সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘একাত্তরে ঈদুল ফিতর’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২৫

আমাদের শৈশব কেটেছে ষাট ও সত্তরের দশকের দিনগুলোতে। সেই সময় শিশু-কিশোরদের ঈদ উদযাপনের জগৎ আজকের মতো ছিল না। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনে ঈদের দিনগুলোতে শিশু-কিশোররা যে আনন্দিত সময় অতিবাহিত করত, তার সঙ্গে আজকের দিনের কোনো তুলনা চলে না। তেমন একটি দিনের স্মৃতি আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এখনও মনে হয়, দারিদ্র্যের চরম এক সীমানায় পৌঁছে গিয়েও আমাদের গ্রামীণ জীবনে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বৃক্ষের মতো, পশুপাখিদের মতো, ফুল-পাখিদের মতো, খাল-বিল আর পুকুরের জলের মতো এবং বিস্তীর্ণ মাঠে বাতাসে দোল খাওয়া শস্যের মতো যে আনন্দময় জীবন কাটিয়েছি, তার স্মৃতি কোনোদিন ভুলবার নয়।

১৯৭১ সাল বাঙালি জীবনের হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের এই চির দরিদ্র, জন্মবাউল ও প্রকৃতির মতো উচ্ছল দেশটিকে নরকে পরিণত করেছিল। সে বছর আমাদের জীবনে ঈদ এসেছিল- রমজানের ঈদ, ঈদুল ফিতর। এ আমার জীবনের প্রথম ঈদ, যখন আমি বুঝতে শিখেছি।

১৯৭১ সালের ওই ঈদটি আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাবা খুব বাজারে যেতেন। কিন্তু এতবার বাজারে গিয়েও সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য নতুন কোনো পোশাক সংগ্রহ করতে পারেননি। বিষয়টি যতনা ছিল আর্থিক, তার চেয়ে বেশি ছিল জিনিসপত্রের অভাব। ধনাগোদা ও মেঘনা নদী পরিবেষ্টিত তৎকালনি চাঁদপুর মহকুমার মতলবের এই অংশটুকু তখন ছিল সম্পূর্ণরূপে জলপরিবেষ্টিত। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্তমানের মতলব উত্তর উপজেলায় কখনোই প্রবেশ করতে পারেনি। যুদ্ধের একদম শেষের দিকে মেঘনা নদী থেকে মর্টর সেলের আক্রমণ হয়েছিল একবার-  এইমাত্র।

ফলে অনিবার্যভাবেই এই থানাটি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। চাঁদপুর গিয়ে ঈদের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে আসবেন-  সেই সাহস কারোরই ছিল না। মতলব আওয়ামী লীগের সভাপতি এডবোকেট রুহুল আমিন মামার ছোট ভাই কোনো কাজে চাঁদপুর গিয়েছিলেন। তিনি আর ফিরতে পারেননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় তাকে হত্যা করে। ফলে চাঁদপুর যাওয়ার সাহস আর কেউ পায়নি। পার্শ্ববর্তী বামের বাজার, চরকালিয়া বাজার, আমিরা বাজার কিংবা দাশের বাজারে পোশাক-পরিচ্ছদে ছিল না বললেই চলে। কেনার মতো সামর্থ্যও মানুষের ছিল না।

অন্যদিকে সারাদেশ জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও ও ধ্বংসলীলা সংগঠিত করেছিল, তেমন পরিস্থিতিতে ঈদ উৎসব করার মতো মানসিকতা বড়দের ছিল না। তাই আমার মা আমাদের পুরনো পোশাক-পরিচ্ছদগুলো ধুয়ে ইস্ত্রি করে এমন পরিপাটি করে রেখেছিলেন যে, তাকে নতুন বললে ভুল করা হতো না।

১৯৭১ সালের ঈদুল ফিতরে এই জনপদে প্রচুর নতুন মানুষের সমাগম ঘটেছিল। ঢাকা এবং অন্যান্য শহর থেকে অনেক মানুষ এসেছিল মতলবের এই ব-দ্বীপটিতে। কারণ এই ব-দ্বীপটি ছিল সবচেয়ে নিরাপদ এবং ঝুঁকিহীন। ফলে অনিবার্যভাবেই কাছের ও দূরে অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আমাদের গ্রামে এবং অন্যান্য গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঈদ উৎসবের দিনটিতে সেই সব অতিথিদের আনন্দ করার মতো তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু সমবেত হয়ে কুশল বিনিময় করার সুযোগ সবারই ছিল।

আমরা যখন বেলুন ফুলিয়ে প্যাঁপো প্যাঁপো বাজিয়ে বাজিয়ে মানুষের কান জ্বালাপালা করে দিয়ে বামের বাজার কিংবা নেংটার বাজার দিকে রওনা হলাম, তখন দেখলাম আমাদের সঙ্গে অনেক অপরিচিত শিশু-কিশোর ভিড় জমিয়েছে। কিন্তু কে পরিচিত আর কে অপরিচিত এই ভেদবুদ্ধি তখনও আমাদের মধ্যে জন্মেনি। আমরা সবাইকে আপন হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম নিজেদের অজান্তেই।

আগের দিন সন্ধ্যায় ফসলকাটা দক্ষিণের বিরান মাঠে আমরা অসংখ্য শিশু-কিশোর পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি তালগাছের ছাতার মতো পাতাগুলোর নিচ দিয়ে অস্পষ্ট একটি চাঁদের চিহ্ন দেখেছিলাম। সেই চাঁদ ছিল রহস্যময়-   দেখা যায়, দেখা যায় না; বোঝা যায়, বোঝা যায় না। মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে যায় এই দেখা না-দেখার, বোঝা না-বোঝার এক আলো-আঁধারি খেলা। এইমাত্র যেন দেখেছিলাম, কিন্তু পাতাদের ফাঁকফোকর গলিয়ে ওই চাঁদটি কোথায় চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার একটি ক্ষীণ আভাসের মতো উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল।

আর আমরা হৈচৈ করতে লাগলাম; কে দেখেছে কে দেখেছে? কোথায় কোথায়; আমারে দেহা আমারে দেহা, ওই যে ওই যে, তালগাছটার মাথার দিক দিয়া দেখ-  এস ছিল আমাদের অফুরন্ত আনন্দ-উপাচার। এমন এক রহস্যময় লুকোচুরি খেলার ভেতর দিয়ে আমরা বুঝে গেলাম যে আগামীকাল ঈদ। সম্ভবত ২০শে নভেম্বর, শনিবার।

প্রকৃতিতে তখন শীতের আনাগোনা। দিন কিছুটা ছোট হয়েছে। দুপুর গড়াতে না-গড়াতেই সন্ধ্যা চলে আসে। মনে হয়, পাখির পালকে ভর করে সন্ধ্যা নেমে আসে। লতাপাতা ও খরকুটো বাতাসে নড়ে গেলে যেটুকু শব্দ হয়, নভেম্বরের এই সন্ধ্যা তার চেয়েও নীরবে আমাদের উঠোনময়, আমাদের ঘরবাড়ি, খাল-বিল-পুকুর-পুষ্করিণী ও গাছপালা আচ্ছন্ন করে বিরাজমান হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে থাকে ঠান্ডা বাতাসের পরশ। সন্ধ্যাটা যখন ধীর লয়ে রাতের দিকে যেতে থাকে, তখন একই সঙ্গে একটা হিম স্পর্শের প্রবাহ আমাদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে। শিশু-কিশোরদের জন্য সেই ঠান্ডাটুকু বেশ উপভোগ্য। আমাদের মনেই হয় না যে প্রকৃতির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।

কিছুদিন পরেই দেখা যাবে কুয়াশাঢাকা শীতের পৃথিবী। আমাদের যে একটুও শীত লাগছে না, সে কথায় কান না-দিয়ে মা আমাদের গায়ে কিছু একটা জড়িয়ে দেন। সেটা গামছা হতে পারে, চাদর হতে পারে, পুরনো ছেড়া লুঙ্গি হতে পারে, মায়ের পুরনো শাড়ি কিংবা নিদেনপক্ষে মোটা কাপড়ের একটি গেঞ্জি বা শার্ট। কিন্তু চাঁদ দেখার সেই রাতের আনন্দের সঙ্গে এইসব যেন যায় না। আমরা বেমালুম ভুলে যাই যে, শীত পড়েছে এবং রাতও কিছুটা গভীর হয়েছে।

অন্যান্য দিন সন্ধ্যার পর পরই আমাদের রাত শুরু হয়ে যেত। ঘরগুলোতে টিম টিম করে জ্বলত কুপি বা হ্যারিকেনের আলো। ঘরের বাইরে থেকে সেই আলো জোনাকি পোকার আলোর মতোই মনে হতো অতি ক্ষীণ বিন্দুর মতো। ওই আলোতে ঘর তো আলোময় হতোই না, অধিকন্তু সেই আলো অন্ধকারকেই প্রগাঢ় করে তুলত। আমাদের গ্রামীণ জীবনে গভীর রাত হয়ে যেতো ওই নটা-দশটার মধ্যেই। চাঁদরাতে আমাদের বোধ থাকত না যে রাত গভীর হয়ে গেছে। আমরা দল বেঁধে গ্রামময় ঘুরে বেড়াতাম। এই রাতে আমাদের কোনো বারন থাকত না।

বাড়ির দক্ষিণে ছিল বাংলা। বড় ছেলেদের আস্তানা। পড়াশুনা করা বা না-করা, কর্ম এবং অপকর্ম করা বা না করার সকল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হতো ওই বাংলাঘরে। চাঁদরাতে আমরা ছোটরাও ওই রহস্যময় ঘরে ঢুকে পড়তাম আর বড়দের সঙ্গে হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়াতাম। বড়দের ওই প্রশ্রয়টুকু আমাদের আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে দিত। কখনো কখনো সেই গভীর রাতে পুকুরের পাড় দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণের মসজিদের পেছনের চাতালে, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতাম।

বাড়ি থেকে দূরে এই বির্স্তীণ চত্তরটি হয়ে উঠত আমাদের হৈচৈ করা, হুড়োহুড়ি করা, চিৎকার চেচামিচি করা আর কখনো কখনো ঝগড়াঝাঁটি করার নিরাপদ স্থান। প্রাণখুলে আনন্দ করার এমন ভয়ডরহীন জায়গা তখন খুব বেশি ছিল না। এর মধ্যে ছোট কাকু এসে দুই দুই বার বলে গেছে, এই ছাগলের বাচ্চারা, তোরা কি সারা রাইত বেহ্ বেহ্ করবি? বাইত যা, বাইত যা কইলাম।

একসময় আমাদের ঘরে ফিরতে হয়, ফিরতে হয়ই। কারণ, বুঝতে পারি, ততক্ষণে মা অনেক বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে ছত্তর কাকুর মা-  আমাদের একমাত্র জীবিত দাদি যতটা সম্ভব আমাদের গরুর রাখালের মতো তাড়া দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে এবং যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। ঘরে ঢোকার পরেই মায়ের পালা। চাঁদরাতের আনন্দ! তাই মাইর দেয় না। শুধু বলে, কী পোলাপাইন হইছে এই গুলা! ভয়ডর কিছু নাই। আর হাপেও কামড়ায়ও না, ভূতেও ধরে না। সাহস কত! রাইত-বিরাইতে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুইরা বেড়ায়। পাও ধুইছস? খবরদার! পাও না ধুইয়া ঘুমাইতে আইছ না কেউ। পাও ধুইয়া আয়।

আমরা বদনার জলে পা ধুয়ে টায়ার লাগানো কাঠের খড়ম পা দিয়ে খট খট করে ঘরে ফিরি এবং কখন যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই।

লেখক: সাহিত্যিক