সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘শশধর মিত্র মৃত’
পর্ব ২
প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২২
রাত দুটো বেজে ৩৪ মিনিট
হায় মেরা দিল, চুরাকে লে গয়া, চুরানেওয়ালা, মেরা কাতিল...
ফাঁকা রাস্তায় অটো ছুটছে হেব্বি জোরে। গান চলছে। রাজু আজ বিন্দাস মুডে। রুমকি আজ তার সঙ্গে অনেক কথা বলেছে। রুমকি অটোচালক রাজুর প্রেমিকা। রাজু ডোমের বাচ্চা সিধুর ল্যাংটো বয়সের বন্ধু। কিন্তু আজকে যেন সিধু বেমক্কা চুপ মেরে আছে। সিধুর হাতে গিলে মেটের প্লাস্টিকটা দেখে রাজু জিজ্ঞেস করেছিল, এতরাতে মাংস পেলি কোথায়?
সিধু বলেছিল, শফিকুলের কাছ থেকে।
সিধুর জন্যে রেখে দিয়েছিল সে। শফিকুল ওদের বাড়ির সামনের বাজারের কাছেই একটা পাইস হোটেলে কাজ করে। মানে মাংস ধোয়, সবজি কাটে, খুন্তি নাড়ে... এইসব। ওই আভিজাত্যের আলোয়ান গায়ে জড়ানো সভ্যগণ যাদের অবলীলায় ইতর-টিতোর, ছোটলোক-ফোক বলে থাকে আর কী!
যাই হোক, সিধু এতক্ষণে পকেট থেকে রক্তমাখা কাপড়ে মোড়ানো চৌকি মালটা গিলে মেটের কালো প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে নিয়েছে। বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ছে এখনও। সিধুর চোখে, কপালে ফোঁটা ফোঁটা জলের ছাট এসে পড়ছে। রাজুর অটোকে বাজেভাবে চেপে দিয়ে কোণঠাসা করে একটা দামি গাড়ি জোরে ইংলিশ গান বাজিয়ে চলে গেল।
রাজু চিৎকার করে উঠল। গলা বের করে বলল, এই বানচোৎ... শুয়ার... বাপের রাস্তা?
সিধুর ভাবনার ঘোর কাটে। সে বলে ওঠে, ছাড় না বাল! দেখে চল।
রাজু অটোয় স্টার্ট দেয় ফের। চলতে শুরু করে। কিন্তু গজর গজর করে বলে চলে, শালা! ফুটানি দেখিয়ে গাড়ি মারাচ্ছে! দিতাম ঠুকে, ওরই দামি গাড়ি যেত চুলকে! তখন বুঝত। আমার অটো ভাই, দিব্যি ছুটত! দামি গাড়ি ঠুকে গেলে লাখ টাকার ব্যাপার।
বলেই জোরে হেসে ওঠল নিজেই।
পেছনের সিটে সিধু ভেবে চলে। সে এতক্ষণ যা ভাবছিল সেগুলোই। লোকটার নাম কি? কি করত লোকটা? নিজের শরীরের মধ্যে কি জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল সে? কেউ নিজের শরীরে এরকম কিছু বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে? বেঁচে থাকতে পারে? সিধুর মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় চলন্ত বাসে পকেটমার ধরা দেখেছিল সে। তাকে বাস থেকে নামিয়ে পাবলিক মেরে ধরে অনেক কিছু পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল। এমন কি গলার মধ্যেও নাকি কেটে পকেট করা থাকে ওদের! হাঁ করিয়ে পকেটমারের মুখের ভেতর থেকে আংটি বের করেছিল পাবলিক সেবারে, তার মনে আছে।
সিধু ভাবার চেষ্টা করে লোকটার বউ ছিল কিনা? নিজের মতো করে একটা বউয়ের চেহারা কল্পনা করেও নেয়। নিশ্চয় শিক্ষিত চেহারা হবে। অথবা বউ মারা গেছে আগেই। বুড়ো পরে চলে গেল। ছেলেমেয়েরা হয়তো বাবার বডি দান মেনে নেয়নি, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আর কি করবে? দানই করতে হলো। সিধু একবার ভাবে, বডি দানই ভালো। সৎকারের খরচাটা অনেকটা কমে যায়।
রোদ্দুর রায়কে পুলিশে ধরেছে জানিস? রাজু বলে ওঠে।
কে? অন্যমনস্ক হয়েই প্রশ্ন করে সিধু।
আরে রোদ্দুর রায়। মালটা খিস্তি খেউর করে না ইউটিউবে? শালা ভাগ্যিস আমাদের কেউ দিনভর রেকর্ড করছে না, নইলে বড়লোক-ছোটলোক, অফিসার-ডাক্তার সব অন্দর হয়ে যেত। খিস্তি কে দেয় না বল... রাজু ব্রেক কষে।
ওদের গন্তব্য এসে গেছে। বস্তি ঢোকার আগে মাঠে অটো রাখে রাজু। সিধু নামে অটো থেকে। বলে, খিস্তি সবাই দেয়। কেউ ঘোমটার তলায় লুকিয়ে চুরিয়ে, আর কেউ সিনা টানকে।
রাজু অটো ঢাকতে ঢাকতে বলে, তোর কি হয়েছে বল দিনি? রুমকির ব্যাপারে কিছুই জানতে চাইলি না? বিয়ের কথা হলো কিনা, শুনলি না! সব ঠিক আছে তো?
সিধু এগোতে থাকে। বলে যায়, সব ঠিক আছে!
রাজু চেয়ে থাকে সিধুর দিকে।
বস্তির মধ্যে টিউব কলের পাশেই সিধুর বাড়ি। সিধু এসে চটি খুলতেই রানি পর্দা ফাঁক করে দেখে। নাইটি পরে রানি টিভিতে সিরিয়াল চালিয়ে মোবাইলে গেম খেলছিল। রঙিন বুদবুদ ফাটানোর গেম। এই এক নেশা তার। আফিমের চেয়েও বিশাল! খাওয়ার সময়, কথা বলার মধ্যে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সব সময় গেম খেলে রানি। সিধু অনেক বলেছে কিন্তু গেমের নেশা যায়নি তার বউয়ের। রানিই বা সিধুর কথা শুনবে কেন? সেও জেদ করে বলেছে, আমি খেলি তো তোর কি? গায়ে ফোস্কা পড়ে? মানুষ তো আর মারছি না!
সিধু বাড়ি ফিরেছে দেখে সে মোবাইলে চোখ রেখেই এগিয়ে আসে একটু। সিধুর হাতে কালো প্লাস্টিক দেখে বলে, এত রাতে রান্না হবে? আমি পারবো না। আমি তো ভেবেছি তুই গিলে মেটের ঝোল আনবি সাফিকুলের দোকান থেকে।
সিধু বিরক্ত হয়ে বলে, কতক্ষণ লাগে মাংস করতে? ভাত আছে না?
রানি জেদ দেখায়। বলে, ভাত না রুটি আছে। রান্না আমি এখন করতে পারব না। আমার শরীল বলে কি কিছু নেই?
সিধু ভেতর থেকে একটা গামলা এনে তাতে প্লাস্টিক বসিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাংস ধুতে। সে-ই রান্না করবে।
টিউব কলের সামনে সিধুকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ওপরে গেঞ্জি নিচে শুধুই জাঙ্গিয়া পরে সে কালো প্লাস্টিক খুলে গিলে মেটে গামলায় ঢালে। সঙ্গে পৎ করে কাপড়ের মোড়ানো মালটাও পড়ল। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় কাপড়টাকে লাল সালুর কাপড় মনে হচ্ছে। রক্তটা শুকিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে সিধু কাপড়টা খোলে। ভেতরে একটা চামড়ার তৈরি ছোটো বই গোছের কী যেন! সিধু আলোতে তুলে একটু দেখে। চামড়াটাও কীরকম অদ্ভুত লাগছে। কিসের চামড়া এটা? কি বই? প্রথম পাতাটা খুলতেই সিধু আরো অবাক হলো!
মুক্তোর মতো হাতের লেখায় লেখা রয়েছে প্রতিটা পাতায়। ঝরঝরে বাংলায়। ডায়েরি তাহলে এটা? সিধুর গামলায় গিলে মেটেতে মাছি বসছে, উড়ছে! ল্যাম্প পোস্টের চারপাশে পোকা উড়ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। সিধু কষ্ট করে পড়ার চেষ্টা করল।
লেখা রয়েছে, যিনি এক্ষণে এই রচনাটি পড়িতেছেন তাহার প্রতি নমস্কার জানাইয়া আমি শুরু করিতেছি, আমার নাম শশধর মিত্র। আমার সম্পূর্ণ পরিচয় আপনি ক্রমশ পাইবেন। একটু বিলম্ব করিয়া শুরুতেই বলিয়া লই, এই সাধু ভাষায় কতজন সাবলীল তাহা লইয়া আমার যথেষ্ট উদ্বেগ রহিল, সেজন্যে আমি চালিত কথ্য ভাষায় বাকি কথা লিপিবদ্ধ করিতেছি। যদি অতি ভদ্র কেহ এ লেখা পেয়ে থাকেন তিনি ক্ষমা করিয়া এটিকে দিবেন। আশা করি, আপনি এই কথ্য ভাষা সহ্য করিতে পারিবেন। আর যদি এই ভাষার সহিত পরিচিত কেহ এইটি পাইয়া থাকেন তাহার উদ্দেশ্যে পরবর্তী ভাষা এক উন্মুক্ত বাতাস আনিয়া দিবে। কাজেই কথ্য ভাষার প্রয়োগ শুরু হইল।
যে এই লেখাটা এখন গিলছেন তাকে আমি সোজাসুজি জানাচ্ছি যে, আমার সমস্ত কিছু মানে আমার যা কিছু ছিল বা এখনও আমার মৃত্যুর পরেও আছে আমি তার নামে অর্থাৎ পাঠক তোমার নামে করে গেলাম। স্থাবর অস্থাবর সব কিছু। আমার সাতকুলে কেউ নেই। তুমি ধরে নিতেই পারো যে, তোমার শিকে ছিঁড়ল, লটারি পেয়েছ তুমি!
সিধু তো তাজ্জব হয়ে গেছে পড়ে প্রথম পাতা! ঘরের মধ্যে থেকে রানি ডেকে ওঠে, সিধু... এই সিধু... মাংস ধুতে এত টাইম লাগে? সেই আমাকেই রাঁধাবি তো?
বউয়ের চোখ কিন্তু মোবাইল থেকে ওঠেনি এখনও। চলবে