সৈয়দ আলী আহসান
সভ্য সংস্কৃতি ও জ্ঞানের কালচার এ দেশে তৈরি হয়নি
মিনহাজুল ইসলামপ্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২০
আত্মজীবনী বিষয়টার প্রতি আমার অনেক আগে থেকেই আগ্রহ। আমি মনে করি, মানুষ যতই ক্ষমতাধর কিংবা যত কিছুই করে ফেলুক না কেন, তার আত্মসমর্পণ করতেই হয়। একেকটা আত্মজীবনী একেকটা আত্মসমর্পণের কাহিনি। আর এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মানুষ তার আসল সত্তাকে উন্মোচন করে কিংবা যা সে প্রকাশ করে না তাও প্রকাশ করার ইঙ্গিত দিয়ে দেয়, বাকিটা পাঠকের কাজ। আত্মজীবনী লেখার মতো যোগ্যতা, বিবেক কিংবা সাহস সবার হয় না। অনেক বিখ্যাত চিন্তাবিদের আত্মজীবনী নেই কিন্তু অনেক কুখ্যাত লোকেরও আত্মজীবনী আছে। তার মধ্যে আমার পড়া আইয়ুব খানের আত্মজীবনীর কথা বলতে পারি।
আত্মজীবনী গ্রন্থ আমার মতে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব সবকিছুকে ধারণ করে। মোঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবরের আত্মজীবনী পড়ে মনে হয় যে, যে যত ক্ষমতাধর সে ততই ভীরু সেটা খোদার প্রতি হোক কিংবা অন্য কিছুর প্রতি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দুই খণ্ডের আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছিল, একজন আশাবাদী প্রবীণ অধ্যাপকের ক্লান্তির নিঃশ্বাস। বদরুদ্দীন উমারের আত্মজীবনী পড়ে বোঝা যায় সেই ব্রিটিশ আমলের তরুণ বাঙালি মুসলমান যুবকদের চিন্তাধারা এবং প্রতিবাদী ভাবনা। বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী পড়ে উপলব্ধি হয়েছে একজন খাঁটি সাহিত্যিকের কল্পনাবিলাসিতা এবং নান্দনিকতা।
সৈয়দ আলী আহসানের লেখা আত্মজীবনীটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় এবং প্রভাবিত করেছে আমাকে। আত্মজীবনী কী করে লিখতে হয় তার একটা নিদর্শন তার দুইখণ্ডের আত্মজীবনী ‘জীবনের শীলান্যাস’। আমার মতে, সব পণ্ডিতের উচিত নয় রাজনৈতিকভাবে বিপ্লবী হওয়া কিংবা সারাক্ষণ শোষণের প্রতিবাদের ও বিপ্লবের ফেনা তুলে শত শত কাগজ কালি নষ্ট করা। কারণ ইতিহাস একভাবে আগায় না এবং সুষ্ঠু ইতিহাস বর্ণনা করার দায়িত্বও কারোর কারোর নিতে হয়। সৈয়দ আলী আহসান সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। সে নীরব ছিলেন সবসময়। কিন্তু নীরব থেকে সে যা করতে পেরেছেন এই স্বাধীন দেশের শত শত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ এবং শত শত কাগজে লেখা কলাম লেখক তার এক অংশও করতে পারেনি।
কয়েকজনের নীরব থাকতে হয়। এই নীরবতার জন্য তার কপালে অনেক গালমন্দ জোটে কলঙ্কও জোটে। আসলে মানুষ যত জানে ও শেখে তত তার দায় বেড়ে যায়। সেই অজস্র দায়ের স্রোতে তখন পণ্ডিত খাবি খায়। আলী আহসান খাবি খায়নি, বুদ্ধিমানের মতোই নীরব থেকেছেন এবং তার মতো করেই অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন। শুনেছি, আলী আহসান ইসলামপন্থী বলে তাকে নিয়ে বা তার লেখালেখি নিয়ে আলোচনা হয় না। তা আমার প্রশ্ন, স্বাধীন দেশে কোন সেকুলার লিবারেল বুদ্ধিজীবি কি করতে পেরেছে? আর বিপ্লবের ফেনা যারা তুলেছে কোথায় তারা? যারা হুঙ্কার দিয়েছে যে, ক্ষমতার নিকটে থাকবো না, তারা ক্ষমতার নিকটে না থেকে লিখতে পেরেছে একটা বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত? বরং তারা এখন কোথায়?
চিল্লাপাল্লা হাউকাউ চেঁচামেচি করে কখনই কিছু হয়েছে? অন্তত এই দেশে? বরং অনেক পণ্ডিতই নীরব ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এত হাউকাউ, তা সে যদি ওই সময় ইংল্যান্ড থেকে দুটো পিএইচডি না করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা না শুরু করতো তাহলে তার কন্ট্রিবিউশন কই থাকতো? তার এসব শোষণের বিরুদ্ধে লেখা ওই লোকাল একটা বামপন্থি পত্রিকায় ছাপতো নেহাত। তার এত সুন্দর জীবন্ত লেখার বিকাশ ঘটতো কিনা সন্দেহ। আমরাও বঞ্চিত হতাম। সবকিছু একরোখা চিন্তা বা একদিক থেকে দেখলে হবে না। আত্মজীবনী মানেই স্বীকারোক্তি। এই স্বীকারোক্তি লেখার কিংবা বোঝার সামর্থ্য ও মেধা সবার হয় না। বার্ট্রান্ড রাসেলের আত্মজীবনী যেদিন শেষ করলাম সেদিনই বুঝলাম যে, তার আর কোনও রাজনৈতিক বই এবং সমাজতাত্ত্বিক বই বিশেষ করে পড়া আমার উচিত হবে না। নেহাত তার গবেষণার বই বাদে (এনালিটিকাল ফিলোসফি)। কারণ এত দীর্ঘ হায়াত রাসেল পেয়েছেন এবং এত ক্রিটিকাল চিন্তা সে সারাজীবন ধরে করেছেন, শেষ জীবনে এসে সে এক প্রকার খাবি খেয়েছেন, কোনও সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি, শিশুর মতো আচরণ করেছেন বিংশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ মেধাবি মানুষ। কতই না অবদান তার জ্ঞানের রাজ্যে।
ওই সময়ের বিপ্লবের নামে গোটা ইউরোপে যা চলছিল সেখান থেকে ইংল্যান্ড বিশেষ করে মুক্ত রেখেছিলেন তার ঘরানা ক্যামব্রিজকে, তৈরি করেছিলেন নিজেদের দার্শনিক মুভমেন্ট। আমাদের একটা বার্ট্রান্ড রাসেল দরকার ছিল, অবশ্যই তার মতবাদ নয় (আমি রাসেলের সাথে সবচেয়ে বেশি দ্বিমত পোষণ করি), বরং তার মতো নীরব পণ্ডিতকে। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত মানুষ এখন শুধুই ক্লান্ত। একই সিনেমা চলছে। বিপ্লব, আন্দোলন, হরতাল, ক্ষমতা, পলিটিক্স সবকিছু। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একটা ভালো সভ্য সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের কালচার তৈরি হয়নি। নৈতিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয় হয়েছে। অধর্মের একপ্রকার স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়েছে এদেশে। অনেকে বলবে সেজন্য একটা স্ট্যাবল পলিটিকাল কন্ডিশন এন্ড সিচুয়েশন লাগে। আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করবো। কারণ ইতিহাস তার এই যুক্তির পক্ষে নাই।