈরি না হলে মানুষ কেন, কোনো কিছুই টিকত না। আর তা হলো ভেতরগত ঐক্য ও সংহতি। ওই ঐক্য ও সংহতির জন্য শেষ পর্যন্ত বাজার ও স্কুলের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটে এবং তৈরি হয় বন্ধুত্ব।

 

শত বছর ধরে চরকালিয়া বাজার ও স্কুলের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন বিরাজমান আছে। যদি তা না হতো তা হলে হয় উঠে যেতে হতো বাজার অথবা স্কুল। কিন্তু কোনোটিই উঠে যায়নি। দুটিই টিকে আছে প্রবলভাবে। অধিকন্তু সমৃদ্ধি ঘটেছে স্কুলের এবং উন্নয়ন ঘটেছে বাজারের। চলবে