সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না
পর্ব ২
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৪, ২০২১
নিশ্চয়ই ধর্মান্ধরা প্রগতি বিরোধী। কিন্তু আসলে তারা বিরাট কোনো শক্তি নয়। নিশ্চয় ধর্ম নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি আছে। ধর্ম পালনের জন্য তারা রাস্তাঘাট আটকে জনসাধারণের জীবনে বিঘ্ন ঘটায়। নিজদেশের চেয়ে ইসলামি দুনিয়াকে আপন মনে করে। সৌদি আরবকে মনে করে তার সবচেয়ে আপনজন। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকরাও সেটা করে। নিজের দেশের চেয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে তারা। পাশ্চাত্যের পোষাক পরে, ইংরেজি ভাষায় নিজে কথা বলে, সন্তানকে কথা বলতে উৎসাহ জোগায়। পাশ্চাত্যের খাবার খায়, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে তার অনেক আপন মনে করে। পাশ্চাত্যে থাকার জন্য পাগল হয়ে যায়। ধর্মান্ধরা ঠিক একইভাবে ইসলামি দুনিয়াকে আপন ভাবে। দু’পক্ষের মধ্যে সেইক্ষেত্রে পার্থক্যটা কী? দু’পক্ষই সেখানে আমাদের আপন নয়। স্বভাবতই একপক্ষ ইসলামি জগতের বন্ধু আর একপক্ষ সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের বন্ধু।
রাষ্ট্র একদিকে সাম্রাজ্যবাদের বা পাশ্চাত্যের দালালদের সুবিধা দেয়। নিজ স্বার্থে তাদের সঙ্গে আঁতাত করে। ভিন্নদিকে আবার ধর্মান্ধদের সুযোগ সুবিধা দেয়। রাষ্ট্রের কিছু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল আসলে নিজেদের স্বার্থে ধর্মান্ধদের একটা শক্তি বানিয়ে রেখেছে। বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলি যুক্তিবাদী চেতনার চেয়ে এই ধর্মান্ধ চেতনাকে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার অস্ত্র ভেবেছে। ফলে বাম বা প্রগতিশীল বা উদারনৈতিক চিন্তাকে মাথা তুলতে না দিলেও, ধর্মান্ধদের সঙ্গে রাষ্ট্র বারবার আপোস করেছে। ধর্মান্ধরাও সরকারের ছত্রছায়ায় নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে নিয়েছে। সরকারগুলি খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে এই ধর্মান্ধদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে এবং ভারতের রাজনীতিতে এই একই ঘটনা ঘটেছে। সরকার বা ক্ষমতাবানরা বা বাজার সংস্কৃতি সবসময় প্রগতিশীল চিন্তার চেয়ে ধর্মান্ধদের তাদের টিকে থাকার উপায় হিসেবে দেখেছে।
কারণ প্রগতিশীলরা সরকারের দুর্নীতিকে ছাড় দেবে না। ভিন্নদিকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলবে। ফলে ‘সেই ভালো সেই ভালো’ প্রগতিশীলদের চেয়ে ধর্মান্ধরা ভালো, কারণ ধর্মান্ধরা মানুষকে অন্ধ করবে কিন্তু সচেতন করবে না। ধর্মান্ধদের সমর্থন দেয়ার সুবিধা হলো, রাষ্ট্রের দুর্নীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এরা করতে পারবে না। কিছু মসজিদ বানিয়ে দিলেই বা ধর্মীয় কিছু উৎসব পালন করার বড় সুযোগ করে দিলেই তারা খুশি থাকবে। সামান্যতে তাদের সন্তুষ্ট রাখা যায়, ধর্ম পালনের কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা দিয়ে। বাংলাদেশে মুসলমানদেরকে সেটা দেয়ার পাশাপাশি আবার ভারসাম্য রক্ষা করতে হিন্দু বৌদ্ধদেরকে কিছু ধর্মীয় অনুদান দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমাজকে যারা বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার পথে নিয়ে যেতে চায়, তাদের কাজকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
ধর্মপালনে কাউকে বাধা দেয়াটা অন্যায়। রাষ্ট্রে প্রত্যেকের ধর্মপালনের স্বাধীনতা থাকা দরকার। রাষ্ট্র সেটাকে যেমন বিনা কারণে বাধা দেবে না, আবার কারো প্রতি পক্ষপাত করবে না। ‘বিনা কারণ বা কারণ’ বলতে বোঝাচ্ছি, করোনা সংক্রামণের কারণে সৌদি আরব যেমন গণজমায়েত কম রাখার জন্য নিজেই হজপালন আর ধর্ম পালনের ব্যাপারে কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। বাস্তব তেমন কারণ ছাড়া, ধর্ম পালনে বাধা দেওয়ার দরকার কী। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে, সহিংসতা ঘটালে অবশ্যই বাধা দিতে হবে। কিন্তু ধর্ম পালন নিয়ে কটাক্ষ করাটা ঠিক হবে না। ধর্মের সমালোচনা থাকলে সেটা নিয়ে যৌক্তিকভাবে মতবিনিময় হতে পারে, বিজ্ঞানমনস্ক প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। বিভিন্নভাবেই ধর্মের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ নয়। মুসলমানদের কুরবানী উৎসবকে বলা হবে ‘বিভৎস’, আর পাশাপাশি হিন্দুদের দুর্গাপূজাকে বলা হবে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য।
এটা কি? ব্যাপারটা কি ধর্মনিরপেক্ষ হলো? মুসলামানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে আক্রমণ করে, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে প্রশংসা করা হলো। এটা কি পক্ষপাত নয়? ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো নয়? হিন্দু ধর্মেও প্রচুর বলি হয়। হিন্দুদের পূজায় কি বলি হয় না? রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের বিষয়বস্তু কী? ইতিহাসের সত্য না জেনে একপেশেভাবে আসলে ভদ্রলোকদের পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে বর্তমান সময়ের নানা বিপর্যয়ের বড় একটি কারণ। বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে কুসংস্কার যুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের বহু ইতিবাচক দিক আছে। যাকে আমরা বলি শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শন; একদা তা ধর্মমন্দিরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। গ্রীক নাটক, মহাভারত মহাকাব্য আর হিন্দুদের নাচ-গান, ইসলাম ধর্মের চিকিৎসাবিজ্ঞান আর জ্যোতির্বিদ্যা, দুঃখের গান মার্সিয়া, সূফীসঙ্গীত, বহুকিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দান। ইতিহাস না জেনে সারাক্ষণ শুধু ধর্মের নিন্দা করলে হয় না।
সত্যি যে, ধর্ম একেটা সময়ে এসে রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে সংগ্রামটা হতে সহনশীলভাবে। উগ্রভাবে নয়, মানুষের বহু বছরের বিশ্বাসকে আহত করে নয়। মানুষের কুসংস্কার বা তার ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগে। চাপিয়ে দিতে গেলেই বিপদ। বহুজন মনে করে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ধর্ম উঠে গিয়েছিল। ভুল ধারণা এটা। কাউকে জোর করে ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হয়নি। মনে করা হয়েছে, শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষ তা ধীরে ধীরে ত্যাগ করবে। লেনিন ধর্মের নানারকম সমালোচনা করেছেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না খুব স্পষ্ট করে তা বলেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, ধর্মীয় অবশেষগুলি অতিক্রম করা যায় শুধু মাত্র ধৈর্য ধরে লাগাতার ভাবাদর্শগত তালিম বা শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে, মার্কসবাদী বিজ্ঞানসম্মত বিশ্ববীক্ষার ব্যাপক প্রচার দিয়ে।’ তিনি সেই সঙ্গে বলেন, ‘মানুষের ধর্মীয় আবেগের অবমাননা করা চলবে না, কেননা তার ফলে তাদের বদ্ধধারণা শুধু বদ্ধমূলই হতে পারে আরো বেশি।’
লেনিন স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, ধার্মিক মানুষের কাছে ধর্ম আরো বেশি বদ্ধমূল হয় কী করে, কখন মানুষ ধর্মকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সেকারণে বারবার তিনি ধর্মকে অবমাননা করতে না করেছেন। মানুষের ঐতিহ্য বা বিশ্বাসগুলিকে হঠাৎ আক্রমণ না করার কথা বলেছেন সকল মার্কসবাদী ব্যক্তিত্বরা। রাশিয়ার বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির খসড়া কর্মসূচিতে ‘ধর্ম প্রসঙ্গ’ অধ্যায়ে লেনিন বহু কথা লিখে পরে বলেছেন, ‘ধর্মীয় বদ্ধ ধারণাগুলি থেকে মেহনতি মানুষকে বাস্তবিক মুক্ত করাই পার্টির লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বহুবিস্তৃত বৈজ্ঞানিক শিক্ষা এবং ধর্ম বিরোধী প্রচার পার্টিকে সংগঠিত করতে হবে। তবে ধর্মবিশ্বাসীদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত পড়াটা সযত্নে এড়িয়ে চলা আবশ্যক, কেননা অমন আঘাত পড়লে অন্ধ ধর্মোন্মাদনা শুধু বাড়াতেই আনুকূল্য হয়।’
খুব স্পষ্ট নয় কি, লেনিন কী বলতে চেয়েছেন? ফলে যারা মনে করে, সমাজতান্ত্রিক দেশ জোর করে ধর্মপালন করার অধিকার কেড়ে নেয়, সেটা ভুল। চীনে যেখানে ধর্মহীনের সংখ্যা ৭৪ শতাংশ, রাশিয়াতে সেখানে বর্তমানে ধর্মহীনের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি ফ্রান্সে প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। যুক্তরাষ্ট্রে ২৮ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। জার্মানিতে ৩৮ শতাংশ। ভিন্ন দিকে রোমানিয়ায় ৫ শতাংশ আর পোলাণ্ডে ৬ শতাংশ মানুষ ধর্মহীন। সুইজারল্যাণ্ডে, নরওয়ে, ডেনমার্ক এসব দেশে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশের অধিক। চীন ছাড়া সমাজতান্ত্রিক দেশে ধর্মহীনের সংখ্যা পুঁজিবাদী দেশগুলির চেয়ে কম। কারণ কী তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। চলবে