সময় এগোচ্ছে, অথচ সভ্যতা পিছিয়ে যাচ্ছে
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। তিনি তরুণ বয়সে যা লিখে চলেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। আমি সুসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের ‘কালকেউটের সুখ’ বইটি পড়ার পড় যারপরনাই মুগ্ধ হই। সিদ্ধান্ত নিই, বাজারে তার যে ক’টি বই পাওয়া যাচ্ছে তার সবকটি কিনব। সবকটি কিনতে পারিনি ঠিক, তবে অনেকগুলো কিনেছি, যার একটি ‘বানিয়াশান্তার মেয়ে।’
বইটি একটি গল্পগ্রন্থ। চৌদ্দটি বড়দের গল্প মলাটবদ্ধ হয়েছে এখানে। গল্পগুলো অগ্রজ কথাশিল্পী স্বকৃত নোমান ২০১৮-২০১৯ সালের মধ্যে লিখেছেন। ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম, সাধারণ মানুষ যখন মাটি দেখে, বিজ্ঞানীরা সেই মাটির মধ্যে মূল্যবান খনিজসম্পদ দেখে। স্বকৃত নোমান পড়ার পর মনে হচ্ছে, সাধারণ লেখক যেখানে সাধারণ নারী-পুরুষের ইটিশ-পিটিশ প্রেম দেখে, স্বকৃত নোমানের মতো লেখকেরা সেখানে সমাজের গভীর পটপরিবর্তন দেখে। দৃষ্টিশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দুটোই আলাদা না হলে এ ধরনের সাহিত্য রচনা করা যায় না।
তিনি প্রথমগল্প `চরজনম` এ দেখিয়েছেন মানবধর্মের জয়। যেখানে পোষাকি ধর্মের ধার না ধরা প্রকৃত মানুষ তুফান আলী পায় স্রষ্টার শুভাশীর্বাদ। দ্বিতীয় গল্পটিও মানবতার জয়গান গেয়েছে। গল্পটির নাম ‘বগি নম্বর ৮৩০৫’। রেলস্টেশনের সস্তা বেশ্যার মানবিকতার জন্য প্রাণ ফিরে পান রেলের বাথরুমে আটকে পড়া এক ভদ্র যাত্রী। দেশের নিরাপত্তা ও রেল ব্যবস্থাপনার দুর্বল দিকটিও উঠে এসেছে এ গল্পে দারুণভাবে। তৃতীয় গল্পটির নাম `একটি শ্রুত গল্প`। সমাজের ভদ্রবেশী ক্ষমতাধর লম্পটদের চরিত্র চিত্রিত হয়েছে এখানে।
চতুর্থ গল্পটির নাম `কালাপীর`। খুব স্পর্শকাতর একটি গল্প। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ পরিবর্তন খুব বেশি হয়েছে ২৫ বছরে। স্বৈরাচারী অমলের শেষদিকে যার শুরু। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস কমে গেছে, অন্যদিকে আচার বেড়ে গেছে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, পাশাপাশি সমানুপাতিক ভাবে বেড়েছে ধর্মচর্চা। বাংলার সহজসরল মানুষগুলো বড়বেশি জটিল হয়ে গেছে। ইহকালের থেকে পরকাল তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেভাবে বেড়েছে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধ। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা অপরাধ কমাতে পারেনি; বরং সমাজে অপরাধ, পারস্পরিক দূরত্ব, আন্তরিকতার অভাবসহ নেতিবাচক সবদিকই বেড়েছে। কেন বেড়েছে? এর কোনও উত্তর নেই।
আমরা জানি, ডাক্তারের চাকু জীবন বাঁচায়, আর কসাইয়ের চাকু জীবন নেয়। ধর্মও তেমনি। ধর্ম কার হাতে পড়ল, কে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে, তার উপর নির্ভর করে ধর্মের গুণাগুণ। ভালো মানুষের হাতে পরলে ধর্মের মৌমাছি মধু দেয়। খারাপ মানুষের হাতে পড়লে ধর্মের মৌমাছি হুল ফুটায়। তাহলে ধর্মটা এখন কার হাতে আছে? উত্তর জানা নেই।
এই উপমহাদেশে ধর্ম তো হাজার বছর ধরে রয়েছে। কই, আগে তো এত বিদ্বেষ, এত অবিশ্বাস ছিল না। তবে এখন কেন? কী পরিবর্তন হলো ধর্মের? জানা নেই। তবে ভেতরে ভেতরে যে ধর্মের মূল আধ্যাত্মিকতা থেকে এ উপমহাদেশের মানুষ সরে এসেছে, সেটা নিশ্চিত। এর মূল কারণ, ধর্মকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালনে বাধ্য করা।
ধর্ম অন্তর্নিহিত ব্যাপার। উপলব্ধির ব্যপার। অনুভবের ব্যাপার। মানুষের জীবনের এক একটা পর্যায়ে এক এক রকম ভাব আসে। কখনো সাকার কিংবা কখনো নিরাকার স্রষ্টায় মানুষের বিশ্বাস আসে। কখন বিশ্বাস উঠে যায় আবার কখনো সে বিশ্বাস ফিরেও আসে। শীত-গ্রীষ্মের মতো হৃদয়েও ভক্তির তারতম্য হয়। এটা জীবনের স্বাভাবিক পক্রিয়া। যখন কোন বাহ্যিক প্রভাব এই পক্রিয়ায় বাধা দেয়, যখন মানুষটি তার নিজের মতো করে ধর্মের অনুভূতি লালনপালন করতে পারে না, যখন জীবিত মানুষের থেকে অদেখা জগৎটি বড় হয়ে যায়, তখন সমাজে ভাঙন ধরে। সমাজে পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তন আলোর নয়, অন্ধকারের।
প্রতিটি মানুষ যেহেতু আলাদা, তার ধর্মও সেহেতু আলাদাই হওয়া উচিত। সে হিসাবে বর্তমান প্রচলিত পাঁচ হাজার ধর্ম মানুষের জন্য অপর্যাপ্ত। সাতশো কোটি মানুষের জন্য সাতশো কোটি ধর্ম হওয়া উচিত। প্রতিটি মানুষই মানবসন্তান। সে হিসেবে সবাই এক। আবার প্রতিটি মানুষের মুখ, মন ও চিন্তাশক্তি যেহেতু ভিন্ন সেহেতু মানুষও ভিন্ন। আমরা তাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের উপর একই নিয়মের শৃঙ্খল চাপিয়ে দিতে পারিনে। মানুষের অধিকার আছে নিজের মতো করে চলার। এই অধিকার খর্ব হলে নামে মহা মানবিক বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ে জর্জরিত বর্তমান পৃথিবী। বিশেষ করে আমাদের এই উপমহাদেশ।
আবার আমাদের উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে টাকা উপার্জনের মেশিনে রূপান্তরিত করছে। মানবশিশু থেকে মানুষে রূপান্তরিত করছে না। আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরমতসহিষ্ণুতা থেকে পরমত বিদ্বেষ শেখাচ্ছ বেশি। আমাদের সময় এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের সভ্যতা পিছিয়ে যাচ্ছে। আমরা পশ্চাৎপদ হয়ে যাচ্ছি। আমরা হাজার বছর পরে কী হবে তা নিয়ে ভাবছি না। আমরা হাজার বছর পূর্বে কী হয়েছে তা নিয়ে ভাবছি। বর্তমানে অশিক্ষিত মূর্খের চেয়ে শিক্ষিত মূর্খ বেশি। এই মূর্খ শিক্ষিত সমাজের চালচিত্র তুলে ধরেছেন স্বকৃত নোমান। তার ‘কালাপীর’ গল্পে।
গল্পটির পটভূমি চার কুকরীমুকরী হলেও গল্পটি এ উপমহাদেশের প্রতিটি প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে। গল্পটি একটি ধর্মকে কেন্দ্র করে লেখা হলেও এটি এ উপমহাদেশের প্রতিটি ধর্মকে ছুঁয়ে গেছে। এমন গভীর ভাবনা বর্তমানে খুব কম সাহিত্যিকই ভাবছে। যার মধ্যে স্বকৃত নোমান একজন।
তার পঞ্চম গল্পটির নাম `রবীন্দ্রনাথ`। হুজুগে মাতাল বাঙালির গুজবে কান দেয়ার নির্লজ্জ সত্য উঠে এসেছে এখানে। ফেসবুক গর্ধবদের গাধামিও প্রকাশ পেয়েছে উলঙ্গভাবে। ষষ্ঠ গল্পটির নাম `২০১৯`। দেশে নেশার বিস্তার, নেশার ভয়াবহতা ও গুজবের ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে করুণভাবে এ গল্পে। সপ্তম গল্পের নাম `হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন`। ভূতের মুখে রামনামের মতো এখন অসৎ মানুষের মুখেই সততার খই বেশি ফুটছে। এ গল্প কথিত সৎ বুদ্ধিজীবীদের কাছা খুলে দিয়েছে।
অষ্টম গল্পের নাম `রাহাদ, একজন বাঙালি`। কল্যাণ রাষ্ট্রের অ্যাসাইলাম পাওয়ার জন্য আমরা যে কতটা নিচে নামতে পারি তার বিশদ বর্ণনা পাই গল্পটিতে। নবম গল্প `সুখ`। দাম্পত্য জীবনের সুখ-অসুখের গল্প। দশম গল্প `কাদাজলের আগুন’। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্তের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হবার কাহিনি। এগারতম গল্পে নাম `ফিকির’। প্রতারণার গল্প, পদস্খলনের গল্প। বিশ্বাসের গল্প ও অবিশ্বাসের গল্প এটি। বারোতম গল্প `শুকলাল ডোম`। ২৫ মার্চ কালরাত্রির গণহত্যার নির্মমতা উঠে এসেছে এ গল্পটিতে। শুকলালের মতো ডোমও যে নির্মমতা দেখে শিউরে উঠেছে, হয়েছে বাকরুদ্ধ বা উন্মাদ। তেরোতম গল্পের নাম `জীবন`। জীবনের অনিশ্চিত নিয়তির গল্প এটি। অদৃশ্য ভবিষ্যতের অনিশ্চিত গন্তব্য এ গল্পের মূল থিম। ভবিষ্যতে কী হবে তা যে কেউ বলতে পারে না। গল্পটি ভবিষ্যতের হাতে মানুষের অসহায়ত্ব তুলে এনেছে।
সর্বশেষ গল্পটির নামে এ বইটির নাম। বানিয়াশান্তার মেয়ে। মানুষের প্রথম পরিচয় তার মানবিকতা। মানুষ যদি মানবিক হয়, তবে বেশ্যা বিয়ে করেও সুখি হতে পারে। মানুষ যদি অমানুষ হয়, তবে দেবিকেও বেশ্যা বানিয়ে ফেলতে পারে। আবার দুখের দিনের বন্ধু ও সুখের দিনের বন্ধুর সাথে কী আচরণ হওয়া উচিত সেটিও শিখিয়েছে।
বইটি গতকাল শুরু করে শেষ হবার পর আমি নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। গল্পের ভাষা, গল্পের গাঁথুনি নান্দনিক। প্রতিটি গল্প বলার ধরণ ভিন্ন। গল্পের বিষয় ভিন্ন। বৈচিত্র্যময় ১৪টি বিষয়ের অপূর্ব সমন্বয় এ বইটি। বইটি স্বকৃত নোমানকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস, লেখকবন্ধু স্বকৃত নোমান এভাবে বহু বছর লিখে যাবেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০