সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’
পর্ব ৪
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০২১
রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে গলির মোড়ে। আমি আসবো, ও ঘুরে তাকাবে, আমি ওকে হাত ধরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি দেখাবো। তারপর বসন্ত কেবিনের মধ্যে আমরা মিলিয়ে যাব গোপনীয়তায়।
আমি পুরোটাই দেখলাম আমার চোখের সামনে। আমার মনে হলো, পুরো ঘটনাটা যেন একটা অ্যাকুয়ারিয়ামের মধ্যে ঘটছে। আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করছি। আমার মন আছে কিন্তু মনোযোগ নেই। বারবার মনে হচ্ছিল, রাত্রি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এই ঘটনার ঠিক বছর দুয়ের মধ্যে। সঙ্গে আমার লেখা একটা নাটক নিয়ে যাবে। যেটা আমি করব বলে ইচ্ছে ছিল খুব। আমি ওকে বারণ করব না, আমি জানি।
বুকের মধ্যে আবার করে একটা চাপ অনুভব করলাম। মনে হলো, আমি অনেকক্ষণ দম বন্ধ করে জলের তলায় ডুবে আছি। এবার একটু শ্বাস নেয়া দরকার। আমি শরীর হালকা করে দিলাম। আর তরতর করে ওপরে উঠে আসছি, উঠছি, উঠছি। মাথা তুললাম বাথরুমের জলভর্তি বাথটবে। আমি একা নগ্ন স্নানঘরে জলের তলায় কি করছিলাম?
উঠে গা হাত পা মুছে বাইরে এসে দেখি, আমার ঘরের ডান দিকের দেয়ালে যে ঋত্বিক ঘটকের ছবিটা আছে, সেটার দিকে চেয়ে একজন সাদা চুলের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সামনে যেতেই লোকটা আমার দিকে ফিরে বললেন, নন্দনের নাম ঋত্বিক সদন হওয়া উচিত। রবীন্দ্র সদনের পাশে একটা প্রোলেতারিয়েত...
আমি বললাম, আপনি, আপনি সুবিমল মিশ্র না?
ভদ্রলোক আমার থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না। আমি শ্যাডো। শ্যাডো আমার ছদ্মনাম। তুমি অপরাধ করেছ। তোমার তিনটে অপরাধের ক্ষমা আমরা করেছি কিন্তু আর অপরাধ করতে দেয়া যায় না। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। চলো।
আমার কোনো ধারণাই নেই ইনি কি বলছেন! বললাম, কি করেছি আমি?
তাতে লোকটা হেসে বললেন,মৃত্যু নিয়ে এত লিখছ কেন? জীবন নিয়ে কি কিছু নেই লেখবার? মৃত্যুর ওপারে যাতায়াত, অতীতে অবারিত উঁকি দেয়া আর দিনকেদিন বাজারি হয়ে যাওয়ার অপরাধে তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
ভদ্রলোক একটা ভি আর চশমা নিজে পরে আরেকটা আমাকে দিয়ে বললেন, নরক দর্শনে। যুধিষ্ঠিরের যেমন হয়েছিল। কিংবা দান্তের, জানো তো? এটা পরে নাও। তারপর চুপ করে আমার হাতটা ধরে বসে থাকো।
আমি বাধ্য দাস। আমার চোখের সামনে রামধনু খেলে যেতে লাগল। আমি দেখলাম, একটার পর একটা দৃশ্য সরে সরে যাচ্ছে আর আমি ওড়ার মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। যেভাবে মেঘ আকাশকে কাটিয়ে এগিয়ে যায়...
তুমি ঠিকই চিনেছো। আমি সুবিমল মিশ্র। মানুষ আমার লেখাকে ব্ল্যাসফেমির তোকমা দিয়ে এসেছে। আমি তোমায় নরক দেখবো না তো কে দেখাবে... চলে এসো...
আমার সামনে একটা বিস্তৃত জঙ্গল খুলে গেল... মাদল বাজচ্ছে, গান আসছে আর আমার হাত ধরে আমায় আরও ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন সুবিমল মিশ্র। চলবে