সদীপ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘উপোষী মেঘ’

পর্ব ২

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২১

রতনদার মা রাস্তায় রাস্তায় গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতেন। ট্র্যাফিক পুলিশ গাড়ি দাঁড় করালে তিনি গাড়ির সামনে এসে বলতেন, ক’টা পয়সা দেবেন? আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন...

রতনদা বলতেন, মা মেনেই নিতে পারেনি বাবার মৃত্যুটা। বাবা আট বছর আগে মারা গেছে, আমার তো সেরকম আয় ছিল না কখনোই, পয়সার অভাবেই চলে গেছেন বলা চলে, তাও মা রোজ ঠিক বেড়িয়ে যেত বাড়ি থেকে আর ভিক্ষে করত। আমি, আমরা কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তাও কখনো শোনেনি। আসলে মা বিশ্বাসই করত না যে, বাবা আর বেঁচে নেই।

আমার ঘুম ভাঙে নদীর পাড়ে। আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম? কতদিন? কিসের অপেক্ষায়? কার জন্য? উঠে দেখি, আমার মাথার নিচে বেশ কয়েকটা বই। পুরোনো, হলদে হয়ে যাওয়া। সবক’টা বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা, শব্দেরা জাদুকর, হিসেব করে ব্যবহার কোরো।

আমার সামনে নদীর প্রান্তে একটা লোক পেছন ফিরে বসে আছে সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে। তার কাছে হেঁটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জানেন, এটা কোথায়? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অনেকক্ষণ।

লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তুমি জেগে আছ, আমি ঘুমোচ্ছি। আমি যোগেন বসু, রতনের বাবা। তুমি আমায় চেনো না।

আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি ভদ্রলোকের দিকে। বয়সে তিনি রতনদার চেয়েও ছোটো। বড় জোর পঞ্চাশ হবে। রতনদা যখন মারা গেলেন তখন তার বয়স প্রায় সত্তর তো হবেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ফিরে এসেছেন? কবে?

যোগেনবাবু মাটি থেকে কয়েকটা ঘাস খুবলে নিয়ে গন্ধ শুঁকে বললেন, শালা, ক’টা টাকার অভাবে মরে গেলাম। অথচ এখনও গন্ধ পাই, স্বাদ পাই, মারা যেতে ইচ্ছে করে। তোমার করে না?
আমি তো আগে কখনো মারা যাইনি। কী করে বুঝব, মারা যেতে কেমন লাগে! বললাম সপাটে।
আয়নায় নিজেকে দেখোনি কখনো? কিংবা কাউকে ভালোবাসোনি? জিজ্ঞেস করলেন রতনদার বাবা।
তার সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক কি?
ভালোবাসলে মৃত্যুকে চেখে দেখা যায়, আয়নায় নিজেকে দেখে সময় কাটালে মৃত্যুকে পরোখ করা যায়। জানো না?

যোগেনবাবু উঠে পিছিয়ে গেলেন নদীর বুকে। আস্তে আস্তে তিনি ডুবে যেতে থাকলেন কোমর, বুক, গলা অবধি। চিৎকার করে বললেন, বইগুলো তুমি রেখে দিও, ঘুমোতে পারবে নিশ্চিন্তে। যত ঘুমোবে, তত মৃত্যু পিছিয়ে যাবে। যত ঘুমোবে, তত মৃত্যু পিছিয়ে যাবে।

জলের তলায় হারিয়ে গেলেন যোগেনবাবু। আমি উঠে বইগুলোর কাছে এসে দেখি, দুটো-একটা গঙ্গা ফড়িং এসে বসেছে বইগুলোর ওপর। সেগুলোর চোখমুখে ঘুমঘুম ভাব। আমি বইগুলো তুলতেই উড়ে গেল ফড়িংগুলো। আর আমি হেঁটে যেতে থাকলাম চেনা কোনো মুখের খোঁজে। এ রাস্তা আমি চিনি না, এখানে কখনো আসিনি আমি। রতনদার বাবা যখন আছেন তখন রতনদাকেও পাব কোথাও কাছাকাছি, আমি নিশ্চিত। চলবে