সমরেশ বসুর গল্প ‘আদাব’

প্রকাশিত : মার্চ ১২, ২০২০

কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ ৬৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘আদাব’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

রাত্রির নিস্তবতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল। শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছে। দাঙ্গা বেধেছে হিন্দু আর মুসলমানে। মুখোমুখি লড়াই দা, সড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে। তাছাড়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্তঘাতকের দল— চোরাগোপ্তা হানছে অন্ধকারকে আশ্রয় করে।

লুঠেরা-রা বেরিয়েছে তাদের অভিযানে। মৃত্যু-বিভীষিকাময় এই অন্ধকার রাত্রি তাদের উল্লাসকে তীব্রতর করে তুলছে। বস্তিতে বস্তিতে জ্বলছে আগুন। মৃত্যুকাতর নারী-শিশুর চীৎকার স্থানে স্থানে আবহাওয়াকে বীভৎস করে তুলছে। তার উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সৈন্যবাহী-গাড়ি। তারা গুলি ছুড়ছে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে।

দুদিক থেকে দুটো গলি এসে মিশেছে এ জায়গায়। ডাস্টবিটা উল্টে এসে পড়েছে গলি দু`টোর মাঝখানে খানিকটা ভাঙাচোরা অবস্থায়। সেটাকে আড়াল করে গলির ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল একটি লোক। মাথা তুলতে সাহস হলো না, নির্জীবের মতো পড়ে রইল খানিকক্ষণ। কান পেতে রইল দূরের অপরিস্ফুট কলরবের দিকে। কিছুই বোঝা যায় না। —“আল্লাহু-আকবর’ কি ‘বন্দেমাতরম্।

হঠাৎ ডাস্টবিটা একটু নড়ে উঠল। আচম্বিতে শিরশিরিয়ে উঠল দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা। দাঁতে দাঁত চেপে হাত পা-গুলোকে কঠিন করে লোকটা প্রতীক্ষা করে রইল একটা ভীষণ কিছুর জন্য। কয়েকটা মুর্হত কাটে। ...নিশ্চল নিস্তদ্ধ চারিদিক।

বোধ হয় কুকুর। তাড়া দেয়ার জন্যে লোকটা ডাস্টবিষ্টাকে ঠেলে দিল একটু। খানিকক্ষণ চুপচাপ।। আবার নড়ে উঠল ডাস্টবিনটা, ভয়ের সঙ্গে এবার একটু কৌতুহল হলো। আস্তে আস্তে মাথা তুলল লোকটা, ওপাশ থেকেও উঠে এলো ঠিক তেমনি একটি মাথা। মানুষ! ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী, নিস্পন্দ নিশ্চল। হৃদয়ের স্পন্দন তালহারা ধীর...। স্থির চারটে চোখের দৃষ্টি ভয়ে সন্দেহে উত্তেজনায় তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। উভয়ে উভয়কে ভাবছে খুনি। চোখে চোখ রেখে উভয়েই একটা আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে থাকে, কিন্তু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো পক্ষ থেকেই আক্রমণ এল না। এবার দুজনের মনেই একটা প্রশ্ন জাগল হিন্দু, না মুসলমান? এ প্রশ্নের উত্তর পেলেই হয় তো মারাত্মক পরিণতিটা দেখা দেবে। তাই সাহস করছে না কেউ কাউকে সে কথা জিজ্ঞেস করতে। প্রাণভীত দুটি প্রাণী পালাতেও পারছে— ছুরি হাতে আততায়ীর ঝাপিয়ে পড়ার ভয়ে।

অনেকক্ষণ এই সন্দিহান ও অস্বস্তিকর অবস্থায় দুজনেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। একজন শেষ অবধি প্রশ্ন করে ফেলে— হিন্দু, না মুসলমান? আগে তুমি কও। অপর লোকটি জবাব দেয়।

পরিচয়কে স্বীকার করতে উভয়েই নারাজ। সন্দেহের দোলায় তাদের মন দুলছে। প্রথম প্রশ্নটা চাপা পড়ে, অন্য কথা আসে। একজন জিজ্ঞেস করে,—বাড়ি কোনে?
বুড়িগঙ্গার হেইপারে—সুবইড়ায়। তোমার?
চাষাড়া-নারাইণগঞ্জের কাছে।..কী কাম করো?
নাও আছে আমার, না`য়ের মাঝি। তুমি?
নারাইণগঞ্জের সুতাকলে কাম করি।

আবার চুপচাপ। অলক্ষ্যে অন্যায়ের মধ্যে দু`জনে দু`জনের চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে উভয়ের পোশাক-পরিচ্ছদটা খুটিয়ে দেখতে। অন্ধকার আর ডাস্টবিনটার আড়াল সেদিক থেকে অসুবিধা ঘটিয়েছে।...হঠাৎ কাছাকাছি কোথায় একটা শোরগোল ওঠে। শোনা যায় দুপক্ষেরই উন্মত্ত কণ্ঠের ধ্বনি। সুতাকলের মজুর আর নাওয়ের মাঝি দুজনেই সন্ত্রস্ত হয়ে একটু নড়েচড়ে

—ধারে-কাছেই য্যান লাগছে। সুতা-মজুরের কণ্ঠে আতঙ্ক ফুটে উঠল।
—হ, চল এইখান থেইক্যা উইঠা যাই। মাঝিও বলে উঠল অনুরূপ কণ্ঠে।
সু-মজুর বাধা দিল: আরে, না না—উইঠো না। জানটারে দিবা নাকি?

মাঝির মন আবার সন্দেহে দুলে উঠল। লোকটার কোনো অভিপ্রায় নেই তো! সুতা মজুরের চোখের দিকে তাকাল সে। সুতা-মজুরও তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই বলল, বইয়ো। যেমুন বইয়া রইছ—সেই রকমই থাকো।

মাঝির মনটা ছাঁৎ করে উঠল সুতা-মজুরের কথায়। লোকটা কি তাহলে তাকে যেতে দেবে না নাকি। তার সারা চোখে সন্দেহ আবার ঘনিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল—ক্যান?
ক্যান্? সুতা-মজুরের চাপা গলায় বেজে উঠল— ক্যান্ কি, মরতে যাইবা নাকি তুমি?
কথা বলার ভঙ্গিটা মাঝির ভালো ঠেকল না। সম্ভব-অসম্ভব নানারকম ভেবে সে মনে মনে দৃঢ় হয়ে উঠল। যামু না কি এই আন্দাইরা গলির ভিতরে পইড়া থাকুম নাকি?
লোকটার জেদ দেখে সুতা মজুরের গলায় ফুটে উঠল সন্দেহ। বলল তোমার মতলবড়া তো ভালো মনে হইতেছে না। কোন জাতির লোক তুমি কইলা না, শেষে তোমাগো দলবল যদি ডাইকা লইয়া আহ আমারে মারণের লেইগা?
—এইটা কেমুন কথা কও তুমি? স্থান-কাল ভুলে রাগে-দুঃখে মাঝি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। —ভালো কথাই কইছি ভাই; বইয়ো, মানুষের মন বোঝো না? সু-মজুরের গলায় যেন কী ছিল, মাঝি একটু আশ্বস্ত হলো শুনে। —তুমি চইলা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি?

শোরগোলটা মিলিয়ে গেল দূরে। আবার মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ হয়ে আসে সব—মুহূর্তগুলিও কাটে যেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতো। অন্ধকারে গলির মধ্যে ভাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী ভাবে নিজেদের বিপদের কথা, ঘরের কথা, মা-বউ ছেলেমেয়েদের কথা... তাদের কাছে কি আর তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। তারাই থাকবে বেঁচে, কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ কোখেকে বজ্রপাতের মতো নেমে এল দাঙ্গা। এই হাটে-বাজারে দোকানে এত হাসাহাসি, কথা কওয়াকওয়ি—আবার মুহূর্ত পরেই মারামারি, কাটাকাটি—একেবারে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল সব। এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে? কি অভিশপ্ত জাত। সূতা-মজুর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। দেখাদেখি মাঝিরও একটা নিশ্বাস পড়ে।

বিড়ি খাইবা? সুতা-মজুর পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে বাড়িয়ে দিলো মাঝির দিকে। মাঝি। বিড়িটা নিয়ে অভ্যাসমতো দু`একবার টিপে, কানের কাছে বার কয়েক ঘুরিয়ে চেপে ধরল ঠোটের ফাঁকে। সুতা-মজুর তখন দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছে। আগে লক্ষ্য করেনি জামাটা কখন ভিজে গেছে। দেশলাইটাও গেছে সেঁতিয়ে। বার কয়েক খস্ শব্দের মধ্যে শুধু এক-আধটা নীলচে ঝিলিক দিয়ে উঠল। বারুদ ঝরা কাঠিটা ফেলে দিল বিরক্ত হয়ে।
—হালার ম্যাচবাতিও গেছে সেঁইয়া। আর একটা কাঠি বের করল সে। মাঝি যেন খানিকটা অসবুর হয়েই উঠে এল সুতা-মজুরের পাশে।
—আরে জ্বল জ্বলব, দেও দেহিনি—আমার কাছে দেও। সুতা-মজুরের হাত থেকে দেশলাইটা সে প্রায় ছিনিয়েই নিল। দু`একবার খসখস্ করে সত্যিই সে জ্বালিয়ে ফেলল একটা কাঠি।
—সোহান আল্লা! –নেও নেও—ধরাও তাড়াতাড়ি।...ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সুতা-মজুর। টেপা ঠোটের ফাঁক থেকে পড়ে গেল বিড়িটা।
—তুমি...?
একটা হালকা বাতাস এসে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল কাঠিটা। অন্ধকারের মধ্যে দু`জোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়ো বড়ো হয়ে উঠল। মাঝি চট্‌ করে উঠে দাঁড়াল। বলল—হ আমি মোছলমান। কী হইছে?
সুতা-মজুর `ভয়ে ভয়ে জবাব দিল—কিছু হয় নাই, কিন্ত... মাঝির বগলের পুটলিটা দেখিয়ে বলল, ওইটার মধ্যে কী আছে?
—পোলা মাইয়ার লেইগা দুইটা জামা আর একখান শাড়ি। কাইল আমাগো ঈদের পরব জানো?
—আর কিছু নাই তো! সুতা-মজুরের অবিশ্বাস দূর হতে চায় না।
—মিথ্যা কথা কইতেছি নাকি? বিশ্বাস না হয় দেখো। পুঁটলিটা বাড়িয়ে দিল সে সুতা-মজুরের দিকে।
—আরে না না ভাই, দেখুম আর কী। তবে দিনকালটা দেখছ তো? বিশ্বাস করন যায়— তুমিই কও? হেই ত` হক কথাই। ভাই তুমি কিছু রাখ-টাখ নাই তো?
—ভগবানের কিরা কইরা কইতে পারি একটা সুইও নাই। পরানটা লইয়া অখন ঘরের পোলা ঘরে ফিরা। যাইতে পারলে হয়। সুতা-মজুর তার জামা কাপড় নেড়েচেড়ে দেখায়।
—আইচ্ছা...মাঝি এমনভাবে কথা বলে যেন সে তার কোনো আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। আইচ্ছা—আমারে কইতে পারনি—এই মাই’র দইর কাটাকুটি কিয়ের লেইগা?
সুতা-মজুর খবরের কাগজের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে, খবরাখবর সে জানে কিছু। বেশ একটু উয়কণ্ঠেই জবাব দিল সে-দোষ তো তোমাগো ওই লিগওয়ালাগোই। তারাই তো লাগাইছে হেই কিয়ের সংগ্রামের নাম কইরা।

মাঝি একটু কটুক্তি করে উঠল—হেই সব আমি বুঝি না। আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী। তোমাগো দু’গা লোক মরব, আমাগো দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব?
—আরে আমিও তো হেই কথাই কই। হইব আর কী, হইব আমার এই কলাটা—হাতের বুড়ো আঙুল দেখায় সে। তুমি মরবা, আমি মরুম, আর আমাগো পোলা-মাইয়াগুলি ভিক্ষা কইরা বেড়াইব। এই গেল সনের ‘রায়টে` আমার ভগ্নিপতিরে কাইটা চাইরটুকরা কইরা মারল। ফলে বইন হইল বিধবা আর তার পোলা মাইয়ারা আইয়া পড়ল আমার ঘাড়ের উপুর। বই কি আর সাধে। ন্যাতারা হেই সাততলার উপুর পায়ের উপুর পা দিয়ে হুকুম জারি কইরা বইয়া রইল আর হালার মরতে মরলাম আমরাই।
—মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি; নাইলে এমুন কামড়া-কামড়িটা লাগে কোয়? —নিল ক্রোধে মাঝি দু`হাত দিয়ে হাঁটু দুটোকে জড়িয়ে ধরে।
—হ।
—আমাগো কথা ভাবে কেডা? এই যে দাঙ্গা বাধল—অখন দানা জুটাইব কোন্ সুমুন্দি; নাওটারে কি আর ফিরা পামু? বাদামতলির ঘাটে কোন্ অতলে ডুবাইয়া দিছে তারে—তার ঠিক কি? জমিদার রূপবাবুর বাড়ির নায়েমশয় পিত্যেক মাসে একবার কইরা আমার নায়ে যাইত নইরার চরে কাছারি করতে। বাবুর হাত য্যা হজরতের হাত, বখশিশ দিত পাঁচ, নায়ের কোয়া দিত পাঁচ, একুনে’ দশটা টাকা। তাই আমার মাসের খোরাকি জুটাইত হেই বাবু। আর কি হিন্দুবাবু আইব আমার নায়ে।

সুতা-মজুর কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। একসঙ্গে অনেকগুলি ভারী বুটের শব্দ শোনা যায়। শব্দ যেন বড় রাস্তা থেকে গলির অন্দরের দিকেই এগিয়ে আসছে সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। শঙ্কিত জিজ্ঞাসা নিয়ে উভয়ে চোখাচোখি করে।
—কী করব? মাঝি তাড়াতাড়ি পুঁটলিটাকে বগলদাবা করে। —চলো পলাই। কিন্তক যামু কোনদিকে? শহরের রাস্তাঘাট তো ভালো চিনি না। মাঝি বলল, চলো যেদিকে হউক। মিছামিছি পুলিশের মাইর খামু না, ওই ঢ্যামনাগো বিশ্বাস নাই।
—হ। ঠিক কথাই কইছ। কোনদিকে যাইবা কও—আইয়া তো পড়ল।
—এইদিকে।

গলিটার যে মুখটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেদিকে পথনির্দেশ করল মাঝি। বলল, চলো, কোনো গতিকে একবার যদি বাদামতলি ঘাটে গিয়া উঠতে পারি—তাইলে আর ডর নাই।
মাথা নিচু করে মোড়টা পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে তারা ছুটল, সোজা এসে উঠল একেবার পাটুয়াটুলি রোডে। নিস্তব্ধ রাস্তা ইলেকট্রিকের আলোয় ফুটফুট করছে। দুইজনেই একবার থমকে দাঁড়াল—ঘাপটি মেরে নেই তো কেউ? কিন্তু দেরি করারও উপায় নেই। রাস্তার এমোড়ে ওমোড়ে একবার দেখে নিয়ে ছুটল সোজা পশ্চিমদিকে। খানিকটা এগিয়ে এমন সময় তাদের পিছনে শব্দ উঠল ঘোড়ার খুরের। তাকিয়ে দেখল—অনেকটা দূরে একজন অশ্বারারোহী এদিকেই আসছে। ভাববার সময় নেই। বাঁ-পাশে মেথর যাতায়াতের সরু গলির মধ্যে আত্মগোপন করল তারা। একটু পরেই ইংরেজ অশ্বারারোহী রিভালবার হাতে তীব্র বেগে বেরিয়ে গেল তাদের বুকের মধ্যে অশ্বখুরধ্বনি তুলে দিয়ে। শব্দ যখন চলে গেল অনেক দুরে, উকিঝুঁকি মারতে মারতে আবার তারা বেরুল।

কিনারে কিনারে চলো। সুতা-মজুর বলে। রাস্তার ধার ঘেঁষে সন্ত্রস্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে তারা।
খাড়াও।
মাঝি চাপা-গলায় বলে। সুতা-মজুর চমকে থমকে দাঁড়ায়। কী হইল?
এদিকে আইয়ো। সুতা-মজুরের হাত ধরে মাঝি তাকে একটা পানবিড়ির দোকানের আড়ালে নিয়ে গেল।
হেদিকে দেখো।

মাঝির সঙ্কেত মতো সামনের দিকে তাকিয়ে সুতা-মজুর দেখল প্রায় একশো গজ দূরে একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরের সংলগ্ন উঁচু বারান্দায় দশ বারোজন বন্দুকধারী পুলিশ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের সামনে ইংরেজ অফিসার কী যেন বলছে অনর্গল পাইপের ধোঁয়ার মধ্যে হাত মুখ নেড়ে। বারান্দার নীচে ঘোড়ার জিন্ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি পুলিশ। অশান্ত চঞ্চল ঘোড়া কেবলি পা ঠুকছে মাটিতে।

মাঝি বলে—ওইটা ইসলামপুর ফঁড়ি। একটু আগাইয়া গেলে ফাড়ির কাছেই বাঁয়ের দিকে যে গলি গেছে হেই পথে যাইতে হইব আমাগো বাদামতলির ঘাট। সুতা-মজুরের সমস্ত মুখ আতঙ্কে ভরে উঠল। তবে?
—তাই কইতাছি তুমি থাকো, ঘাটে গিয়া তোমার বিশেষ কাম হইব না। মাঝি বলে, এইটা হিন্দুগো আস্তানা আর ইসলামপুর হইল মুসলমানগো। কাইল সকালে উইঠা বাড়িত যাইবা গা।
—আর তুমি?
—আমি যাইগা। মাঝির গলা উদ্বেগে আর আশঙ্কায় ভেঙে পড়ে। আমি পারুম না ভাই থাকতে। আইজ আটদিন ঘরের খবর জানি না। কী হইল না হইল আল্লাই জানে। কোনোরকম কইরা গলিতে ঢুকতে পারলেই হইল। নৌকা না পাই সাঁতরাইয়া পার হমু বুড়িগঙ্গা।
—আরে না না মিয়া করো কী? উৎকণ্ঠায় সুতা-মজুর মাঝির কামিজ চেপে ধরে। —কেমনে যাইবা তুমি, আঁ? আবেগ উত্তেজনায় মাঝির গলা কাঁপে।
—ধইরো না, ভাই ছাইড়া দেও। বোঝো না তুমি কাইল ঈদ, পোলা মাইয়ারা সব আইজ চান্দ দেখছে। কত আশা কইরা রইছে তারা নতুন জামা পিনব, বাপজানের কোলে চড়ব। বিবি চোখের জলে বুক ভাসাইতেছে। পারুম না ভাই-পারুম না—মনটা কেমন করতাছে। মাঝির গলা ধরে আসে। সুতা-মজুরের বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে। কামিজ ধরা হাতটা শিথিল হয়ে আসে।
—যদি তোমায় ধইরা ফেলায়?—ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে।
—পারব না ধরতে, ডৱাইও না। এইখান থাইকা য্যান উইঠো না। যাই ভূলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার লগে মোলাকাত হইব। আদাব।
—আমিও ভুলুম না ভাই—আদাব। মাঝি চলে গেল পা টিপে টিপে।

সু-মজুর বুকভরা উদ্বেগ নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ধুকধুকুনি তার কিছুতে বন্ধ হতে চায় । উৎকর্ণ হয়ে রইল সে, ভগমান্— মাজি য্যান বিপদে না পড়ে।
মুহূর্তগুলি কাটে রূদ্ধ-নিশ্বাসে। অনেকক্ষণ তো হলো, মাঝি বোধ হয় এতক্ষণে চলে গেছে। আহা পোলা মাইয়ার কত আশা নতুন জামা পরবে, আনন্দ করবে পরবে। বেচারা ‘বাপজানের পরান তো। সু-মজুর একটা নিশ্বাস ফেলে। সোহাগে আর কান্নায় বিবি ভেঙে পড়বে মিয়াসাহেবের বুকে।
‘মরণের মুখ থেইকা তুমি বাঁইচা আইছ?‘ সুতা-মজুরের ঠোটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল, `আর । মাঝি তখন কী করবে? মাঝি তখন—

ধ্বক্ করে উঠল সুতা-মজুরের বুক। বুট পায়ে কারা যেন ছুটোছুটি করছে। কী যেন বলাবলি করছে। চিৎকার করছে।
—ডাকু ভাতা হ্যায়।
সু-মজুর গলা বাড়িয়ে দেখল পুলিশ অফিসার রিভলবার হাতে রাস্তার উপর লাফিয়ে পড়ল। সমস্ত অলটার নৈশ নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দুবার গর্জে উঠল অফিসারের আগ্নেয়াস্ত্র। গুড়ুম, গুড়ুম। দুটো নীলচে আগুনের ঝিলিক। উত্তেজনায় সুতা-মজুর হাতের একটা আঙুল কামড়ে ধরে। লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠে অফিসার ছুটে গেল গলির ভিতর। ডাকুটার মরণ আর্তনাদ সে শুনতে পেয়েছে।
সুতা-মজুরের বিহ্বল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার পোলা মাইয়ার, তার বিবির জামা শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে। মাঝি বলছে—পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিনে। দুশমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগোর কাছে।