সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘কাজের বুয়া সমাচার’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম বর্তমানের শিক্ষাক্রমকে কেউ কেউ ‘কাজের বুয়া’ বানানোর শিক্ষাক্রম হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্যের মধ্যে দৃষ্টতা আছে, অজ্ঞতা আছে, মূর্খতা আছে, কর্মের প্রতি তাচ্ছিল্যজ্ঞান আছে। যারা এসব কথা বলছেন এবং এসব কথাকে সমর্থন করছেন, তাদের বলি, সন্তান-সন্ততিদের কাজের ছেলে বা কাজের মেয়ে না বানানোর পরিণতি অনেকেই বুঝেছেন এবং অনেকেই নির্মমভাবে বোঝার অপেক্ষায় থাকুন।

একটা সময় ছিল, সংসারে কাজের ছেলে বা কাজের মেয়ে রাখা দরকার ছিল। দরকারটা এখনো শেষ হয়নি। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ছুটা কাজের ‘বুয়া’ রাখেন। আর যাদের সামর্থ্য আরও বেশি আছে তারা স্থায়ীভাবে কাজের ‘বুয়া’ রাখেন। আপনাদের মতে এরা কেউই কাজের মানুষ নন-  এরা কাজের বুয়া, কামের বেডি। অতি অল্প পারিশ্রমিকে এরা আপনার সংসারের সব কাজ করে দেন। সুতরাং এদের মূল্য তো আপনার কাছে এমনই হবে।

গ্রামে এই সংস্কৃতি ছিল না এবং এখনো নেই। সেখানে ছেলে-মেয়েরাই কাজ করত এবং এখনো করে। আমরা স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ও সংসারের হাজারটা কাজ করেছি। তাতে আমাদের পড়াশুনার ক্ষতি হয়নি, মানসম্মানও যায়নি। এখন অনেক পরিবারে সন্তান-সন্ততিদের সংসারের কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না। নিজে থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস পর্যন্ত কোনো কোনো ছেলেমেয়ের হয় না। এদের মধ্যে কাজ করার বিন্দুমাত্র মানসিকতা তৈরি করার কোনো সুযোগ সংসারে নেই।

খালি পায়ে এদের মাটিতে হাঁটতে দেননি, বৃষ্টিতে ভিজতে দেননি, কাদায় গড়াগড়ি যেতে দেননি, কুয়াশাভেজা ঘাসে হাঁটতে দেননি, সাঁতার কাটতে দেননি, পুকুরে-খালে-বিলে-নদীতে ঝাপ দিতে দেননি, রোদে পুড়তে দেননি। এদের সঙ্গে গ্রামের কোনো সম্পর্ক নেই, প্রকৃতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, আত্মীয়-স্বজনের কোনো সম্পর্ক নেই। এক কথায় ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ কখনো এরা পায়নি। সেই যে কিন্টারগার্টেন থেকে তাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, নিয়ে আসছেন, এখনো তাই করছেন।

স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, নিয়ে আসছেন, কোচিং-এ নিয়ে যাচ্ছেন, নিয়ে আসছেন। প্রাইভেট টিউটরের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, নিয়ে আসছেন। একা তাকে কোথাও ছাড়বেন না। একা ছাড়লে যদি সে পথ হারিয়ে ফেলে, যদি এক্সিডেন্ট হয়, যদি কিডন্যাপ হয়, যদি ধর্ষণের শিকার হয়, বাজে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশে যদি খারাপ হয়ে যায়। এমন এক স্পর্শকাতর দেহ ও মনের মানুষ আমরা তৈরি করছি যারা অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং অল্পতেই কাতর হয়ে পড়ে। ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু বানানোর এই প্রকল্প আমরা অনেকেই গ্রহণ করেছি। একবারও আমরা আমাদের শৈশবের দিকে তাকিয়ে দেখি না যে, আমাদের শৈশব কি এমন করে কেটেছে? নিশ্চয়ই না। তা হলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবন এমন হবে কেন?

অথচ আমাদের ছেলে-মেয়েরা একবিংশ শতকের গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করছে। বাংলাদেশে তারা বসবাস করলেও তাদের জগৎ বিশ্বজুড়ে। এরা যখন দেশের বাইরে পড়তে যাবে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যাবে, তখন তারা বুঝতে পারবে, কাজের ছেলে বা মেয়ে হওয়াটা কত জরুরি ছিল। তাদের উন্নাসিক মা-বাবারাও বুঝতে পারবেন, কী ভুল তারা করেছেন।

কেউ কি বলবেন, পৃথিবীর কয়টি দেশে বাংলাদেশের মতো পরিবারগুলোতে কাজ করার জন্য কাজের ‘বুয়া’ রাখে? আমার যে দশ-বারোটি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, সেখানে কোথাও পরিবারের সদস্যদের বাইরে কোনো কাজের লোক দেখিনি। তারা কি চাকরি-বাকরি করে না, ব্যবসা-বাণিজ্য করে না, তাদের পরিবারে কি সন্তান-সন্ততি নেই? সব আমাদের মতোই। তারা শুধু আমাদের মতো মূর্খ নয়, অথর্ব নয়, অকর্মণ্য নয়, উন্নাসিক নয়, অর্থের গরম তাদের মধ্যে নেই-  এই হলো পার্থক্য। ওইসব দেশে গিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েদের কষ্টের সীমা থাকে না। তাকে বাজার করতে হয়, রান্নাবান্না করতে হয়, থালাবাসন-হাঁড়ি পাতিল পরিষ্কার করতে হয়, কাপড়চোপড় ধুতে হয়, ইস্ত্রি করতে হয়, পড়াশুনা করতে হয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়, পার্ট টাইম চাকরি করতে হয়, অসুখ হলে নিজের পরিচর্যা ও সেবাশুশ্রূষা নিজেকেই করতে হয়।

জ্বর হলে নিজের মাথায় নিজেকেই পানি দিতে হয়। কোনো মা-বাবা, ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজন তাকে ওইসব কাজ করে দিতে যায় না। আর কাজের ‘বুয়া’! দূরকাওয়াস্ত। ওখানে কাজের বেটি বা কাজের বুয়া বলে কিছু নেই। খুব অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে হাউজ কিপার থাকতে পারে। তাদের বেতন কত জানলে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হবে। বিষয়টা এমন যে, আমাদের দেশে একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী মাসে যদি একলক্ষ টাকা বেতন পান, তা হলে তার কাজের বুয়ার বেতনও ওর কাছাকাছিই হবে। বুঝুন ঠেলা। ওইসব দেশে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে বেতন অনেক বেশি। সুতরাং শিক্ষার্থী তো নয়ই, কোনো সাধারণ পরিবারও একজন হাউজকিপার রাখার কথা ভাবতেও পারে না।

এমন বেহাল অবস্থায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে আমাদের অনেক ননির পুতুলকে দেশে ফিরে আসতে হয়। শেষপর্যন্ত ছেলেটি না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থয় পড়ে। কেউ কেউ দেশে না ফিরলেও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে ‘অড জব’ জোগার করে নেয়। তখন অবৈধ আভিবাসী হিসেবে তার শুধু টাকা কামানো ছাড়া আর কোনো উচ্চাশা থাকে না। যেসব মা-বাবাদের বুঝ আছে তারা বুঝতে পারেন, ছেলে-মেয়েদের কাজের মানুষ বানানো কতটা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখন আর বুঝে কোনো লাভ হয় না। আবার অনেকে বুঝতেও পারে না যে, ছেলে-মেয়েদের ‘মানুষ’  করার প্রক্রিয়ার মধ্যে ভুল ছিল। এখন যখন শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার মধ্যে সরাকর এই দায়িত্ব নিচ্ছে, তখন ওই উটকো লোকগুলো নির্লজ্জের মতো বলছে “আমার ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছি কি কাজের বুয়া হওয়ার জন্য?”

তো আপনার ছেলে-মেয়েকে কাজের বুয়া বানাতে বলছে কে? তাদের স্কুলে না পাঠালেই পারেন। বাড়িতে রেখে তা দেন। আঁচলের আড়াল হতে দেন কেন? স্কুলে পাঠালে তাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের এইটুকু বলতে পারি, বর্তমান শিক্ষাক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের ছেলে-মেয়ে আর যাই হোক না কেন, তাদের মধ্যে কাজের মানসিকতা তৈরি হবে। কোনো কাজকেই তার তুচ্ছজ্ঞান করবে না, অবহেলা করবে না, বাজে কাজ ভাববে না। এই মানসিকতা তৈরি হওয়া খুব জরুরি।

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি যাকে কাজর বুয়া বলছেন, তার খোঁজ কিছু নেন? নিয়ে দেখুন, তার ছেলে-মেয়ে থাকলে তারা স্কুলে পড়ছে। ওই ছেলে-মেয়েরা আপনার-আমার বাসায় কাজের বুয়া হতে আসবে না। সুতরাং আপনি যাকে কাজের বুয়া বলছেন, সে হলো ওই পরিবারের শেষ কাজের বুয়া। এর পরে আর কাজের বুয়া পাবেন না। নিশ্চিত জেনে রাখুন, আগামী দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে কাজের বুয়া নামক পেশাটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন আপনার সযত্নে বানানো ননির পুতুলেরা কাজের বুয়া পাবে কোথায়? সুতরাং বর্তমান কারিকুলামকে যারা কাজের বুয়া বানানোর কারিকুলাম বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, নোংরা ভাষায় গালাগাল দিচ্ছেন, তাদের বলছি, এই কারিকুলাম কাজের বুয়া বানানোর কারিকুলাম নয়-  কাজের মানুষ বানানোর কারিকুলাম।

দক্ষ, মূল্যবোধসম্পন্ন, আদর্শবান নাগরিক বানানোর কারিকুলাম। এই শিক্ষার্থীরা জীবনের সকল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, নিজের সকল কাজকর্ম নিজেই করতে পারবে। আমাদের উচিত এই শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানানো এবং সুষ্ঠুভাবে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সহযোগিতা করা।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক