সমস্যার সমাধান ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে হবে না

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২১

বাংলার বিরাট সংখ্যক হিন্দু-মুসলমান কয়েকশো বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে গেছে। মানুষ তখন এখনকার চেয়ে অনেক কম শিক্ষিত ছিল, তবুও দীর্ঘকাল তারা মিলেমিশে রইলো কী করে? কিন্তু যখন আজ তাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের চেতনা বেড়েছে, তখন তারা আর হঠাৎ মিলেমিশে থাকতে পারছে না কেন? নিশ্চয় এর উত্তর খোঁজা দরকার। পুরানো ঘুণে ধরা চিন্তা আর আবেগ দিয়ে তার সন্ধান পাওয়া যাবে না। যুক্তি, পরিসংখ্যান আর বাস্তব মাঠে দাঁড়িয়েই প্রশ্নের উত্তরটা পেতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, সামন্ত যুগে ধর্মের যে প্রভাব ছিল এখন আর নেই। ধর্মের চেয়ে বাজার সংস্কৃতির প্রভাব মানুষের জীবন যাপনে, দৈনন্দিন কাজে অনেক বেশি। পুঁজিবাদ যেভাবে বিশ্বকে গ্রাস করে রেখেছে, সেখানে ধর্ম হলো ছাপোষা ব্যাপার মাত্র। গত একশো দশ বছরে ধর্মের কারণে আর কয়টা রক্তপাত ঘটেছে? যতো রক্তপাত সব ঘটেছে ভদ্রলোকদের দ্বারা। নাস্তিক হোক আর আস্তিক হোক সকলেই তারা বিজ্ঞানে এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বাসী ভদ্রলোক। দু’দুটা মহাযুদ্ধ ধর্মের কারণে ঘটেনি বা পশ্চাদপদ মানুষের দ্বারা ঘটেনি, পাশ্চাত্যের সবচেয়ে আধুনিক মানুষদের দ্বারা ঘটেছে যুদ্ধগুলো। দুটা মহাযুদ্ধে যত মানুষ মারা পড়েছে, যত মানুষ পঙ্গু হয়েছে, যত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে আর যে পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তুলনা ইতিহাসে আর নেই। ফলে ধর্মীয় দাঙ্গার কারণে এখন বড় বড় রক্তপাত ঘটছে, সেকথা বলাটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

দু’দুটা মহাযুদ্ধ বাদ দিলেও, আরো বিভিন্ন কারণে যেসব রক্তপাত ঘটেছে সেগুলোও পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ আর বাজার সংস্কৃতির কারণেই ঘটেছে। ধর্ম আর ধার্মিকদের উপর অনেক দোষ আমরা আসলে অকারণে চাপিয়ে দেই। পুঁজির খেলা বহু ধরনের অঘটন ঘটায়, কিন্তু তখন উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো হয়। ইঙ্গ-মার্কিন প্রচারণা বহুকাল ধরে সেই কাজটা করে যাচ্ছে। নিজেদের দখলদারী রক্ষার স্বার্থে সারা বিশ্বের মুসলমানদের তারা সন্ত্রাসী আর জঙ্গি বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। সেখানকার তেল-গ্যাস সম্পদ দখলের জন্য মুসলমানদের দেশ একটার পর একটা দখল করে চলেছে। মুসলমানদের দেশ দখলের ছুতো হিসেবে মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে প্রচার করেছে। নির্লজ্জের মতো বলেছে ‘ইরাক-ইরান মারণাস্ত্র তৈরি করছে সেটা অপরাধ’, কিন্তু নিজেরা মারণাস্ত্র তৈরি করছে প্রতিদিন। শুধু তৈরি নয় ব্যবহার করছে বিভিন্ন দেশে মানুষের উপরে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ভদ্রলোকদের চোখে সন্ত্রাসী নয় ভদ্রলোকদের চোখে সারা বিশ্বের একমাত্র সন্ত্রাসী হচ্ছে মুসলমান জনগণ। বর্তমানে ভারতীয় প্রচারণা ইঙ্গ-মার্কিন প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে।

জওহরলাল নেহরু তার সময়কালে তিনি জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত। ভারত সরকার এখন ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধী। ভারতীয় প্রচার মাধ্যম বহুদিন ধরেই বাংলাদেশকে জঙ্গী, মৌলবাদী দেশ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকারের বর্তমান পরিচয়টা কী? বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে? সরকারি দলিলেপত্রে দেখা যায় জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সতেরো বছরে দাঙ্গার সংখ্যা পাঁচ হাজার চারশো একান্নটা। কিন্তু তাই বলে কি ভারতকে সাম্প্রদায়িক দেশ বলা যাবে? কখনো না। ভারতে যখন মুসলমানদের উপর একদল হিন্দু আক্রমণ চালায়, সেখানে প্রতিবাদটা প্রথম আসে হিন্দুদের কাছ থেকেই। ভারতে গোহত্যার জন্য মুসলামানকে যারা হত্যা করেছে তারা যেমন হিন্দু, সেই হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে আবার বিরাট সংখ্যক হিন্দু। হিন্দু সাংবাদিক লেখকরা কলম ধরেছে তার বিরুদ্ধে। বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার সময়ে দলীয় প্রচারণায় যেমন বহু হিন্দু অংশগ্রহণ করেছে, ঠিক তেমনি অসংখ্য হিন্দু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদকারীদের সংখ্যাটাই অনেক বেশি। কিছু লোকের কাজ দিয়ে কি আমরা ভারতকে বিচার করবো? যখন সারাদেশের হিন্দুরা একজোট হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণে প্রতিবাদ করে, সে দেশটাকে কী করে একটা সাম্প্রদায়িক দেশ বলা যাবে? কয়েকজন শাসক বা কতিপয় শাসক তাদের ভোট বাড়াবার জন্য কী কৌশল অবলম্বন করলো, তারজন্য কি ভারত সাম্প্রদায়িক আর মৌলবাদী দেশ হয়ে গেল? যারা, মূল সত্য থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বারবার এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক বলে, তারাই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাড়িয়ে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক বলে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করা খুব শুভ লক্ষণ নয়। দুটি দেশের জনগণের মধ্যেও এই করে করে বিরোধ বাড়ছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। দুটি দেশের জনগণ মিলে, সকল পরাশক্তিদের সকল  কুচক্রীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার, মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য।

বাংলাদেশের বহু শিল্প-সাহিত্যে, বহু আলোচনায় এবং লেখনিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশের সকল দুর্দশার কারণ ধর্মীয় মৌলবাদীরা। মৌলবাদ শব্দটার খুব ভুল ব্যাখ্যা চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কি মৌলবাদীরা আছে? বাংলাদেশে যারা শাসক বা শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, তারা কি মৌলবাদী? বাংলাদেশের সামরিকবাহিনী বা আমলাতন্ত্র কি মৌলবাদীরা চালায়? বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি মৌলবাদীরা চালাচ্ছে? বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর যাদের নামে এসেছে, তারা কি কেউ মৌলবাদী? নাকি সকল বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত আধুনিক শিক্ষিত ভদ্রলোকরা? দুর্নীতবাজ এসব আধুনিক শিক্ষিতদের রক্ষা করবার জন্যই কি সব দায় মৌলবাদীদের উপর চাপানো হয়? নিশ্চয় যারা ধর্মীয়ভাবে কট্টর, তাদের বিরুদ্ধে অন্য সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিতরে ঘটে যাওয়া সকল সহিংসতার দায় তাদের উপর চাপানো হচ্ছে কেন? ধর্মীয় মৌলবাদী যাদের বলা হচ্ছে, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তাদের সঙ্গে একমত হতে পারে না। ধর্মীয়ভাবে কট্টর যারা, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে যেমন ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ের মিল নেই, ভিন্ন দিকে তারা কুসংস্কার আচ্ছন্ন আর পশ্চাদপদ। বিশেষ করে তারা নারীর অগ্রগতির বিরুদ্ধে। নানা কারণে তাদের চিন্তাভাবনা বা তাদের কার্যক্রমের আমি সমালোচক হলেও, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তাদের দ্বারা হচ্ছে; যুক্তিসঙ্গত কারণেই এ কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। রাষ্ট্রের সকল সঙ্কটের দায়ভার তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে সঙ্কটের সমাাধান হতে পারে না। বাংলাদেশের নাটকে প্রায়ই সময়ে খলনায়ক হয়ে এসেছে এসব মৌলবাদীরা। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়, জনগণের উপর শোষণ নির্যাতন, পাহাড়ীদের উপর অত্যাচারের ঘটনার সঙ্গে এরা কতোটা যুক্ত? কিন্তু এরাই নাটকে সাহিত্যে প্রধান খলনায়ক, ইতিহাসের কী চরম বিকৃতি! আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাটক নেই, বাজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নাটক নেই, মানুষ যে বাকস্বাধীনতা হারিয়ে বসে আছে তা নিয়ে নাটক নেই। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব দুর্নীতি হচ্ছে তা নিয়ে নাটক নেই। সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নাটক নেই। যতো দোষ নন্দঘোষ! রাতারাতি স্বঘোষিতভাবে ইতিহাস উল্টে দিলে তো হবে না। সেসব করে সস্তা বাজার মাত হয়, সমস্যার সমাধান হয় না। চলবে