সমস্ত বিসমিল্লাহর খুশবুতে

মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব

প্রকাশিত : মে ১১, ২০২২

জিকির আর ফাতিহায়

জলামনা জলামনা জলামনা
বড় গুনাহ করেছি গো রব্বানা।

বহু বৎসর আগে নকশেবন্দিয়া ত্বরিকার একটা পুস্তিকায় এমনই হৃদয়বিগলত মোনাজাত পড়েছিলাম। আপন সন্তান আর মুরিদদের দোয়া আর মোনাজাতের ত্বরিকা শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছিল এমনতর দেশীয় আমেজ নিয়ে। সুর আর দরদের পরিপূর্ণতা সহকারে। বাঙালি মুসলমানের মোনাজাতের ধরন আর আকুলতা নিয়ে আমাদের আগ্রহ আরও সুপ্রসারিত হতে পারার সুযোগ কত বেশি, তা আবার উপলব্ধি করতে পারলাম ‘মাওলানা’ কবিতাটা পড়তে গিয়ে।

হজরতে মজে আছে মাওলানা
দিলে বাজে রব্বানা
আমি মুক্তাদি রুকুতে শামিল
পড়ি সুবহানা।

মাওলানা ধীরে মধুর কিরাত করে
আমার ক্বলবে, গোপন রক্ত ঝরে।
নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজি
সুজুদে হয়েছি ফানাহ ফিল্লা।

আমাদের ফরিয়াদের মাধ্যমে খোদার প্রতি যেই মুহাব্বতের রিশতা সূচিত হয়, সেটার পরিপূর্ণতা ঘটে জগতে বহমান শব্দের সুন্দরতম ব্যবহারে৷ এই আহবানে তাই খোদাতায়ালা সাড়া না দিয়ে পারেন না। আমাদের যাপন আর বন্দেগির ভাষার সাথে পোয়েট্রির ভাষিক এবং সুগভীরভাবের যেই অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ এটাকে মেনে নিতেই হয়। নয়তো সেই কাব্যধারা অনেকটা নিজের সত্তাকে অস্বীকারের মতোন ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরে কাব্যস্রোত হারিয়ে ফেলে নিজের মঞ্জিলে পৌঁছবার সদর রাস্তাটা। কিন্তু মোনাজাত আর বন্দেগীর প্রগাঢ়তা আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে খোদার রহমতের কাছাকাছি। যেখানে পোয়েট্রি তার সর্বোচ্চ মর্যাদা হাছিল করে নেয়।

সূরা ইখলাসের পোয়েট্রি
চাইর লাইনের এই সূরা আল্লাতায়ালার পরিচয়ের সবচেয়ে সহজতম মাধ্যম হিসেবে আমাদের কাব্যচিন্তায় হাজির হয়। মানুষের চিন্তা আর ধ্যান তার আইডেন্টিটির সাথে জড়িত বিষয়। বান্দার সাথেও আল্লার পরিচয়ের সরল সূত্র হলো এই পরিচয়ের সরলতা। যা সূরা ইখলাসে স্পষ্ট। এই পরিচয় বান্দা এবং আল্লা উভয় দিক থেকেই দুনিয়াতে এমন এক বিপ্লবী রিশতার সূচনা করে যা বান্দাকে খোদার কাছাকাছি নিয়ে যেতে থাকে। তাই প্রথম কবিতাটা যখন এই সূরার ভাবের আবহ নিয়ে শুরু হচ্ছিল, ঠিক তখনই কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম বাকি কবিতাগুলোর গতিপথ কোনদিকে মোড় নিবে। এই সংশয় উহ্য রেখেই আল্লার নামে যেই পাঠ আর বিবেচনা, এই সাহসটুকু বান্দাকে সমূহ মুখাপেক্ষিতা থেকে দূরে সরিয়ে আল্লাহ এবং সৌন্দর্যের সবচেয়ে আকুল দিকটিকে উজ্জ্বল করিয়ে তুলতে পারে। কবিতায় এই তাড়না মোটেই নতুন কিছু নয়। তবে প্রতিটি ব্যক্তির দিক থেকে কবিতার মাধ্যমে আল্লার প্রতি আবেগ আর মুহাব্বতের এই নজরানা বাংলা ভাষায় সৌন্দর্যবর্ধনে ভূমিকা রাখে।

বাংলা ভাষায় মুসলমানের কবিত্বের লড়াই
বাঙালি মুসলমানরা কবিতা লিখতে পারে কিনা এই তামাশা চলে আসছে যুগ যুগ ধরেই। মুসলমানের কালচার আর ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দাবলির নূন্যতম উপস্থিতিকে বরদাস্ত করতে পারে নাই সেক্যুলার সাহিত্য বোদ্ধারা।  ফলে বারবার বাংলা ভাষা থেকে মুসলমানের আত্মার কাছাকাছি শব্দ আর ভাবভঙ্গিকে উপেক্ষার ভেতর দিয়েই কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হয়েছে। ভাষার এই কুরবানি কেবলমাত্র সেক্যুলারদের খায়েশকে চরিতার্থ করবার জন্যই হয়ে আসছে। ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ আর বিবৃত পরিমণ্ডলকে সংকুচিত করে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা চলে নানান মহল থেকে। এসব বাস্তব পরিস্থিতি সামনে রেখে মুসমানরা যখন কবিতা লিখতে বসে তখনই তার সামনে আপনা-আপনি একটা মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়ে যায়। না চাইতেও তাকে এই মোকাবিলার ময়দানে লড়াই করা লাগে। এই সংঘাত ভাষার ভেতরে যেই সহিংসতাকে উস্কে দেয় সেটা স্রেফ ভাষাতেই আটকে থাকে না। সমসাময়িক রাজনীতি, দখলদারিত্ব আর জুলুমের ভাষাও হয়ে উঠে এই একাধিপত্যবাদী সেক্যুলার ভাষা।

বাকি চাপা পড়ে যায় মুসলমানের জবানের উচ্চারণ। মুসলমানের কাব্যচিন্তা তাই একটা আরোপিত চাপের ভেতর দিয়ে প্রস্ফুটিত হবার কসরত করে। কুঁড়ি ফুটলেই ছিড়ে দিতে অগ্রসর হয় সেক্যুলার ক্ষমতার হাত। এই বলপ্রয়োগের বিপরীতে মুসলমানদের কাব্যচিন্তা আর কাব্যচর্চার ধারা কখনো থেমে যায়নি। তার ঐতিহ্য আর সিলসিলার সাথে উৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কবিতার তাড়না। সুর আর উচ্চারণের আকুলতা। আর সেটাকে সহি সেক্যুলার কাঠামো কোনোভাবেই দমিয়ে রাখতে পারে নাই। মুসলমান কবি উচ্চারণ করে বসে,

আমি মায়াবী আজান দেবো শোলাকিয়া মাঠে।
আমার সুজুদ হবে ধূল-ধূলি নীলাম্বরি ঘাসে।

বাংলাদেশের জলজ অথচ সতেজ আবেগের কাছাকাছি ভাষার উচ্চারণকে সর্বদা দাবিয়ে রাখা হয়। কবিতা লিখার পরে যেই স্বীকৃতি প্রশ্ন অনায়াসে এসে পড়ে এইক্ষেত্রে বাংলার ভূমি সংলগ্ন ভাষাকে পরাজিত ভাষা হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। এই বাংলায় যোহর হলে আজান হয়, ফসলের তপ্ত মাঠ ছেড়ে চাষা ভাইয়েরা ছুটে আসে যাবতীয় রুকু আর সিজদার গভীরতার দিকে। কিন্তু সেই দৃশ্য আর বাস্তবতাগুলো খুব কম কবিদের জবানে উচ্চারিত হয়। কবিতা মাত্রই সেক্যুলার একটা বাস্তবতাতে নিজের সমূহ সিলসিলা আর স্বাতন্ত্র্যবোধ হারানোর নিষ্ঠুর এক এন্তেজাম যেন বা।

হাওয়া এবং আপেল
হাওয়ার মতো সঙ্গী পুরুষের ভরসা হয়ে জন্ম নেয়। জগতে ঠিকে থাকার অবলম্বন, এমনকি কি সুন্দর উপলক্ষ্য হয়ে উঠা সেই সৌন্দর্য আমাদের ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় প্রতিভাত হওয়ারই কথা। হাওয়ার নিরাপত্তা বুঝি অস্থিত্ব প্রশ্নের সাথে জড়িত। নারীকে আবিষ্কারের এই সূচনা বেহেশতের পয়লা দিকে অনুভূতিগুলোর গুঞ্জরন থেকে উৎসারিত।

কেউ যেন হাত না দেয় তোমার নরম পালকে
অতি মনোরম স্পর্শকাতর জাদুর আপেলে।

নারী বলতে তার নিজের যে জার্নি কবিরা সেই দিকটারে খুব কমই খেয়াল করতে পেরেছেন। নারীকে দেখবার পুরুষালি অবস্থাতেই সে তার আশ্বস্ত বোধের সমগ্রকে নিরাপদ করে রাখতে চায়। ফলে নারীকে তার বোধ আর আগ্রহের জায়গা থেকে যে পর্যবেক্ষণ সেখানে স্রেফ Objective একটা নজর নারীর অস্থিত্বের দিকে নিপতিত থাকে। ফলে নারীর নিজের আবিষ্কার বুঝা, তার বন্দেগী বুঝা, আর আধ্যাত্মিকতা বুঝা বেশিরভাগ মানুষের (পুরুষের) পক্ষে দুঃসাধ্য কাজই বটে। নারী তো হাওয়া হয়ে দুনিয়ায় এলেন, আদমের আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে তাঁকে ছুটিয়ে নিলেন দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। হাওয়া আর আদমের যেই পরিপূরক বন্দেগী আর ফিলোসোফিক সত্তা সেসবের যুগোপৎ মোকাবিলা তাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। নারীকে তাই হাওয়া হয়ে উঠা লাগে। যার সেজদা আছে। তছবিতে যার বিরহ গীত কেঁপে কেঁপে ওঠে।

সমস্ত বিসমিল্লাহর কাব্যিক ক্যানভাস
কবিতায় ছায়া, আন্ধার আর আলো নির্মাণের ধাপগুলো দেখা গেলে কবিতার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। অন্তত কবিতার মকসুদ কি সেটা স্পষ্ট হয়। সবসময় যে এরকম দ্বিধা নাশ করে করে কবিতাকে সামনের দিকে এগোতে হয় ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। তবে কবিতা হলো স্পষ্ট হয়ে পড়বার ঝুঁকিটাকেও তোয়াক্কা না করার মনোভাব। পারতপক্ষে স্পষ্ট হলে কবিতার ভাবের রূপান্তর ঘটে। যেহেতু ভাষা দিয়েই কবিতা। তারপরেও ভাষা অতিক্রমের জন্য মানুষের যে নিরন্তর সাধনা তারও অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে যায় কবিতার ক্যানভাস।

মনে রেখো শিশু এই তারামাছগুলো
শিকারির কাছে কীভাবে লুটিয়ে পড়ে
আর দূরে পেঁপেগাছ মিউ মিউ করে।

within থেকে beyond এর দিকে কবিতার যেই সফরের ভাষা তা এক অদ্ভুত জগতকে নিজের একান্ত আপন করে নেয়। সেখানে ভাষার সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক এবং শৈল্পিক ব্যবহারের পরেও কোথাও জানি ভাষাটা গায়েব হয়ে যায়। পর্যবেক্ষণের দিকটি প্রকট করলে দেখা যায় তখন সেখানে কেবলই সুর-ই আছে। আর কিছু গীত জন্ম নিচ্ছে ধীরলয়ে। আবার যথার্থ উপলব্ধির অভাবে সে সুর হারিয়েও যাচ্ছে। বাংলা কবিতার বর্তমান সময়ের এই এক মুশকিল। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ তার কবিতাগুলোর বেশ কিছু জায়গায় নজরকাড়া কিছু সুরের জন্ম দিতে পেরেছেন। যেখানে ছায়া, প্রেক্ষাপট আর কম্পমান নজরের মধ্যেও সুরের হিম শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে কবিতার লাইনগুলো। এই স্নিগ্ধতা চোখের পলকে হারিয়ে যাবার নয়।

কল্পতরু কল্পতরু তোমার জানাজা হোক
মেঘনার জলে

বিসমিল্লাহর নেই শেষ হয়ে যাবার কোনোরূপ মানব নির্ধারিত সীমানা। এই অসীমের দিকে যেই কাব্যিক প্রবণতা গেল, তা কখনো সমাপ্তি রেখা ছুঁয়ে আগের জায়গায় ফেরার প্রতি আগ্রহী হতেই পারে নাই। এমন অনন্ত মনোযোগের তীব্রতা সেই বিসমিল্লাহর সুরে প্রবল হয়েছে যা উলটপালট করে দিয়েছে সীমাবদ্ধ ভাবের বাজারকে।

ভাবের বেচাবিক্রির সুযোগ নেই। ভাবের লেনাদেনা চলে। এবং তাও মুহাব্বতের খাতিরে। ভাবের বাজার বলতে আদতে যা আমাদের এখানে নানান ব্যক্তি আগ্রহের জায়গা থেকে পূজনীয় হয়েছে তার মধ্যে সীমাবদ্ধতার শেষ নেই। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যখন এই ভাবের বাজারগুলো ফাংশন করা শুরু করে তখন তাতে মানবীয় নানান বিকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই বিচ্যুতি থেকে পোয়েট্রি কিভাবে, কোন পথে রেহাই খুঁজবে তা নিয়ে ভাবার পরিবেশও যথাযথভাবে মওজুদ নেই এইদেশে। ফলে কাব্যের মাধ্যমে বিস্তৃতি পাওয়া অনাচারের বিপরীতে কাব্যের মধুরত্ব আর সিলসিলা সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ যখন নজরে আসে তখন মুগ্ধ হতে হয়। এবং দেখা যাবে সেইসব তালাশের শেষে এই লাইন এসে কাব্যের যেকোনো দুপুরকে রইদের তীব্রতায় উজ্জ্বল করে তুলতে চাইছে।

কোথাও আকাশ ভেঙে রোদ হানছে দুপুরে
আর মাটি ভেদ করে জাগছে সোনাটা।

ইউরোপের জিকির
ইউরোপের দিকে একান্ত সফরগুলো ব্যয়সাধ্য। এখন আবার সেই সফরের সাথে সৌভাগ্যের সংযোগ থাকাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেছে। তারপরেও ইউরোপের যাপিত গ্রামগুলোর দিকে একটা এশীয় মন উৎসুক থাকতে চায়। একটা ধীরস্থির ছোট ঝরনার স্রোত কবিতার পাড় ঘেষে এতো শান্তভাবে বয়ে যাবে এমনটা ভাবতেই ইউরোপের আচরণের সমূহ রূপান্তর ঘটে যায়। দূরে বায়োলিনের মরা মরা সুর ভেসে আসে। গির্জার ঘণ্টাতে যেনো সতর্ক সংকেত ধ্বনিত হতে থাকে। যেখানে আয়েশের বুঝি শেষে নেই। কিন্তু রুহটা কতোটা নিপতিত হইলো সেই চাহনির আগ্রহ একটা এশীয় নজরকে সদা জাগিয়ে রাখে।

হাম্মাম নেই যে গোসল করব
মানুষের ভাষা নেই যে প্রতিশোধ নেব।

এরপর দেখে যায় দূরে কোথাও একটা গ্রামে গেরস্তের মুরগিটা ফেরে নাই ঘরে। এমন সহজাত ইউরোপ যাদের কাব্যে কিঞ্চিৎ ঠাঁই পায়, তাও বাংলাতে, সেসব কবিতা আগ্রহ নিয়েই পড়ি। যেন বা অচেনা পথে শুরু হয়ে যাওয়া সফরের মাঝে একজন এসে এককাপ কফির অফার করলো। কিন্তু ইউরোপের কেবলা আর জিকির কি বন্ধ হয়ে আছে তবে। এই স্পন্দন শোনা যাচ্ছে না অনেকদিন। কেবলই একটা মহাযুদ্ধের খায়েশ ইউরোপের স্নিগ্ধতা আর নিয়ামতকে বাহাদুরিতে পর্যবসিত করে তুলছে। কিন্তু তবুও আমি বারংবার একটা ইউরোপীয় গ্রামের দিকেই সফরটা শুরু করতে চাইবো। এমনই অপরিচিত সবকিছু! অথচ খোদায়ী কায়েনাতের হিসসা বটে।

কবিতার মর্মে ডুবে শরীয়তের গান
কবিতা মানে সীমার ভেতরে সাধনা এবং একইসাথে সীমানা অতিক্রমের দুরন্ত সাহসের সুনিপুণ সমন্বয়। শরীয়ত মুসলমানের জীবনে একটা কাঠামো হিসেবে কাজ করে। তার আচরণের ভেতর সুনির্দিষ্ট আচরণের সীমা আরোপ করে দেয়। কাব্য এই সীমা মানতে পারে কি-না?  এইটা বেশ জটিল একটা আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠবে যদি আমরা সেই আগ্রহকে কেন্দ্র করে সামনে দিকে আগুয়ান হতে চাই তো। যেখানে আল্লা-রসূল নিয়ে কাব্যচর্চা হয়ে আসছে আমাদের অজানা সময়ের শুরুর বিন্দু থেকে। অধুনা এই আগ্রহে নানামুখী ঝোঁক প্রবল হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলা কবিতার চাঁচে যেই ইউরোপটা শরীল এলিয়ে দিয়েছে সেটা এইসব কাব্যপ্রবণতায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ঠাঁই পাচ্ছে। এমনকি আল্লা-রসূল নিয়ে লিখতে গিয়ে যেই সকল কাঠামোর প্রতি একরোখা কাব্যিক মনোভাবের দেখা মিলছে তা শেষাবধি কাব্যের স্বাদকে একঘেয়েমি Monotonous করে তুলছে। বাংলার ভাষিক প্রকল্পে এইভাবে কাঠামো আনলে যেই সাধনার দরকার হয় তা অধিকাংশের কাব্যে অনুপস্থিত।

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ তার অনেক কবিতার মধ্যে শরীয়তের বিধানকে অগ্রগণ্য করে তুলতে আগ্রহী থেকেছেন। ব্যাপারটাকে অনেকের মনে কাব্যের চাইতে বিধানকে অধিক প্রাসঙ্গিক করে তোলার প্রচেষ্টা কিনা, সেই জিজ্ঞাসাও জাগিয়ে দিতে পারে। আমি এই বিধান আসাটার ব্যাপার নিয়ে মোটেই নাখোশ না। তবে বিধানগুলো আসার বেলায় কাব্যে তা খুব স্পষ্টভাবে, অর্থ্যাৎ হুবহু ঘটনা হয়ে এসেছে। ফলে কাব্যের ভেতরে যে জলদি চলবার চিত্রটা তৈরি হচ্ছিলো আমি সেটা খেয়াল করেছি। কবি চাইলে এই দৃশ্যগুলোতে আরেকটু শ্লথ থাকতে পারতেন। ধীরেসুস্থে এগোতে দিতে পারতেন লাইনের প্রতিটি কদমকে। তাতে লাইনের মধ্যে বিধানের ফয়সালা প্রকট হলেও তার ভেতরে কাব্যের নিমগ্নতা যথার্থভাবে ঠাঁই নিতে পারতো।

কুরানের কন্দরের দিকে কবির সুতীব্র চোউখ
এই বইটির অনেকগুলো কবিতায় কুরানের বিভিন্ন আয়াতের বাংলায়ন হয়েছে। ভাবানুবাদ বললেই বেহতর হবে। তবে এখানে তর্জমা টার্গেট ছিলো না। টার্গেট ছিলো কুরানের মর্মার্থের দিকে যাবার প্রতি। এবং সেটা এতোটাই সরল গমন যে, কুরানের নিকট আশ্রয়ের মতোন প্রশান্তি মিলবে। যেমনভাবে আলাপে সালাপে হঠাৎ কেউ কুরানের আয়াতের দিকে গেলে যেমনটা অনুভব হয়, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর বেশ কয়েকটি কবিতা পাঠের সময়ও তেমনটা মনে হয়েছে। কুরানের যে অন্তর্গত যোগাযোগের রশ্মি মানবীয় সিনার সাথে জুড়ে থাকে, তার সাথে কবিতার মতো দরদ যুক্ত হলে কি যে হতে পারে তা ভাষায় কখনো ব্যাখ্যা করা যাবে না। কবিতার মতো আধ্যাত্মিক আগ্রহের জায়গায় কুরানের সাথে যখন মুহাব্বতের রিশতা গড়ে উঠলে, তখন স্রেফ তর্জমা পাঠে করলেও তেলাওয়াতের সমুদ্রে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করবে।

কুরান যে হেরার কন্দর থেকে মানবের সিনায় এসে রাজ করলো তার ইতিহাস, তার সর্বস্ব বুঝে উঠার অন্যতম একটা রাস্তা হলো কবিত্বের স্পন্দন। কবিরা কুরানের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে যেই তর্জমার সন্ধান পান, সেটাতে তারা নিজেদের একান্ত বান্দা হিসেবে আবিষ্কার করেন।

কবিদের কেন যে মনে হয় তারা খোদার বান্দা হতে পারবে না! কুরানে নিশ্চয় এইসকল ফ্যাসাদের জবাব থেকে থাকবে।  তবে কবিদের যেই যাতনাবোধ তা অতো বিশেষ কিছুও না, বিশেষত মডার্ণ টাইমে মানুষের সুখ-দুখের মাত্রাগুলো মোটামুটি অভিন্ন। ফলে এখানে কবিকে ভাবুক হয়ে উঠতে হয়। বিশেষ অর্থেই যেটা চাপানো কর্তাসত্তা হিসেবে নিজের ভেতরে ধারণের চাপ। ফলে কবিতাতে আল্লার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছেদের যে ঘটনা কবিরা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় করে যান, তার বিপরীতে কবিতায় বিশ্বাসের আকুলতা দেখতে পাওয়াটা খুবই আশাব্যঞ্জক।

বন্ধুত্বের বিপরীতে কবিতা
এই কবিতার বইটির অনেকগুলো কবিতা আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ`র বন্ধুদের সাথে স্পষ্টত দ্বন্ধের ফলশ্রুতি। প্রতিক্রিয়া খারাপ অমন মত আমি দিতে চাচ্ছি না। তবে এই প্রতিক্রিয়াগুলোর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে পুরোনো বন্ধুদের চেহারা। বন্ধুত্বের বিপরীতে আমি কবিতাকেও দেখতে চাইবো না। সেই বন্ধুত্ব পুরোনো হয়ে গেলে, বন্ধুত্বের রিশতা টুটে গেলে সেই স্মৃতিগুলোকে বড়জোর criminalize করা থেকে বিরত থাকবো। তো এই বন্ধুত্বের বিপরীতে গড়ে উঠা কবিতাগুলোকে আদর্শিক দ্বন্ধের ফিরিস্তি হওয়াকেই নিজের নিয়তি বানিয়েছে। বিশেষ করে ইসলামের আকিদাগত ব্যাপারে দ্বন্ধ নিয়ে বন্ধু থাকা-না থাকা প্রশ্নের সুরাহা করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন কবি। যদিও ত্বরিকা ভিন্ন হয়ে যাবার দুঃখ সেসব কবিতায় স্পষ্ট। তবে আরেকজন সাবেক বন্ধুর বিরুদ্ধে কবিতায় মতামত দিতে গিয়ে, তার আদর্শিক বিচ্যুতিকে খুলাসা করে দেবার মহারণে নেমে পড়েছেন আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ।

অথচ কুব্রত, চিরদিন বুক চিতাইয়া আসে আমার মুসলমানি কবিতায়।

বন্ধুত্বের বিপরীতে জবাবদিহিতা মূলক এই কবিতাগুলোকে তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, পাঠকের সাথে যোগাযোগহীন ভাবের বাহন হয়ে থাকবে। যেখানে আদতে যোগাযোগহীন হয়ে আছে বন্ধুত্বের রিশতাটাই। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখানে কবির কবিতাগুলো একজন বিশ্বাসীর কবিতা বলে মনস্থির করতে পেরেছি। এই ক্ষেত্রে তিনি কোনো ধরনের সমঝোতায় আগ্রহী না। সেটার জন্য প্রয়োজনে তিনি বন্ধুত্ব নাশের মতো ঘটনা ঘটায়ে দিতে প্রস্তুত। ফলত তার কাব্যভাষার যে দৃঢ়তা বা আক্রমণাত্মক অভিব্যক্তি সেসব এই কাব্যিক আবেগকে সমর্থন দিয়ে যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব যে নাশ হইলো!

রবীন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্ব কিংবা অভিমান
রবীন্দ্রনাথ নামটাকে আপনি আমি যতো প্রচেষ্টা করেই কেবল সাহিত্যিক গণ্ডিতে আটকে রাখতে চাই না কেন, তিনি ঠিকই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন। বিশেষত মুসলমানের কালচারাল অভ্যস্থতার সাথে রবীন্দ্রনাথের যে বিরোধ কিংবা সন্ধি তার ব্যবহারিক আচরণ আমরা সহজেই দেখি। সেক্যুলার সংস্কৃতি আর একাডেমির সাথে রবীন্দ্রনাথের যেই আত্মীয়তা সেটা বাংলাদেশে রবীন্দ্র রাজনৈতিক প্রকল্পকে বাস্তবায়নের কাজই করে চলেছে।

তারপরও ২২ শে শ্রাবণ আসলে পরে
একটা রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে বইসা থাকে।
সব কথা শোনার পরও তিনি কোথাও চইলা যান না।
আমার ভাষার মধ্যে চুপিচুপি নৌকা চালাইয়া যান।

রবীন্দ্রনাথ এখানে কালচারের অবয়বে হাজির হয়ে বাংলাদেশের পলিটিক্যাল বোধের জায়গাগুলোতে নিজের স্পষ্ট প্রভাব জাহির করেন। এই রবীন্দ্র বোধের সচেতনতা আর বিকাশ বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব কালচারের জাগবার সম্ভাবনাকে রুখে দিচ্ছে। এবং এই রুখে দেবার যজ্ঞে সাঁয় আছে রাষ্ট্রের পরিচালনাকারীদের। তারাও এই রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ে বাংলাদেশে সেক্যুলার ভাবগাম্ভীর্যের বিকাশকে প্রচার প্রসারে সরাসরি সংযুক্ত। অর্থ্যাৎ, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রচারণা পেতে থাকা একটা রাজনৈতিক প্রকল্প। বাংলাদেশের অন্য কোনো সাহিত্যিক এমন সৌভাগ্যবান হতে পারেন নাই।

রবীন্দ্র ধারণা বিকাশের এই শক্তিটা শুধুমাত্র কালচারের শক্তি না। এর সাথে পলিটিক্যাল পাওয়ারের যোগাযোগ আছে। খাতির আছে ভারতীয় আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাযন্ত্রের সাথে। ফলত রবীন্দ্রনাথ ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বাংলাদেশে উনার কালচারাল লিগ্যাসি তুলে ধরতে পারছেন।

রসূলের কদমে নিবেদিত কবিতা
মুস্তফা জানে রহমতের উম্মতের মাঝে এমন খুবই কম কবি আছেন, যারা তাদের রসূলের জন্য কিছু লিখেননি। আর যখন প্রশ্ন আসে রসূলের শানে কবিতা লিখবার, তখন তারা তাদের আবেগ আর উচ্ছ্বাসের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন রসূলের প্রতি বিরচিত প্রতিটি লাইনের জন্য।

কবিদেরও যাকাত দিতে হয়। কবিতারও যাকাত আছে। কেননা যার ভেতর কবিত্ব আছে তার মতো সম্পদশালী এই দুনিয়ায় আর কে বা আছে! আর মুসলমান কবিরা তাদের কবিত্বের যাকাত দেন তাদের রসূলের শানে কবিতা রচনা করে। এটা শত শত বছর ধরে চলে আসা সেই ঐতিহাসিক ধারা যার মধ্যে শিল্প আর আধ্যাত্মিকতার চুড়ান্ত উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে। কিন্তু এইসব রচনা খুব একটা স্বীকৃতি পায়নি মডার্ণ লিটারেচারের কাছ থেকে। যদিও এই সমৃদ্ধ ধারাটি কোনোভাবেই কোনো জাগতিক স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী না।

খোদা তুমি জানো আমি কবিতা লিখি
আমার ভাব জাগে দিনেরাতে
কাজে আর অবসরে, ঘুমে নির্ঘুমে
এই বাঁশপাতা, এই শিয়াফুল প্যাপিরাসে
কথার ময়ূর ফলাই
অক্ষরে অক্ষরে চাঁদের নৌকা চড়াই।

এই বইটিতে আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ অনেকগুলো লাইন রচনা করেছেন, যেখানে তিনি রসূলের শানে নিজের মুহাব্বত ইজহার করেছেন। কবিরা তাদের রসূলকে ভালো না বেসে পারেন না। কবিতার যেই কোমল আর সংবেদনশীল অগ্রযাত্রা, সেটা রসূলের প্রতি মুহাব্বতের মধ্য দিয়েই পরিপূর্ণতা পায়। ইশকে মুস্তফা মুসলমানদের মর্যাদাকে বুলন্দ করে।

রসূলকে ব্যথা পেতে দেখে যে কবিতাগুলো মরমী হয়ে উঠে
রসূল মানে রসূলের ইহকালীন জীবনের বাস্তবতাগুলোকেও বুঝায়। এবং এতে চাক্ষুষ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যতোদূর দেখবো কখনো মুগ্ধ হবো, আবার কখনো দুঃখে চোখ ভেজাবো। কিন্তু দৃশ্যের বাইরেও রূপান্তর আছে। আর রসূলের ক্ষেত্রে এইসব আরোবেশি সত্য। কিন্তু রসূলের আঘাতপ্রাপ্ত হবার দৃশ্যগুলোর বর্ণনা একজন কবির দৃঢ় সংবেদনশীলতাকে পর্যন্ত তছনছ করে দিতে পারে। বিপরীতভাবে, শতো মুশকিলের মাঝে রসূলের যেই রাহমাতুল্লিল আলামিন হয়ে উঠা, এই ইনকিলাব দুনিয়ায় আর কারো সামর্থ্যে ছিলো না। ফলত এখান থেকে কবিরা জন্ম দেন কবিতার এমন এক মরমী সুরের যা দরুদ আর দরদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।

গুপ্ত হিজাজের গলি___লুকিয়ে থাকে ছুরি আর তরবারি
যেন জিহ্বা থেতলে যায় পাথরে আর আগুন লাগে
খুলি ও তন্দ্রা__পুড়ে খাক খাক গুল গুলিস্তা।

তবুও কবিতার খুশবু রয়ে যায়

নিঃস্ব হয়ে পড়ে থাকি লাল গালিচায়।
পিউ কাঁহা রব, জলপাইপাতার গন্ধ বাতাসে
যেন শরীর ধুয়ে দিয়েছে হাদিসে পাওয়া দুধ।

সমস্ত কবিতাগুলো একনাগাড়ে পাঠের পর একটা ভারি বোঝা হয়ে উঠে প্রতিক্রিয়া জানানোর সম্ভাব্য উপায়গুলো। ফলে যেটুকু চুপ থাকা যায় না, সেসব অনুভূতি নিছক চুপ থাকাতেই রাজি থাকতে চায় না। এই বইয়ের কবিতাগুলোর প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যবোধ ধরে রাখতে গিয়ে কবিতাগুলোর ভেতর সুরের বৈচিত্র‍্যতা যেভাবে জেগে উঠবার কথা ছিলো তা হয়নি। অনেকগুলো লাইনে শব্দের দ্বিত্বতার ফলে কিছুটা সুরের আমেজ জেগে উঠছিলো। পরবর্তীতে সেই আমেজ বেশিদূর গড়িয়ে যেতে না দেখাটা আফসোস জাগিয়েছে। একান্ত মুগ্ধ হয়ে যে সুরের মানসিক ছোঁয়া শব্দের-দ্বিত্বতা আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলো, সেসবের অনুপস্থিতি কবিতাগুলোর আন্তরিক ভার্সন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছিলো। কিন্তু এসব তো কবি ওবায়দুল্লাহ`রই কবিতা। বাকি কারো এতে কলম চালানোর মানে তো যুদ্ধ যোষণার শামিল! তবে মনে মনে সে লড়াই একজন রিডার চালায়ে যেতেই পারেন। এই যে হৃদয়ের তুমুল আজাদী আর তার বিস্তার, কবিতা এখানে এসে মুক্তির চূড়ান্ত ধারণাগুলোকে ক্রমাগত অতিক্রম করে যেতে থাকে।

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ এই বইটির কবিতা প্রকল্পে আধ্যাত্মিক বিবেচনাবোধ আর অনুভূতির সহজাত প্রকাশভঙ্গীগুলোকে ঘিরে একটা বিষদ কাজের আঞ্জাম দিতে চেয়েছেন। কিন্তু যেই তাড়াহুড়ো পাঠককে সুস্থিত হতে দিবে না, সেটা একইসাথে কবিতার মর্মকেও খানিকটা দিগভ্রান্ত করে তুলতে পারে।

তবে গোটা কবিতার বইটিতে তালাশের নানামুখী স্রোত এসে কলবের অস্থিরতার রেখাগুলোতে আছড়ে পড়তে চাইবে। যেনো অবিরাম পেরেশানির মধ্যেও আছে প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশ।

লেখক পরিচিতি: কবি

একুশে বইমেলা ২০১৮