সজীব দে’র গল্প ‘ভবিষ্যতের মানুষ’
প্রকাশিত : জুন ১০, ২০২০
আক্রোশে আমি এমন সময় চাইনি
মোবাইলের স্ক্রিনে পুরো পৃথিবী আমি চাইনি
বান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তায় চাঁদের আলোয় আমি হাঁটতে চাইছি। সাঙ্গু নদীর পাড়ে বসে অসংখ্যা ফানুস উড়ে যাওয়া দেখতে চাই। শহরের নিরিবিলি রাস্তায় ছোট ছোট যে খাবার দোকানে হরেক রকমের খাবার পাওয়া যায়, তাও পেটপুরে না হোক তৃপ্তি নিয়ে সাপের বা শুকরের মাংস খেতে চাই।
আমার মনে পড়ে, যখন বান্দরবান গেছিলাম সেই রাস্তাটি হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর গভীর রাত হলে ভান্তের ঘরে গিয়ে বসতাম। অধিবিদ্যার যাবতীয় আকস্মিক দোলাচলে আমাদের কথা। ফুলের সুবাস না হলে পৃথিবীতে পারফিউম তৈরি হতো কিনা? বা মানুষ মরে গেলে তার শরীরের যে ঘ্রাণ তা আদৌ দোকানে ঝুলিয়ে রাখা গরুর মাংসের মতো কিনা!
ভান্তে আমার দিকে ছুরি এগিয়ে দেয়। আমি ছুরিটি হাতে নিয়ে ভাবি। আর দেশি মদ একটু একটু করে চুমুক দেই। দেখি, ঘরের ভেতর অসংখ্যা তুলোর মতো কুয়াশা ঢুকে গেছে। আমার স্বভাবে কোনো ভয় নেই। ভান্তেকে বলি, আমি কি পিংক ফ্লয়েডের একটা গান ছাড়তে পারি?
ভান্তে বলে, অবশ্যই।
আমি এমন একটি পরিবেশে ‘ইটস অ্যা মিরাকল’ মোবাইলে ছেড়ে দেই। ভান্তে হাসে। তারপর আমাদের দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা হয় না।
বলি, আপনি কি কিছু বলতে আমাকে আজ রাতে নিমন্ত্রণ করেছেন?
তিনি বলেন, না।
এই বলে ভান্তে ঘর থেকে বের হয়ে যান।
বলি, কোথায় যাচ্ছেন?
তিনি বলেন, আধঘণ্টা বসুন। আমি হেঁটে আসি।
ভান্তে বের হয়ে যান। আমি এটা জানতাম, ভান্তেরা ভবিষৎ বলতে পারে। অথচ এসব শুনতে আমি আসিনি। সেটি তিনি এরই মধ্যে বুঝে গেছেন হয়তো। কারণ তাকে আমি আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করিনি। প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল, ভান্তে আর আসেন না।
রাতও প্রায় দুটো। আমারও ঘুমঘুম ভাব চলে আসছে। ঘরের দরজার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কেউ যেন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকছে। ছায়ার মতো একটা নারী মূর্তি নীল গাউন পরা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর তাদের আঞ্চলিক ভাষায় যেন কী বলল, বুঝতে পারিনি। খুব সম্ভবত এটা মারমা ভাষা। যাই হোক, জিগাস করলাম, ভান্তে কোথায়?
মহিলাটি বলে, কোন ভান্তে!
এই যে তিনি এতক্ষণ বসে ছিলেন।
জনাব, ভুল বলছেন। আপনার সামনে কেউ ছিল না। অধিক পান করায় হয়তো আপনার বিভ্রম হইছে।
আমি আচমকিত হই। আবার হাসি।
জনাব, হাসলেন কেন?
আচ্ছা, এখানে আমি এলাম কেমন করে?
নারীটি বলল, আপনি এখানের দো চুয়ানি খেতে এসেছেন।
আমি বলি, না না না। আমি এই পাহাড়ি এলাকার কিছুই চিনি না। আমি আগন্তুক। এতটা দূরে আমার আসতে পারার কথা নয়। আপনি কে?
সে বলে, আমি এ ঘরের মালিক। আমার নাম চুংওয়াই মারমা। আপনাকে আরেক গ্লাস দেই।
বলি, না।
সে বলে, আপনি শুয়ে পড়েন।
বলি, আমি শুলে আপনি কোথায় শোবেন?
কেন? আমিও আপনার পাশে শুয়ে থাকবো।
নারীটি হারিকেনের আলো কমিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়ে। আকাশে অনেক ফানুশ উড়ছে। আমরা পাশাপাশি শুয়ে কেউ কারো সাথে কথা বলছি না। আমার গায়ে সুড়সুড়িয়ে উঠছে। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কত সময় পারবো! জানি না।
সে বলে, আপনি কি আমাকে ধরে ঘুমাতে চান।
আমি কিছু বলতে পারি না। নারীটি আলতো করে তার এক হাত আমার বুকের উপর রাখে। তারপর একটি পা আমার কোমরের উপর উঠিয়ে দেয়। আমি নড়তে পারি না। তারপর সে আস্তে আস্তে তার হাতে আঙুল দিয়ে গালে চোখে মুখে বুলাতে থাকে। আমার ভালো লাগে। কাম জাগে কিন্তু কীভাবে শুরু করবো, জানি না। একপর্যায়ে আমি জোর করে তাকে টান মেরে বুকের উপর উঠিয়ে আনি।
মেয়েটি বলে, আপনার সাধনা শেষ। আজ থেকে আপনার বর্তমানে ফিরে যেতে পারবেন না।
এটুকু শুনে আমার গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি তার বন্ধন থেকে। ঘরভর্তি কুয়াশা। ঘরভর্তি ভেড়ার লোম। নারীটিকে আর খুঁজে পাই না। আমার চোখভর্তি ঘুম। আমি তলাতে থাকি ব্ল্যাকবেরি নাইট গানটি শুনতে শুনতে। গানটি ধীরে ভেসে যেতে থাকে।
এভাবে জানি না কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি, চারপাশ আমি চিনতে পারছি না। এত সুন্দর রাস্তা দিয়ে এলাম! আর সব ভাঙা রাস্তা। চারপাশ জঙ্গল। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। কী করবো জানি না। হঠাৎ করে একটা ভাঙাচোরা গাড়ি আসে। কেমন জানি আশির দশকের মতো। লোকজনও জানি কেমন। আমার দিকে অপলক দৃষ্টিত চেয়ে আছে তারা। ভাবছে, আমি এলিয়েন টাইপ কিছু। আমি গাড়িতে উঠলাম। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলো। বললাম, কত?
সে বলল, এক টাকা।
আমি থ মেরে গেলাম। মানে কী! তারপরও নিজেকে ঠিক রেখে বললাম, আচ্ছ।
পকেট থেকে এক টাকার একটা কয়েন বের করলাম। তার হাতে দিলাম। সে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। বলল, এ টাকা এখানে চলে না।
বললাম, কেন? আমি এদেশের।
সে বলল, এই দেখেন আমাদের এক টাকা।
আমি অবাক হই। আসলেই তো! তার টাকার সাথে আমার টাকার কোনো মিল নাই। আমি চুপ করে বসে থাকি। কাউকে বলতে পারি না। আমি ভবিষ্যৎ থেকে আসছি। কিন্তু এখান থেকে যাবার পর আমি কোথায় যাব? মা আমাকে চিনবে না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব। তবে?...