সময় থাকতে লোভিদের চিনতে পারাটাও দক্ষতা

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০১৯

নারী-পুরুষ মিলিয়েই মানুষের সমাজ। সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে এই উভয় লিঙ্গের মানুষেরই ভূমিকা রয়েছে। এরপরও নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি একটু ব্যতিক্রম। নারীকে মনে করা হয়, পুরুষের ইচ্ছের পুতুল। অবশ্যি এ মন্তব্য ঢালাওভাবে করা উচিত হবে না। সমাজে এমনও রুচিমান পুরুষও আছেন, নারীর প্রতি যারা যথার্থ দায়িত্ববান।

সম্প্রতি পাকিস্তানি এক ক্লাসমেটের (বার্লিন) সাথে আলাপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নারীর ভাগ্য সব দেশেই এক, কী বাংলাদেশ আর কী পাকিস্তান! (প্লিজ, অতি উৎসাহী কেউ বলবেন না, আমি বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা দিচ্ছি, যেটা হবার নয়, সেটা নিয়ে আমি বেহুদা কথা বলি না)। ঘটনা হলো, সেই ক্লাসমেটের বড় বোন, দুই কন্যার মা, পেশায় চিকিৎসক। উনার বিয়ে হয়েছিল প্রায় ১৭ বছর আগে। বিয়েতে বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন করাচি শহরে একটা দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ি উনি ভালোবেসে স্বামীর নামে লিখে দিয়েছিলেন, ভাইদের আপত্তি উনি মানেননি। সেই হারামজাদা স্বামী পরে তাকে তালাক দেয় এবং বাড়ি থেকে বের করে সেটা নিজের দখলে নিয়ে নেয়। এই নিয়ে কেস চলছে, কিন্তু কেস চলা অবস্থাতেই বোনটি স্ট্রোক করে মারা গেছে গত মাসে।

আরেক নারীর কথা বলি। তিনি আমার পরিচিত, সন্তান। ভালো বেতনে চাকরি করতেন, বাবার বাড়ির সম্পত্তিও পেয়েছেন অনেক। বাবার বাড়ির সম্পত্তি ছাড়া প্রায় সবই, মানে অন্য সম্পত্তি আর জমানো টাকা স্বামীকে দিয়েছিলেন। সন্তান নাই, এ অজুহাতে সেই হারামজাদাও আরেকটা বিয়ে করেছে। এই নারীর বয়স হয়েছে আর ভাইবোনদের তেমন কিছু দেয়নি দেখে, তারাও তাকে সেভাবে গ্রহণ করে না। শেষ বয়সে তেমন কোথাও যাবার জায়গাও নাই। এখন, এই নারীটি স্বামীর মারধর খেয়ে মুখ বুজে চোখের পানি ফেলছে।

এবার যে নারীর কথা বলব, তার স্বামী ব্যবসায় ধরা খেয়ে পথে বসে যায়। বাধ্য হয়ে খুব অল্প বয়সে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। চোখমুখ বন্ধ করে দিন রাত এক করে কেবল কাজ করে চলে। নিজেদের মাথা গোজার ঠাই করে, সন্তানদের জন্য একটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, স্বামীর ব্যবসা দাঁড় করায়। অল্প বয়সে নিজের সাধ আহ্লাদ মাটি করে পুরা সংসারের দায়িত্ব আবার কর্মস্থলের ঝক্কি, সব মিলিয়ে নারীটি একটু কিটকিটে স্বভাবের হয়ে ওঠে। এই অজুহাতে সেই অকর্মার ঢেঁকি স্বামী আরেকটি মনের মানুষ খুঁজে নেয়। নারীটি শ্বশুরবাড়ির লোকদের দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজের সঞ্চয়ের প্রায় পুরাটাই খরচ করে ফেলে। সবকিছু পেয়ে গিয়েছে বলে এখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও তাকে আর আগের মতো মাথায় তুলে নাচে না, উল্টা তাকে মানসিক চাপ দিয়ে বাকি যেসব সম্পত্তি আছে সেগুলো কিভাবে হাতানো যাবে, সেই চিন্তায় তারা ব্যস্ত। নারীটি তবুও ভেঙে পড়ে না, ভিক্ষুকদের দান দিয়েছে, এই সান্ত্বনা নিয়ে নতুন করে আবার নিজের জন্য লড়াই করার প্রস্তুতি নেয়।

আমি বলছি না, পুরুষ মানেই গণহারে খারাপ। অনেক ভালো পুরুষও আছেন। আমার দেখা এক ভদ্রলোকের কোনো সন্তান নাই। এ নিয়ে অনেকেই তাকে অনেক কটাক্ষ করে, আমি নিজেও অনেককে তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে শুনেছি। একদিন উনার স্ত্রীর সাথে আলাপের সময় জানলাম, ভদ্রমহিলার টিউমার ছিল বলে খুব অল্প বয়সেই তার ইউট্রাস কেটে ফেলা হয়। উনি অনেক চেয়েছেন, বাচ্চা দত্তক নিবেন, এমনকি স্বামীকে বিয়েও করতে বলেছেন। কিন্তু, সেই ভদ্রলোক এর কোনটাই করেননি, বরং তার নিজের বাড়িটিও তার স্ত্রীর নামে দিয়েছেন, যাতে করে নারীটি নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে।

এত কথা বলার মানে হচ্ছে, নারী-পুরুষ বলে আলাদা কিছু না, সময় থাকতে লোভিদের চিনে রাখা জরুরি। নারীদের জন্য একটু বেশি জরুরি কারণ ছোট থেকে তাদের শিখানো হয়, নারী মানেই মা, দেবী, ত্যাগের প্রতীক। এইসব বলে বোকা বানিয়ে, তাদের বরাবরই ঠকানো হয়। বলছিনা ব্যতিক্রম নাই, তবে বেশিরভাগ সময়ই নারীরা তাদের প্রাপ্য বুঝে নেয় না বা নিজের কথা না ভেবে সংসারের জন্য গাধার মতো খেটে চলে। অথচ দিন শেষে তাদের নিজের জন্য কিছুই থাকে না। শেষ বয়সে তাদের সন্তানদের গলগ্রহ হয়ে কাটিয়ে দিতে হয় জীবন।

একজন পুরুষও কিন্তু সারাজীবন সংসারের ঘানি টেনে চলে নিজের কথা না চিন্তা করেই। সেরকম একজন নারীরও দায়িত্ব সামর্থ্য থাকলে পরিবারের প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চ করা। কিন্তু বোকামি করা যাবে না। মানুষ চিনে বুঝে সাহায্য করতে হবে।

তাই সবারই উচিত, নিজের জন্যও কিছু করা, কিছু সঞ্চয়ে রাখা। নিজের সম্পদ বা সম্পত্তি একদম বিলিয়ে না দিয়ে, নিজের নিরাপত্তার জন্য হাতে কিছু রাখা। পরিবারের বিপদে অবশ্যই পাশে দাঁড়াতে হবে।

সম্পত্তি বেদিতে সাজিয়ে ধূপধুনো দিয়ে পূজা করার জিনিস না, বিপদে কাজে লাগানোরই জিনিস। তবে নিজের বিপদের কথা মাথায় রেখে তা ব্যয় করা উচিত, সেটা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই জরুরি। সময় থাকতে লোভিদের চিনতে পারাটাও দক্ষতা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী