সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র কাটবে কয়েকজন আমলা!
বেলায়াত হোসেন মামুনপ্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০১৯
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অগ্রজ একজন সংগঠক মাহবুব জামিল। এই দেশে ষাটের দশকে যারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুরুতে সক্রিয় হয়েছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। একদিন আড্ডায় তিনি গল্প করছিলেন।
গল্পে বললেন, তখন এরশাদের শাসনামল। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে তখন একজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী রাখার নিয়ম ছিল। সেবার আমি ছিলাম ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য। তো, একদিন সেন্সর বোর্ডে একটি ছবি এলো তালিকায়। ছবির নামটি দেখে একটু চমকে গেলাম। ছবির নাম `হীরক রাজার দেশে`। নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। তখন দূতাবাসের মাধ্যমে যেসব চলচ্চিত্র দেশে প্রদর্শনীর জন্য আসতো তা সেন্সর বোর্ড দেখে অনুমোদন দিতে হতো। এখনও এই নিয়মই আছে। তো, আমি তো অনেকখানি উত্তেজিত। সত্যজিৎ রায়ের একটি চলচ্চিত্র ঢাকায় আর কেউ দেখার আগেই আমি দেখার সুযোগ পাচ্ছি। এটা তো রীতিমতো সম্মানের ব্যাপার আমাদের কাছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, উত্তেজনার এই আবেগ কেবল আমার একার। উপস্থিত অন্য সেন্সর বোর্ড সদস্যদের মাঝে এর কোনো ছায়া নেই। যদিও সদস্যদের অধিকাংশই আমলা। তবুও ভাবছিলাম, কিছুটা তো আবেগ তাদেরও থাকতে পারে। কিন্তু আমি যা ভাবছিলাম তার পুরো উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখলাম সেদিন। উপস্থিত বোর্ড সদস্যরা ছবিটি দেখে ছবিটিতে বেশ কয়েকটি দৃশ্য ও সংলাপ কর্তনের আদেশ দিলেন। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র কাটবে আমাদের দেশের কয়েকজন আমলা! ভাবতে পারো!
তারপর আমি তাদের সাথে তর্ক জুড়ে দিলাম। তাদের বললাম, ছবিটি যে দেশে নির্মিত সেখানকার সেন্সর বোর্ড কোনো আপত্তি জানায়নি, তবে আমাদের ছবিটি দেখাতে কি সমস্যা থাকতে পারে? তাদের বললাম, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের একটি ফ্রেমও কর্তনের কোনো অধিকার আপনাদের বা আমাদের নেই। এই দৃষ্টতা কোনোভাবেই করা উচিত নয়। তারা আমার কোনো কথাই শুনলেন না। আর আমি তো সেখানে মাত্র একজন মানুষ। যখন দেখলাম তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তখন আমি সেখানেই একটি সাদা কাগজে আমার পদত্যাগপত্র লিখে ফেললাম। পদত্যাগপত্রে লিখলাম, যে সেন্সর বোর্ড পৃথিবীর অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যও কর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে একজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী হিসেবে আমি থাকতে পারি না। আমি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমার পদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। এই লিখে চিঠিটি সেন্সর বোর্ডের সচিবের হাতে দিয়ে বের হয়ে এলাম। আর কখনও সেন্সর বোর্ডে যাইনি।
গল্পটি বললাম আজ একটি সংবাদ প্রতিবেদন দেখে। সংবাদটি চলচ্চিত্রের অনুদান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বিষয়ক। এবার স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য দুই ক্যাটাগরিতেই চলচ্চিত্রের বাছাই ও অনুদান প্রদান কমিটিতে বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ছিলেন। অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হচ্ছে, স্বচ্ছতা নেই— এই পরিস্থিতি দেখেও তারা কেউ তো পদত্যাগ করলেন না! অথচ এককালে চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের এই সাহস ছিল। নিজেকে নিজে প্রতিদিন বলি, নিজের কাছে নিজের পরীক্ষা প্রতিদিন। আমি আমার সমকালের চলচ্চিত্র সংসদকর্মী বড় ভাইদের দৃষ্টান্ত অন্ধভাবে অনুসরণে আগ্রহী নই। আমি প্রশ্ন করি তারপর বিবেচনা করি।
মানুষের পতন আমাকে আহত করে, বিশেষত আদর্শিক পতন।
লেখক: চলচ্চিত্র সংসদকর্মী