সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘ব্যক্তিগত বিনোদন’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০২৪

নব্বইয়ের দশক থেকে রেডিও ও টেলিভিশনের পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব সাধিত হয়। এ সময় ডেক্সটব ও ল্যাপটবের মাধ্যমে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয়। সংস্কৃতিতে ও বাণিজ্যে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। কাছাকাছি-তাৎক্ষণিক যোগাযোগ যেমন: ইলেকট্রনিক মেইল, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল (ভিওআইপি) ফোন কল, দ্বি-মুখী ইন্টারেক্টিভ ভিডিও কল এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবসহ ইন্টারনেট ফোরাম, বøগিং, সামাজিক নেটওয়ার্কিং পরিষেবা এবং অনলাইনে কেনাকাটার ওয়েব সাইটসমূহ আমেরিকা ও পাশ্চাত্য হয়ে আমাদের দেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে।

বর্তমান শতকের শুরু থেকে এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে। ১৯৯২ সালে আমি ছিলাম আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজেরে শিক্ষক। তখন মোহাম্মদ নাসিম সাহেব ছিলেন সেনাবাহিনির গুরুত্বপূর্ণ কোনো সেক্টরের প্রধান। পরে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন। তার সরকারি বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। একদিন দেখি, অপরিচিত একজন লোক হাতে চিকন ইটের মতো একটি রিসিভার নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। রিসিভারটির মাথায় এন্টেনা লাগানো এবং রিসিভারটির একটি লম্বা চৌকো অংশে বোতাম।

নাসিম সাহেবের বড় কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওটা কী? সে বলল, মোবাইল। তারছাড়া টেলিফোন। সব জায়গা থেকে কথা বলা যায়। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ইচ্ছা হয়েছিল, ওই মোবাইলটি দিয়ে কথা বলার। কিন্তু বলিনি। সে হলো আমার প্রথম মোবাইলের নাম শোনা ও দেখা। মটোরোলা ডায়নাটেক কোম্পানির ওই মোবাইল পরে অনেক দেখেছি। সিটি সেল নামের একটি কোম্পানি বাংলাদেশে এই মোবাইল নেটওয়ার্ক শুরু করেছিল। মোবাইলগুলো প্যান্ট বা সার্টের পকেটে ধারণ করা যেত না। হাতে রাখতে হতো। মটোরোলার এই মোবাইল ফোনের ওজন ১৯৭৩ সালে ছিল দুই কেজি। পরে জেনেছি, ১৯৯৩ সালে আমি যে মোবাইলটি দেখেছি ওটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মে মোবাইল।

২০০৩ সালের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমি একটি মোবাইল ফোন নিয়ে আসি। সেটি ছিল মটোরোলা কম্পানির তৃতীয় প্রজন্মের। ওটির মাথায়ও এন্টেনা ছিল। সার্টের পকেটে রাখলে এন্টেনা পকেট গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকত। তাতে নিজেকে বেশ একটা ভাবসাবের লোক মনে হতো। কারণ সে সময় সীমিত নেটওয়ার্কের এবং চড়া মূল্যের মোবাইল খুব কম মানুষের হাতেই দেখা যেত। সিটি সেলের নেটওয়ার্কে কোনো সিম ছিল না- ছিল রিম। মোবাইলের ভেতরে সিল লাগিয়ে দেওয়ার মতো একটি বিষয়। রিম পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ ছিল না। চুরি হয়ে গেলে রিমটি বন্ধ করে দিলেই হতো। শিশুদের খেলনা ছাড়া ওই মোবাইলের আর কোনো কাজ ছিল না।

প্যান্টের পকেটে না রেখে ফুটানি করতে গিয়ে এন্টেনা দেখিয়ে সার্টের পকেটে মোবাইলটি রাখার ফলে শাহবাগে একটি লোক আমার পকেট থেকে মোবাইলটি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। তাকে ফোন করেছিলাম। সে ফোন ধরেও ছিল। আমি তাকে কী বলব! উলটো সেই আমাকে এবং আমার চতুর্দশ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে। অমার অপরাধ হলো, কেন আমি রিম দেওয়া মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়াই। বোতাম টেপা ওই মোবাইল দিয়ে ফোন করা যেত, মেসেজ পাঠানো যেত, গ্রহণ করা যেত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, আপনি ফোন করলে আপনার কাছ থেকে টাকা কাটবে, আবার ফোন ধরলেও টাকা কাটবে। শাঁখের করাত যাকে বলে।

বোতাম টেপা মোবাইলের ইতিহাসে নকিয়া কোম্পানির আবির্ভাব রীতিমতো সাড়াজাগানিয়া। টাচস্কিন মোবাইল বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত নকিয়া কোম্পানির বোতাম টেপা মোবাইলের স্বর্ণযুগ ছিল। তখন ফোন ও মেসেজের মধ্যেই ছিল এই প্রযুক্তির দৌড়। তাতেই আমরা কত খুশি ছিলাম! সে সময় মোবাইলকেন্দ্রিক এমন কোনো বিনোদন ছিলা না যে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। পরে টাচস্ক্রিনের যুগ শুরু হয় এবং নানা রকম এপ্স্ যুক্ত হতে থাকে মোবাইলে। যেমন এদের মধ্যে ইন্টার নেট এবং এর সঙ্গে ফেসবুক, টিকটক, উইচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, লিংকডইন, ওয়েইবো, পাইতু থিয়েপা, কিউজোন ইত্যাদি।

এছাড়া ইউটিউব, টেনসেন্ট কিউকিউ, কুওরা, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগনাল, লাইন, স্ন্যাপচ্যাট, পিন্টারেস্ট, ভাইবার, রেডিট, ডিসকর্ড, ভিকে, মাইক্রোসফট টিমস ইত্যাকার সেবাগুলোও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে নির্দেশ কর যেতে পারে। মোবাইলে ক্যামেরা যুক্ত হওয়ার পর থেকে পিক (পিকচার) ও সেল্ফির এক নতুন জগৎ তৈরি হয়। এ সময় থেকে ব্যবহারকারীরা স্মার্টফোনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সেবায় প্রবেশাধিকার পেতে থাকে। এভাবে ব্যাবহারকারীরা স্মার্টমোবাইলের মাধ্যমে অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় আন্তঃক্রিয়াশীল সব মঞ্চ সৃষ্টি করে, যেখানে ব্যক্তি, স¤প্রদায় ও সংস্থা নিজের সৃষ্ট বা বাছাইকৃত বিষয়বস্তু নেটে ভাগাভাগি করে নেওয়া থেকে শুরু করে একসঙ্গে সৃষ্টি করা, আলোচনা করা, অংশগ্রহণ করা, সম্পাদনা বা পরিবর্তন সাধন করার মতো কাজগুলো সম্পাদন করতে শুরু করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্মৃতি নথিবদ্ধ করে রাখা, বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, নানা বিষয় ঘুরে ঘুরে দেখা, নিজের বিজ্ঞাপন দেওয়া, বন্ধুত্ব তৈরি করা, এবং বøগ, পডকাস্ট, ভিডিও ও ভিডিও খেলা সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন নতুন ধারণার জন্ম ব্যবহারকারীগণ। এছাড়া নিজের বিচিত্র সৃষ্টিকে নেটের দুনিয়ায় সেয়ার করা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগত এমন কোনো অধ্যায় নেই যেখানে স্মার্টফোনের কোনো ভূমিকা নেই। এভাবে আমাদের জীবনের সীমাহীন প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনের অফুরন্ত সময় অতিবাহিত হয় মোবাইল ফোন নিয়ে। চলবে

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ