সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’
পর্ব ৮
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৬, ২০২১
বললাম, মন খোলা রাখব।
বিনু দারোয়ান আমার দিকে হেসে বলল, সঠিক তিনটে শব্দ। এসো।
এই বলে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে থাকলেন। আমিও তাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। লোকটা আমায় নিয়ে একটা বস্তির মধ্যে ঢুকে গেল। রোদের আলো ঢোকে না এরকম সব বাড়ি। কাপড় কাচছে কেউ, কেউ পাশেই রান্না করছে। দুটো ছেলে ছুটে চলে গেল আমাদের গায়ের উপর দিয়েই। এদের কতজনকে বিনু দারোয়ান চেনে! হাত নেড়ে, মাথা নেড়ে তারা স্বাগত জানালো লোকটাকে। লোকটাও ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে একটা ঝুপড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
এখানে ইস্কুল বাড়ি? জিজ্ঞেস করলাম।
এটাই শর্টকাট। বলে বিনু দারোয়ান দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে এলো আমাকে।
ঘরের মধ্যে কিচ্ছু দেখার জো নেই। অন্ধকার ঘুটঘুটে। সে দরজা বন্ধ করে একটা সুইচ টিপতেই দেখি, সারা ঘরের আনাচে কানাচে আলো জ্বলে উঠল। একটাই ঘর। ছোট। ছোট বললেও ভুল বলা হয়। একরত্তি বলা চলে বোধহয়। ঘরের মধ্যে ছোট বড় অ্যাকোয়ারিয়াম ঠাসা! তাতেই আলো জ্বলছে। নীল, সবুজ, গোপালি, হলুদ... কতরকমের রঙিন মাছ সেগুলোর মধ্যে। বিনু দারোয়ান আমায় কিছুটা দেখে নেবার সময় দিলেন। তারপর বললেন, আমার ছোট ছেলে রঙিন মাছের ব্যবসা করত। হাওড়ার এক জায়গা থেকে চুনো মাছ ধরে আনত, তারপর তাদের বড় করে আবার সেখানেই দিয়ে আসত। ছেলেটা মরে গেল ট্রেনে কাটা পড়ে। হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছিল। ঘাম হাতে হ্যান্ডেল স্লিপ করে গেছিল... ও মাঝে মাঝে আসে।
ফিরে আসে? কৌতূহলে মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো।
হ্যাঁ। এই রঙিন জলের মধ্যে ওর কথা শুনতে পাই। যেন বুদবুদ থেকে শব্দগুলো ভেসে আসে। তুমি এখানে থাকলে তুমিও শুনতে পাবে। বিনু দারোয়ান ঘরের একপাশে একটা থলে থেকে কী যেন বের করে খাটের ওপর রাখছে। আমি দেখলাম, সেগুলো কাগজের গোলাপি ঘূর্ণি খেলনা। উইন্ডমিল। দুটো ওইরকম উইন্ডমিল বের করে একটা আমার হাতে দিয়ে বলল, উঁচু করে ধরো। আর নিজেকে হালকা করে দাও।
আমি এক হাতে উইন্ডমিলটা উঁচু করে ধরে বললাম, নিজেকে হালকা করব কি করে?
বাড়তি যা কিছু নিচে ফেলে দাও। অহংকার, ঘেন্না, অভিমান... সব। তারপর নিজেকে ধোঁয়ার মতো কল্পনা করো। মনে করো, তোমাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর তুমি অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছ, অনেক উঁচুতে।
বিনু দারোয়ানকে আর দেখতে পেলাম না। আমি চোখ বন্ধ করতেই আমার মনে পড়ে গেল, একবার ছোটবেলায় ছাদের পাঁচিলে উঠেছিলাম। নিচের দিকে তাকাতেই পেটের মধ্যে একটা কেমন যেন ভাব গুরগুর করে উঠেছিল...
পাখি! পাখি! পাখি!
আমারই ভুল! এত পাখি নয়। মাছ! মাছ! মাছ! প্রচুর ঝাঁকে মাছ আকাশজুড়ে সাঁতরে যাচ্ছে। আর আমি যেন তাদের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছি হাতে উইন্ডমিল নিয়ে। কখন যেন নরম ঘাসের গন্ধ পেলাম। আমার কপালে হাত বুলিয়ে আমায় ডাকছে ঘুম।
আমি এসে গেছি? ইস্কুল বাড়ি? কোল থেকে উঠে আমি এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম।
তুমি ইস্কুলবাড়িতেই আছো। আমার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে। ঘুম আলতো হাসি রেখে কথাটা বলল। তারপর ঘাস থেকে উঠে আমার দিকে সুন্দর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এসো, সবাই অপেক্ষা করছে।
এই ডাকের মধ্যে একটা সম্মোহন আছে। আমি উঠে গেলাম। ঘাসের ওপর দিয়ে আমি আর ঘুম হেঁটে যেতে থাকলাম সোজা। সামনেই ভাঙাচোরা টিকে থাকা ইস্কুলবাড়ি। সেখানে কাঠবিড়ালি খাওয়া শেখানো হয়, বেঞ্চে বকুল ফুল ছড়ানো থাকে। নিশ্চয়ই রতনদা ওখানেই আছে। ঘুম আমার হাতে নিজের পাঁচটা আঙুল সেলাই করে নেয়ার মতো করে জড়িয়ে নিল। বলল, আমায় ছেড়ে চলে গেলে তুমি স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাবে। যেও না কখনও, লক্ষ্মীটি। এভাবেই থেকো, চুপ করে একপাশে। আর কিছু চাই না।`
আমি ওর দিকে চেয়ে বুঝলাম। আমি আর জেগে উঠতে চাই না। আমাদের পায়ের কাছে কাঠবিড়ালিরা ভিড় করে আছে। তাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টি আমাদের দিকে... চলবে