সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রৌদ্রস্নাত স্কুল’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২৩

আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। আবার একদম খারাপও ছিলাম না। আমার বাবা আমাকে ভর্তি করে দিলেন আমাদের অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে, নাম চরকালিয়া উচ্চবিদ্যালয়। ওখানে শিক্ষকতা করতেন আমাদের পাশের গ্রাম সানকিভাঙ্গা সরদার বাড়ির এক বড় ভাই খায়ের স্যার। তিনি হয়তো বাবাকে বলেছেন যে, তার সঙ্গে যাব-আসব, কোনো অসুবিধা হবে না এবং এমনও আশ্বাস দিয়ে থাকতে পারেন যে, ওই স্কুলে আমি ফুল ফ্রি পড়াশোনা করতে পারব। কারণ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমাদের পরিবারের খুব পরিচিত বিভূতিভূষণ স্যার। এসবের কিছুই আমি জানি না এবং কখনো জানতে পারিনি।

 

আমাকে চরকালিয়া স্কুলে যেতে হবে। আমি বেশ আনন্দেই আছি। হাইস্কুলে পড়তে যাচ্ছি। একটু ভাবসাবও হয়েছে। প্রথম দিনই খায়ের স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। তিনি আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই চরকালিয়া যেতেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। শীতের সকাল। কুয়াশা এখনো আছে। তবে রোদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে খুব অনিচ্ছায় ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। তার মধ্যেই নানা কাজে বেরিয়ে গেছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে কৃষক ও খেত-খামারের শ্রমিকগণ। দীর্ঘ ফসলের মাঠ অতিক্রম করে এই আমার প্রথম কোনো স্কুলে যাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অপরিচিত জনপদে।

 

অবশ্য এর আগে ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাসখানেক আগে কোনো এক সকালে ফরাজিকান্দীর এই বিলে একবার এসেছিলাম। আমি একা নই। অনেক গ্রামের অনেক লোক এসেছিল। ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এখলাসপুর আমবাগান বরাবর মেঘনায় পাকিস্তানি রসদ ও অস্ত্রবাহী জাহাজ এম.ভি. স্বামী, এবং ৭ই নভেম্বর এখলাসপুর বাজারের কাছে খালের মুখে নোঙর করা জাহাজ এম.ভি. লিলি (পরবর্তীতে বেঙ্গল ওয়াটার) ধ্বংস করে দেয় মুক্তিযোদ্ধাগণ। এবং এই নৌপথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াত ও রসদ পরিবহন বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। ১১ই নভেম্বর এখলাসপুর মোহনায় পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের এমভি সোবান এবং এমভি গফুর নামক দুটি জাহাজ মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে ডুবিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।

 

আমাদের বাড়িব অদূরে এখলাসপুরের সীমানায় মেঘনা নদীতে ঘটে ওই ঘটনা। হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের অনেকের সলিল-সামাধি ঘটে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতরিয়ে তীরে এসে ওঠে এবং মুক্তিবাহিনী ও এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়ে। তাদের বেশ কয়েকজনকে জড় করা হয়েছিল ফরাজিকান্দীর এই ফসলের মাঠে। তাদের দেখতে গ্রামের মানুষ দলে দলে এসেছিল এখানে। অনেকের সঙ্গে আমিও এসেছিলাম। তারপর ১৯৭৩ সালের দিকে বিজয় উৎসব ও বিজয়মেলা হওয়ার কথা ছিল এই চরকালিয়া স্কুলে। অনেক শিশুর সঙ্গে আমিও মেলায় আসার জন্য নমজহিরাবাদ (ফসলের মাঠের পূর্ব-পশ্চিমে দুটি গ্রাম। মুসলমানদের জন্য পশ্চিমের গ্রাম দুটির নাম সানকীভাঙ্গা ও জহিরাবাদ এবং ফসলের মাঠ পেরিয়ে পূর্বদিকে বাস করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

 

তাদের গ্রামের নাম নমসানকীভাঙ্গা ও নমজহিরাবাদ) পর্যন্ত অতিক্রম করেছিলাম। কিন্তু কয়েকজন যুবক আমাদের আটকে দেয়। ওরা আমাদের মেলায় যেতে দেয়নি। তাদের হাতে ছিল বস্তায় মোড়ানো অস্ত্র। ওগুলো বের করে আমাদের দেখিয়েছিল। বলেছিল, “কোনো অনুষ্ঠান হবে না, মেলা হবে না। বাড়িতে চলে যাও। ফের যদি আসো, একদম মেরে ফেলব।” আমরা যে খুব একটা ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। কারণ ওইসব অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বরং একটা চাকু দেখালে আমরা অনেক বেশি ভয় পেতাম- বিশেষ করে বুতাম টিপলে খাপ থেকে দুই-তিনটা চাকু বেরিয়ে পড়ে- এমন। আমাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমনের ওইডার মধ্যে কী?” ওরা কোনো উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে ফরাজিকান্দীর দিকে রওয়ানা দেয়। আমরাও বাড়িতে চলে আসি। বিজয় উৎসব হয়নি। মেলাও হয়নি। পরে জেনেছি, ওরা ছিল জাসদের লোক।

 

ঠাকুরপাড়া-ফরাজিকান্দী সীমানার খালের উপর ছিল একটি কাঠের পুল। এখানে আমি বহুবার এসেছি। ওই খালটা যেমন রহস্যময় ছিল, পুলটাও ছিল সম্মোহনের মতো ভয় আর আকর্ষণের এক যুগল ডাকিনী। এতবড় কাঠের পুল এই এলাকায় আর কোথাও ছিল না। মাঝেমধ্যে পাটাতন ছিল না- ফাঁকা । খুব ভয়ে ভয়ে সতর্কতার সঙ্গে পার হতে হতো। তারপরেও কেন যে বারবার ওই পুলটা পার হতে ইচ্ছে হতো, তার রহস্য আজও উদঘাটন করতে পারিনি। আমার উচ্চতাভীতি আছে। চিরকালই ছিল। ওই পুলটা ছিল খুব উঁচু। বিশেষ করে শীতকালে খালের পানি যখন কমে যেত তখন পুলটিকে মনে হতো আকাশ সমান উঁচু। উঁচু ঠিক আছে, তো নিচে তাকানোর দরকার কি? সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা পার হয়ে গেলেই তো হয়। কিন্তু না। পুলের মাঝে গিয়ে নিচে তাকানো খুব জরুরি হয়ে পড়ত। বার বার নিচে তাকিয়ে ভয়ের আনন্দটা বেশ উপভোগ করে খাল পার হতাম।

 

খাল পার হয়ে ঢুকে যেতে হতো বিপুল বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত একটি নির্জন রাস্তায়। ওই মনোরম পথটুকু হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগত। গাছের ফাঁকফোকর গলিয়ে যে আলোটুকু রাস্তায় এসে পড়ত তার আলো-আঁধারে কত নকশা, কত ছবি, কত চিত্রকলা যে তৈরি করত, তার ইয়ত্তা ছিল না। আলো-আঁধারের ওইসব চিত্রকলার মধ্যে আবার সামান্য বাতাসেই সৃষ্টি হতো কম্পন। রাস্তার উপরে ছড়িয়ে থাকা আলোর সিকি-আদলি মাড়িয়ে মাড়িয়ে, হাতি-ঘোড়ার লেজে মাথায় বুকে পিঠে পা দিয়ে দিয়ে অতিক্রম করে যেতাম ওই নির্জন জনপদ। সকালের ছড়িয়ে থাকা মিষ্টি আলো, ঝলমলে রোদ আর শীতের তিরতিরে বাতাস এবং ওই বাতাসে কম্পন রেখে কিছু প্রজাপতি কেন এই রাস্তার আলো-আঁধারে টইটই করে বেড়াত তার কারণ বুঝতাম না। মাঝেমধ্যে ওরা আমার পিছু নিত। আজব! কই আমি ওদের পিছু নেবো, না ওলটো ওরা আমার পিছু নেয়। ওদের এই সঙ্গ আমি কিন্তু স্বপ্নে দেখিনি। সত্যি ছিল। চলবে