সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রস’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০২৫

আমাদের বাড়িতে আট-দশটি খেজুর গাছ ছিল। সবগুলোই ছিল পুকুরের পাড়ে, খালের পাড়ে। এই গাছগুলো লাগানো হয়েছিল রসের জন্য। আমার মনে হয়, এদেশে কেউই ফলের জন্য খেজুর গাছ লাগায় না। পাঁচটি  ঋতু জুড়ে খেজুর গাছগুলো খুব অযত্নে থাকত। তখন পাখির পালকের মতো পাতা দিয়ে খেজুর গাছগুলো আচ্ছন্ন হয়ে যেত। গাছগুলোর মধ্যে একটিমাত্র ছিল মেয়ে, বাকিগুলো পুরুষ। মেয়ে গাছটির তেমন কোনো যত্নআত্তি ছিল না। ওই গাছটিতে চৈত্র মাসে ফুল ফুটত। দু’রকমের ফুল: সাদা ও লালচে। পরে জেনেছি, সাদা ফুলগুলো পুরুষ এবং লালচে ফুলগুলো মেয়ে ফুল। গ্রীষ্মকালে ফল হতো। পাকা খেজুর আমাদের খুব প্রিয় ছিল। খেজুরের আঁটি নিয়ে আমরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতাম। কারণ, হলুদ রঙের আঁটিগুলোতে হলুদ কিংবা খয়েরি রঙের ফলগুলোর ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখার মতো ছিল।

কার্তিক মাসের শুরুতেই জয়নাল কাকুর আগমন ঘটে। হেংলা-পাতলা লম্বা একটি হেঁজিপেঁজি লোক। গায়ে-গতরে মাংস নেই বললেই চলে। তদুপরি গালের মাংস ভেতরে ঢুকে গিয়ে দুই গালে দুটি গর্ত তৈরি করেছে। ওই গর্তের হাড় উচিয়ে থাকাতে মুখের উপর একটি কলো ছায়া চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে গিয়েছে। তাই প্রথম দেখলেই মনে হয়, রসকষহীন বদমেজাজি টাইপের মানুষ। মাথার পাতলা চুল ঘাড় পর্যন্ত প্রলম্বিত। তেল দিয়ে চুবচুবে সেই চুল আবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা থাকে সারাক্ষণ। এই আজব কিসিমের লোকটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল।  

জয়নাল কাকু খেজুরগাছগুলো পর্যবেক্ষণ করে। আমরা তখন থেকেই তার পেছনে পেছনে ঘুরতে শুরু করতাম। সে আমাদের তাড়ানোর জন্য বলত, যা যা, গাছ পরিষ্কার করুম। রস আইতে দেরি আছে। কিন্তু কাকু বুঝেও বুঝতে চাইত না যে, আমরা শুধু রসের লোভেই কাকুর পিছনে পিছনে ঘুরি না; কাকু কীভাবে গাছ কাটে, কীভাবে নলি বসায়, কলস ঝুলানোর জন্য কয়টি পেরেক কোপে, আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে এসব দেখি।

নাসিমা একদিন কাকুকে বলে, আচ্ছা কাকু, আমনে যে গাছটা কাডেন, এইডায় কষ্ট পায় না?
জয়নাল কাকু ছিল একটু দার্শনিক টাইপের লোক। সুযোগ পেলেই বেশ আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলত। নাসিমার মতো দয়ালু কাউকে পেলে তো কথাই নেই। নাসিমার কথা শুনে সে কতক্ষণের জন্য চুপ হয়ে থাকল। মনে মনে কী যেন ভাবছিল। তারপর মুখের অবয়বে একটা করুণ ভাব নিয়ে বলল, হরে মা, তুই ঠিকই কইছস। কষ্ট তো পায়ই। কিন্তু কী করমু ক! না খোঁচাইলে কেউ কি রস দেয়? দেয় না। আমরা কত কিছু খাই, খাই না ক? মাছ খাই, গোস্ত খাই, শাকসবজি খাই, তরিতরকারি খাই। সবকিছুই তো কাটতে হয়; তাই নারে মা! না কাইটা, রান্না না কইরা অনেক কিছুই তো আমরা খাইতে পারি না। এই দুনিয়ার নিয়মই এই রকম। একজন আরেকজনের খায়। কষ্ট তো পায় রে মা! কেউ কষ্ট পায়, আর কেউ ক্ষুধা মিটায়। এই দুনিয়ার খেলা।

নাসিমা কী বুঝল, জানি না। কিন্তু বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। নাসিমাকে দেখে মনে হলো, আমাদেরও গম্ভীর হওয়া দরকার। আমরাও তাই গম্ভীর হয়ে গেলাম। জয়নাল কাকুর কথা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের দেখে সে তা বুঝতে পারল এবং বেশ খুশি হলো।

জয়নাল কাকু আবারও খুব ভালো করে একটি গাছ পর্যবেক্ষণ করল। লুঙিতে কোছা দিল। ময়লা ও তেলচিটে যে চাদরটা এতক্ষণ গায়ে জড়ানো ছিল, এখন কাকু সেটা গলায় পেঁচিয়ে নিল। ব্যান্ড থেকে চুলগুলো খুলে টাইট করে ব্যান্ড বসাল। পেছনে তার কলসের মতো দেখতে একটি বেতের ঝুড়ি। ওই ঝুড়ির মধ্যে দুটি কাছি, একটি খুন্তি, পাটের মোটা রসি  এবং আরও কী কী যেন আছে। সে উপরে উঠে গাছের সঙ্গে একটি ছোট বাঁশ বাঁধল। তারপর ওই বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে গাছ থেকে বেশ কিছুটা ফাঁক রেখে নিজেকে রসি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে নিল। তাপরপ শুরু হয় গাছ পরিষ্কারের কাজ।

আমরা শীতে কাঁপছিলাম। কিন্তু জয়নাল কাকুর শীত বলে কিছু নেই। তার মনের মধ্যে কী একটা আনন্দ বিরাজ করছিল।

খেজুর গাছের কোনো ডালপালা নেই, শাখা-প্রশাখা নেই। কিন্তু মাথায় প্রচুর পাতা জন্মায়। ওই মাথাটার নাম নাকি মাথি। ময়ূরের পালকের মতো পাতা গজাতে গজাতে মাথিটা বেশ জঙ্গলাকৃতি হয়ে ওঠে। জয়নাল কাকু খুব যত্ন করে পরিষ্কার করতে লাগল পুরনো পাতাগুলো।

এ বছর কাকুর নতুন করে গাছ কাটার দরকার নেই। পুরনো কাটার মধ্যেই কাটবে। এ এক বিস্ময়কর ব্যপার। কবার কাটলে বা গাছের ভেতরে কতটা গর্ত হলে নতুন করে গাছ কাটতে হয়, তার কোনো বিদ্যা বই-পুস্তকে আছে কি না আমরা জানি না। কাকুও জানে না। কিন্তু কীভাবে যেন বুঝতে পারে, ওখানটায় আর কাটা যাবে কি যাবে না। আর কোনো গাছি যদি নিজে থেকেই এই বিদ্যাটা বুঝতে না পারে, তা হলে গাছের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক সময় গাছ মরেও যায়। কিন্তু জয়নাল কাকু ওস্তাদ মানুষ। সে গাছ কাটে মমতা দিয়ে। মনে হয়, নিজের শিশুপুত্রের মাথা ন্যাড়া করছে। একটু অসতর্ক হলেই চামড়া কেটে যাবে, রক্ত বের হবে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন সবগুলো খেজুরগাছই ছিল বড়। আমাদের ধারণা ছিল, খেজুর গাছ বড়ই হয়। এই নিয়ে একদিন আবদুল গফুরের সঙ্গে পাশের বাড়ির ময়নার ঝগড়া হয়েছে। গফুর বলেছিল, খাজুর গাছ আবার ছোড দেখলি কবে! খাজুর গাছ তো বড়ই অয়।

ময়না বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, তুই একটা বুদ্দু। ছোড থেকেই তো গাছ বড় অয়। আতকা কইরা কিছু বড় অয়?
গফুর কিছুতেই মানছিল না। সে বলে, কোনোদিন ছোড খাজুর গাছ দেখছস?  দেহাইতে পারবি?

কতগুলো ছোট-বড় গাছ দেখিয়ে দেখিয়ে গফুর বলে, এই দেখ আমগাছ ছোড আছে, বড় আছে, মাঝারি আছে। বরি গাছ ছো বড় মঝারি আছে। সব গাছই ছোড-বড় আছে। ছোড খাজুর গাছ দেহা। আছে? নাই। খাজুর গাছ ছোড অয় না। খাজুর গাছ বড়ই অয়।

ময়নাও ছোট খেজুর গাছ কখনোই দেখেনি। ও বেশ ঝামেলায় পড়ে যায়। অগত্যা ময়না ওর মাকে ডাকে। মা মা হোনেন, দাওত্তাডায় কী কয়!

ঘর থেকে বের হয়ে আসে ময়নার মা। দেখে গফুর। গফুরের মুখের সামনের দাঁতগুলো বড়। বেশ বড়। সারাক্ষণ মুখ থেকে বের হয়ে থাকে। কথা বললেও বের হয়ে থাকে, কথা না বললেও বের হয়ে থাকে। আর হাসলে তো কথাই নেই, দাঁত ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তাই ওর প্রতি কেউ রেগে গেলে নির্দ্বিধায় বলে দাওত্তা। গফুর যে এতে খুব কষ্ট পায়, তা নয়। তবে প্রতিবাদ করে। দাওত্তা কছ কিলিগা, হ্যা? আমার নাম তো গফুর। গফুর কইতে পারস না?

ময়নার মা ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে, গফুরে কী কয়, ময়না?
কয়, খাজুর গাছ নাকি বড়ই অয়, ছোড খাজুর গাছ অয় না।

ময়নার মা ঠিক মনে করতে পারে না, ছোট খেজুর গাছ কোথাও দেখেছে কি না। আবার কখনো দেখলেও এখন আর মনে করতে পারছে না। মনে মনে বলে, ছোড খাজুর গাছ... ছোড খাজুর গাছ... । তার চিন্তার মধ্যে ঝামেলা হয়ে যায়। অগত্যা বলে, আইচ্ছা, অইব অনে, বাদ দে। ময়না ঠিক বুঝতে পারে না যে, কী হবে।

জয়নাল কাকু গাছ কাটা দেখতে দেখতে আমাদের ঘাড় ধরে আসে। কতক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়! কচি নারিকেলের লেইয়ের মতো খেজুর গাছের বাকল নিচে পড়ে। মেরুণ রঙের বাকলগুলো সিক্ত। আমরা ওগুলো টুকিয়ে টুকিয়ে জিহ্বা লাগাই। সামান্য রসের স্বাদ লাগে জিহ্বায়। কাকু উপর থেকে চিৎকার করে বলে, খাইস না, খাইস না, পাখির গু আছে।

আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখি। পাখির গু দেখতে পাই না কোথাও। দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে পাখিরা কেন এখানে মলত্যাগ করতে আসবে, তা আমাদের মাথায় যায় না। তবুও আমরা ওই বাকলগুওলো চাটা বন্ধ করি।

জয়নাল কাকু প্রতিদিনই এসে গাছগুলো হালকা করে ছেচে যায়। রুহুল ভাই রেজরের মধ্যে ব্লেট ভরে যেভাবে সযত্নে সেভ করে, কাকু তেমনি গাছটার ওই বিশেষ অংশ সেভ করে দেয়। আমরাও কাকুর সঙ্গে লেগে থাকি। ইউ আকৃতির বাঁশের একটি ছোট কঞ্চি আধা ইঞ্চি পরিমান ওই কাটা স্থানের একদম নিচে পুরে দেওয়া হয়েছিল। আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, কঞ্চিটি দিয়ে ফোটায় ফোটায় রস পড়ছে। সন্ধ্যার পরপরই কাকু একটি করে হাড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে যায় প্রতিটি গাছে।

শীতের দীর্ঘ রাত ধরে ফোটায় ফোটায় রস পড়ে পড়ে হাড়িটি ভরে উঠবে। সকালে আমাদের প্রত্যেককে এক মগ করে রস খাওয়াবে কাকু। তাই ভোরের আপেক্ষায় আমাদের রাত শেষ হতে চায় না। আসলে কি তাই? মোটেই নয়। অধিকন্তু নিশ্চিদ্র ঘুমের মধ্যেই আমাদের রাত কাটে। তবে খুব ভোরে যখন ঘুম থেকে উঠি, তখন প্রথমেই মনে পড়ে খেজুরের রসের কথা। এক দৌড়ে গাছ তলায় গিয়ে দেখি, জয়নাল কাকু মাটির হাড়িগুলো নামিয়ে নামিয়ে এক জায়গায় জড় করছে। আর আমাদের দেখে বলে, কি রে, রস খাওনের লাইগা রাইতে বুঝি তোগ ঘুম অয় নাই? আমরা রস খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাই। কাকু বলে, ফালাফালি করিস না। একটু স্থির অইয়া বয়। দিতেছি।

কাকু আমাদের প্রত্যেককে এক মগ করে রস দেয়। আমরা খাই আর বলি, কাকু, অনেক মিডা রস। খুব। কাকু খুশি হয়। কিন্তু খুশি হয়ে আরেক মগ দেবে বলে মনে হয় না। কারণ গৃহস্থকে ভাগ দিয়ে যেটুকু রস থাকবে, সেটুকু বাজারে নিয়ে বিক্রি করে তার সংসার চলে। বিনে পয়সায় আমাদের সবটুকু খাইয়ে ফেললে তো আর হবে না।

গাছ কাটার ব্যপারে জয়নাল কাকু ছিলেন খুব দক্ষ। কিন্তু এক্ষেত্রে দক্ষতাটাই যথেষ্ট ছিল না। তার সঙ্গে ছিল মমত্ববোধ। যদি মমত্ববোধ না থাকে, তাহলে দক্ষতা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজটি সম্পাদন করা যেত, কিন্তু তার মধ্যে শিল্পীর ছোঁয়া লাগত না। প্রতি বছর না হলেও এক-দুই বছর পর পর কাটা হয় খেজুর গাছ। সামনে পেছনে, সামনে পেছনে করে করে গাছটিতে যে ধাপগুলো তৈরি হয়, তার মধ্যে সমতা ও ছন্দ তৈরির জন্য দরকার হয় গাছটির প্রতি গাছীর মমত্ববোধ। ফলে এই নির্মম কাজটি করার পরেও গাছটির মধ্যে প্রাণপ্রাচুর্যের অভাব হয় না। আর যদি দক্ষতা না থাকে, মমত্ববোধ না থাকে তাহলে গাছের মারাত্মক রকম ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তার ফলে প্রচুর খেজুর গাছের অকালমৃত্যু ঘটে; আর রুগ্ণ দশায় পরিণত হয় অসংখ্য খেজুর গাছ।

আমরা রাস্তাঘাটে যখন বেরোই তখন দেখি কিছু কিছু খেজুর গাছের মাথা নেই, কোনোটার মাথা বেঁকে গেছে, দেখতে পঙ্গু ও নূব্জ মানুষের মতো দেখায়। এর কারণ হলো গাছি গাছটি এমনভাবে কেটেছে, যাতে করে গাছের মধ্যে বেশ গর্ত হয়ে গিয়েছে এবং গাছটি একসময় প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আবার দেখা যায়, গর্ত এতটাই ভেতরে চলে গেছে যে, গাছটি আর কোনোভাবে কাটার উপযোগী থাকছে না। কিন্তু জয়নাল কাকু এতটাই যত্ন আর মমতা দিয়ে গাছগুলো কাটতেন যে, প্রতিবছরই যেন গাছগুলো অধিকতর সজীব হয়ে উঠত এবং প্রচুর পরিমাণ রস দিত।

কাকু সকালবেলা আমাদের যে রস খেতে দিত, অধিকাংশ সময় তাতে আমাদের তৃষ্ণা মিটত না। তাই সকালের পর থেকে আমরাও গাছে ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল ঝুলিয়ে দিতাম। দিনের ওই রস খেতে বারণ করত সবাই। মাস্ট কাকা কখনো কখনো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। কথা শুনে মনে হতো তিনি ক্লাসে পড়াচ্ছেন। তিনি আমাদের সাবধান করে দিতেন, খবরদার এই রস খাবি না, কাঠবিড়ালী, বুলবুলি, কাক, কাঠঠোকরা খেজুরের হাঁড়িতে, নলে বসে রস খায় আর মলত্যাগ করে; নানা রকমের পোকামাকড়ও বসে। এই রস বিষাক্ত। খেলে অসুখ-বিসুখ হতে পারে। মুড ভালো থাকলে এভাবেই তিনি আমাদের বুঝিয়ে বলতেন। আর মুড খারাপ থাকলে কোনো কথা হতো না; একটি লাঠি নিয়ে সোজা দৌড়ানি দিতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমরা প্রতিদিনই দিনের বেলা ছোটখাটো পাত্র ঝুলিয়ে দিয়ে রস সংগ্রহ করতাম। আর কোনো পাখি এসে বসলে ঢিল ছুড়তাম।

একবার ঢিলের আঘাতে একটি বুলবুলি উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে পাশের পুকুর পাড়ে গিয়ে পড়ে যায়। তাকে ধরে এনে আমাদের উৎসব শুরু হয়। নির্মম সেই উৎসবে এসে হানা দেয় আমাদের এক দাদি। বলে, কি সব্বনাশ কি সব্বনাশ, মাইরা লাইছস? মাইরা লাইছস? বলতে বলেতে দাদি আমাদের তাড়া দিয়ে বুলবুলিটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বুলবুলিটির মাথার ঝুটির মতো ফুলানো পালকের নিচে ঢিল আঘাত হেনেছিল। দাদি ওই জায়গাটিতে কলার ডগার ঠাণ্ডা পানি দিতে লাগল। এছাড়া ব্যাথার কী একটা মলম লাগিয়ে দিয়ে বুলবুলিটাকে সুস্থ করে তোলে দাদি। এই সময় এক পণ্ডিত বকর ভাই দাদিকে বলে, দাদি দাদি আমনে অত চিন্তা কইরেন না, দুইন্যাত অনেক বুবুলি আছে। দুই-একটা মরলে তেমন কমব না। শুনে দাদির মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। একটা লাঠি হাতে নিয়ে দেয় দৌড়ানি। আর বলে, কইতিগা আইছস, গোলামের ভাই গোলম! এইডা মরলে এইডা কি আর আইব?

দাদির প্রতি আমরা খুব বিরক্ত হলেও পরে যখন শুনলাম পাখিটাকে সুস্থ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন খুব ভালো লেগেছিল। দাদির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল।

মা ছিলেন নির্মোহ প্রকৃতির মানুষ। আর দশজন মায়ের মতো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তিনি পুতুপুতু করত না। সোজা জানিয়ে দিত, পাখির গু-মোতের রস খাইলে ভাত নাই। মনে যেন থাকে। মার ওই বাণী মনে না রেখে উপায় ছিল না। কারণ, আমার মায়ের কথা, কথার কথা ছিল না। ভাত নাই, তো নাই-ই। সুতরাং কিছুতেই যেন মা না দেখে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্কতার অন্ত ছিল না। তার পরেও মা দেখে ফেলত যে, আমরা দিনের বেলা খেজুরের রস খাচ্ছি। সেদিন দুপুরে ভাত কপালে জুটতনা। তখন আমাদের আশ্রয় ছিল কয়েক বাড়ি পরে আমাদের একমাত্র ফুফুর বাড়ি। মার সঙ্গে আমাদের এই ফুফুর খুব খাতির ছিল, কিন্তু তার পরেও সে মাকে খুব সমীহ করত। বলা যায় ভয় পেত।

দিনের বেলার খেজুরের রস খাওয়াতে আমাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হতো কি না জানতাম না। কারণ বছর জুড়েই আমাদের পেটের অসুখ লেগে থাকত। ডায়রিয়া, আমাশয়, জর, ঠান্ডা, হাছি-কাশি, গোটাপাঁচড়া ছিল গ্রামীণ জীবনে শিশু-কিশোরদের নিত্যসঙ্গী। ফলে কোন রোগ কী কারণ হতো, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। নিপা ভাইরাসের নামও আমরা শুনিনি এবং খেজুরের রস খেয়ে কেউ নিপা ভাইরাসে আক্রন্ত হয়েছে কিংবা ওই ধরনের কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেছে, এ ধরনের কোনো তথ্যও আমাদের কাছে ছিল না।

প্রায় তিন মাস আমরা নানাভাবে খেজুরের রস খেয়েছি। বিশেষ করে খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস ছিল শীতের নিত্যদিনের খাদ্য। এছাড়া গাঢ় রস মিশানো মুড়ি, চিড়া, খই কী যে মজার ছিল তা আর কী বলব! খেজুরের রসের গুড় দিয়ে তৈরি ভাঁপা পিঠা ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। বিশেষ করে পিঠার যে অংশে গুড় থাকত সে অংশটুকু আগে খেয়ে নিতাম। বাকি অংশটুকু আর খেতে ইচ্ছা হতো না।

জয়নাল কাকুর জন্য শীতের এই দিনগুলো যে সব সময় আনন্দের হতো তা নয়। বেশ বিষাদেরও হতো। আমাদের বাড়িতে যারা স্কুল-কলেজে পড়ত বা পড়ত না, সে সব যুবকেরা এলাকার লোকজনদের খুব জ্বালাত। তাদের অপকর্মের অনেকগুলোর মধ্যে একটি ছিল চুরি করা। তারা চুরি করত ডাব, নারিকেল, পাকা আম, পেঁপেসহ নানা রকম ফলফলাদি। শীতকালে চুরি করত খেজুরের রস। মাঝরাতে গাছে উঠে উঠে রস নামিয়ে নিত এবং হাঁড়িটি যথা স্থানে ঝুলিয়ে আসত। খুব ভোরে রস পাড়তে গিয়ে জয়নাল কাকু দেখত, হাঁড়িতে অতি সামান্য রস আছে। এভাবে কয়েকটি গাছের রস নামাতে গিয়ে যখন দেখত সমস্ত রস চুরি হয়ে গেছে, তখন তার হতাশার অন্ত থাকত না। কখনো কখনো রাগ করে কাকু কয়েকদিন আর গাছ কাটতে আসত না।

আর আমাদে বাড়িব বাইরে কাচারি ঘরে চলত ফিন্নি রান্না করার গোপন কর্মকাণ্ড। এই কর্মকাণ্ডে যে আমাদের বাড়ির কোনো মেয়ের, কোনো ভাবির বা কোনো চাচির অংশগ্রহণ ছিল না, তা বলা যায় না। আর বিষয়টা ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট।  প্রায় সবাই জানে, কিন্তু কেউ জানে না। বাবা জয়নাল কাকুকে ডেকে নিয়ে কয়েক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত, পোলাপাইনের কাজ, কিছু মনে কইর না, রাগ রেখ না। জয়নাল কাকু খুশি হয়ে যেত।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ