সজীব দে’র গল্প ‘জবা, শিমুল অথবা তিতির’

প্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০২০

আমি কি জানতাম, মেয়ে আমার জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে! আরে, শহরটা তো জ্যান্ত একটা জঙ্গল। এ কথা না জেনেও সে ঘুরছে আরামে। আর আমি বা তুমি জেনেও জঙ্গলকে স্বর্গ ভেবে সুরা ঢেলে দিচ্ছি পাখির মুখে। সে ভালো। মাতাল পাখি এবার মেয়ের হাতে। আমার মেয়ের বয়স আঠারো। নাম জবা। ওর মা ডাকে শিমুল বলে। আর আমার প্রেমিকা নাম দিয়েছে তিতির। যদিও এসব নামে তার কোনো যায় আসে না। তার বেশি ভালো লাগে তার প্রেমিকের দেয়া নাম। মেয়ে বলে, আমাদের কোনো বাড়ি নেই।

মেয়েটি আমাদের ছেড়ে গেছে পাঁচ মাসে হবে। তার মধ্যে তার সাথে দেখা হয়েছে একবার। সে তার প্রেমিকের সাথে হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়ে বলে, আমরা কোনো সম্পত্তি করবো না। সারা জীবন ঘুরে বেড়াবো। আমি বললাম, ঠিক আছে। তুমি যেভাবে বাঁচো খারাপ দেখি না তাতে। তারপর বহু বছর আর আমার মেয়ের সাথে দেখা হয়নি। আমার বয়স এখন একান্ন। মাঝে মাঝে মেয়ের কথা মনে পড়ে। একদিন চিটাগাং গিয়ে একটি হোটেলে উঠি। খুব সস্তা হোটেল। রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে যখন রুম খুলতে যাচ্ছি ঠিক তখন পাশের রুম থেকে বের হয়ে আসে দুটি মেয়ে। আমি তাদের মাঝে একজনকে চিনতে পারি। সে আমার মেয়ে জবা, শিমুল অথবা তিতির। সাথের জন কে, প্রথম বুঝিনি। আমি এগিয়ে যাই। দরজায় চাবি ঝুলে থাকে। জবা?
মেয়েটি ঘুরে তাকায়?
আমাকে চিনেছিস?
মেয়েটি ভালো করে আমাকে দেখে।
না!
আমি তোর বাবা।
আমার বাবাতো মারা গেছে পাঁচ বছর হলো।
তোমার নাম কি জবা না?
হ্যাঁ।
আমার মেয়ের নামও জবা। দেখতে তোমার মতো। অবশ্য বয়স তোমার চেয়ে বেশি হবার কথা। তোমার পাশে যে মেয়েটি, ও কে?
আমার বোন।
ওহ্, দুঃখিত।
না-না, ঠিক আছে।
তোমাদের সাথে বসে চা বা কফি খেতে পারি।
অবশ্যই।
চলো তবে।
আমার ঘরের দরজায় চাবি ঝুলে থাকে। আমরা একটি ছোট ক্যাফেতে বসি। ওয়েটার আসে। আমি অর্ডার দেই।

আচ্ছা তোমরা কোথা থেকে এসেছ?
আমরা পাঁচ বছর ধরে এ হোটেলই থাকি। আমার মা-বাবা হোটেলের এ রুমটি কিনে রেখেছিল। তাই এখানেই আছি।
আচ্ছা তুমি জবা আর তোমার ছোট বোনোর নামটাতো জানা হলো না!
ছোট মেয়েটি আগ বাড়িয়েই বলে, আমি হেলেন।
বাহ্, সুন্দর নাম।
জবা, তুমি কী করছ?
একটা স্কুলে পড়াই। ওই স্কুলে আমার মা পড়াতো, এখন আমি।
আর বাবা?
বাবা একটি পত্রিকায় চাকরি করতো।
আমি একটু বিনয় নিয়ে বলি, তারা কীভাবে মারা গেলেন?
সমুদ্রে ডুবে!
আহ্!
মাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাও তলিয়ে যান। আমাদের দুবোনের চোখের সামনে।
থাক আর বলতে হবে না।
কেন? আমার বলতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না।
না থাক।
তারপর শুনুন।
আমি আর শুনতে চাচ্ছি না।
আমরা মনে হলো, কফিটা যথেষ্ঠ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কফিটা শেষ করা দরকার। আমি এক চুমুকে কফি শেষ করে উঠে পড়ি।
মেয়েটি বলে, আবার দেখা হবে।
আমি আর ওই হোটেলে উঠি না। রাতের ট্রেনে ঢাকায় রওনা দেই।

সকালে পাখির ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। আমার ঘরের পাশে একটা নিমগাছ আছে। ওই গাছে অনেক পাখি আসে। আমি জানালার পর্দা খুলে দেই। দেখি, একটি তিতির পাখি ডাকছে। বুঝতে পারি, পুরোটা ছিল আমার স্বপ্ন। আর আমার বউ স্বপ্না কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র আঠারো মাস। স্বপ্না আট মাসের পোয়াতি।