সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আজ জন্মদিন। ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিকটবর্তী নিমতা গ্রামে তার জন্ম। তার পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের চুপি গ্রামে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
ভোরাই
ভোর হলো রে, ফর্সা হলো, দুললো ঊষার ফুলদোলা
আনকো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই তোলা।
জাগলো সাড়া নিদ্ মহলে, অথই নিথর পাথার-জলে
আলপনা দ্যায় আলতো বাতাস, ভোরাই সুরে মন ভোলা।
ধানের ক্ষেতের সবজে কে আজ সোহাগ দিয়ে ছুপিয়েছে
সেই সোহাগের একটু পরাগ টোপর-পানায় টুপিয়েছে।
আলোর মাঠের কোল ভরেছে, অপরাজিতার রং ধরেছে
নীল-কাজলের কাজললতা আসমানে চোখ ডুবিয়ে যে।
কল্পনা আজ চলছে উড়ে হালকা হাওয়ায় খেল খেলে
পাপড়ি ওজন পানসি কাদের সেই হাওয়াতেই পাল পেলে।
মোতিয়া মেঘের চামর পিঁজে পায়রা ফেরে আলোয় ভিজে
পদ্মফুলের অঞ্জলি যে আকাশগাঙে যায় ঢেলে।
পূব গগনে থির নীলিমা ভুলিয়েছে মন ভুলিয়েছে
পশ্চিমে মেঘ মেলছে জটা–সিংহ কেশর ফুলিয়েছে।
হাঁস চলেছে আকাশ-পথে, হাসছে কারা পুষ্পরথে
রামধনু-রং আঁচলা তাদের আলো-পাথার দুলিয়েছে।
শিশির-কণায় মানিক ঘনায়, দূর্বাদলে দীপ জ্বলে
শীতল শিথিল শিউলি-বোটায় সুপ্ত শিশুর ঘুম টলে।
আলোর জোয়ার উঠছে বেড়ে গন্ধ-ফুলের স্বপন কেড়ে
বন্ধ চোখের আগল ঠেলে রঙের ঝিলিক্ ঝলমলে।
নীলের বিথার নীলার পাথার দরাজ এ যে দিল্ খোলা
আজ কি উচিত ডঙ্কা দিয়ে ঝাণ্ডা নিয়ে ঝড় তোলা?
ফিরছে ফিঙে দুলিয়ে ফিতে; বোল ধরেছে বুলবুলিতে
গুঞ্জনে আর কূজন-গীতে হর্ষে ভূবন হরবোলা।
ইলশে গুঁড়ি
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।
কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
আলতাপাটি শিম্।
ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,
রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্।
হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশে গুঁড়ির নাচ
ইলশে গুঁড়ির নাচন্ দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ।
কেউ বা নাচে জলের তলায়
ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
পুকুরে ছিপ গাছ।
উছলে ওঠে মনটা, দেখে
ইলশে গুঁড়ির নাচ।
ইলশে গুঁড়ি পরীর ঘুড়ি
কোথায় চলেছে,
ঝুমরো চুলে ইলশে গুঁড়ি
মুক্তো ফলেছে!
ধানেক বনে চিংড়িগুলো
লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
আকাশ গলেছে,
বাঁশের পাতায় ঝিমোয় ঝিঁঝি,
বাদল চলেছে।
মেঘায় মেঘায় সূর্যি ডোবে
জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের খুঞ্চে-পোষে
তাল-পাটালির থাল।
লিখছে যারা তালপাতাতে
খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
তাল বড়া দাও তাদের পাতে
টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশি তৈরি করে
দিও তাদের কাল।
খেজুর পাতায় সবুজ টিয়ে
গড়তে পারে কে?
তালের পাতার কানাই ভেঁপু
না হয় তাদের দে।
ইলশে গুঁড়ি জলের ফাঁকি
ঝরছে কত বলব তা কী?
ভিজতে এলো বাবুই পাখি
বাইরে ঘর থেকে
পড়তে পাখায় লুকালো জল
ভিজলো নাকো সে।
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
পরীর কানের দুল,
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
ঝরো কদম ফুল।
ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
ঝাড়ছে পাখা টুনটুনিতে
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুমবাগানের ফুল।
উত্তম ও অধম
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিলো পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তাই।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভর্সৎনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাতঁ?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল,
তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে
দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?
কোন দেশে
কোন্ দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
দলতে হয় রে দুর্বা কোমল?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
সোনার কমল ফোটেরে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে
কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
ফিঙে নাচে গাছে গাছে?
কোথায় জলে মরাল চলে,
মরালী তার পাছে পাছে?
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
চাতক বারি যাচে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!
চরকার গান
ভোমরায় গান গায় চরকায়, শোন ভাই!
খেই নাও, পাঁজা দাও, আমরাও গান গাই।
ঘর-বার করবার দরকার নেই আর,
মন দাও চরকায় আপনার আপনার!
চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ক্ষীর-সর, আপনায় নির্ভর!
পড়শীর কণ্ঠে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া।
ঝর কায় ঝুর ঝুর ফুর ফুর বইছে!
চরকার বুলবুল কোন বোল কইছে?
কোন ধন দরকার চরকার আজ গো?
ঝিউড়ির খেই আর বউড়ির পাঁজ গো!
চরকার ঘর্ঘর পল্লীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ঘির দীপ, আপনায় নির্ভর!
পল্লীর উল্লাস জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
আর নয় আইটাই ঢিস-ঢিস দিন-ভর,
শোন বিশ্বকর্মার বিস্ময়-মন্তর!
চরকার চর্যায় সন্তোষ মনটায়,
রোজগার রোজদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায়।
চরকার ঘর্ঘর বস্তির ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর মঙ্গল, আপনায় নির্ভর!
বন্দর-পত্তন গঞ্জে সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
চরকায় সম্পদ, চরকায় অন্ন,
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ!
বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন-তৌলেই কিনতেন একদিন।
চরকার ঘর্ঘর শ্রেষ্ঠীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সম্পদ, আপনায় নির্ভর!
সুপ্তের রাজ্যে দৈবের সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
চরকাই লজ্জার সজ্জার বস্ত্র।
চরকাই দৈন্যের সংসার-অস্ত্র।
চরকাই সন্তান চরকাই সম্মান।
চরকায় দুঃখীর দুঃখের শেষ ত্রাণ।
চরকার ঘর্ঘর বঙ্গের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সমভ্রম, আপনায় নির্ভর!
প্রত্যাশ ছাড়বার জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
ফুরসুৎ সার্থক করবার ভেলকি!
উসখুস হাত! বিশ্বকর্মার খেল কি!
তন্দ্রার হুদ্দোয় একলার দোকলা!
চরকাই একজাই পায়সার টোকলা।
চরকার ঘর্ঘর হিন্দের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিকমৎ, আপনায় নির্ভর!
লাখ লাখ চিত্তে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
নিঃস্বের মূলধন রিক্তের সঞ্চয়,
বঙ্গের স্বস্তিক চরকার গাও জয়!
চরকায় দৌলত! চরকায় ইজ্জৎ!
চরকায় উজ্জ্বল লক্ষ্মীর ইজ্জৎ!
চরকার ঘর্ঘর গৌড়ের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর গৌরব, আপনায় নির্ভর!
গঙ্গায় মেঘনায় তিস্তায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!
চন্দ্রের চরকায় জ্যোৎস্নার সৃষ্টি!
সূর্যের কাটনায় কাঞ্চন বৃষ্টি!
ইন্দ্রের চরকায় মেঘ জল থান থান।
হিন্দের চরকায় ইজ্জৎ সম্মান!
চরকার দৌলত! ইজ্জৎ ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিম্মৎ, আপনায় নির্ভর!
গুজরাট-পাঞ্জাব-বাংলায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া।