সজীব দে’র গল্প ‘আজকের রাতটি সুবর্ণার’

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০

আজকের রাতটি সুর্বণার। কেননা ও বিকেলে যে কবিতার আশ্রয়ে কাটিয়েছে আমি বলবো, এমন আশ্রয় একদা আসে। ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে যে টানেলে কল্পনার বিস্তারে ডুবেছিল তা হয়তো সে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পেতে পারতো। আমরা ঘরে মাত্র তিনজন, সুর্বণা বাদে আছে আজমল। ও বাঁশি বাঁজায়। সুর্বণা সিবাশ রিগ্যালের ছিপি খুলে। আজমল বলে, ও আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে। ও বাঁশিতে সুর ধরে শচিন কর্তার। ধোঁয়া হয়ে যায় সুরে আমাদের ঘর।

সুর্ণার কথায় আসি। ও কবিতা লেখে। কারও কাছে হয়তো ভালো লাগবে না। কারও আবার রক্তের শিরায় ভায়োলিন বাজাবে। বিয়ে করেনি। একা থাকে। বিয়ে হয়তো করবে। আপাতত আমরা এখানে থাকি। সুর্বণা দেখতে সুন্দরী। আমি আজমল আরও অনেক বন্ধু ওর প্রেমে পড়ে আছি। ও সেটা জানে। এতে আমাদের সম্পর্কের কখনও ভাটা পড়েনি। হ্যাঁ, যে কথা বলতে চাচ্ছি, ও আজ আমাদের একটা কবিতা শুনাবে বলে এত আয়োজন। আজমল বলে, মালটা ধরেছে বেশ।

আজমল বলে, হুজুরে শাহেনশাহ আপনার দরবারে আজ উপস্থিত থেকে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সুর্বণা হাসে। আমাদের কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে যায়। কিন্তু সুর্বণা কোনো কবিতা আমাদের শোনায় না। আমাদের নেশা চরম তুঙ্গে। আমি বলে বসি, হিসেব করে করে দিন গুজরান করেছি/হিসেব মেলেনি কোনোদিন/আজ ফয়সালা হবে/হিসেবের বাড়ি হবে বেহুলার বাসর!

সুর্বণা মুচকি হেসে উঠে যায়। আজমল বলে, বাহ্ দোস্ত বাহ্! আমরা দুজন আরও এক পেগ করে মেরে দেই। তারপরও অনেক সময় কেটে যায়। সুর্বণার দেখা নেই। তার একটু পর সে আসে। দেখে চিনতে পারি না। কেমন জানি দুজন করে দিখছি। আবার একজন। সুর্বণা নাইটি পড়ে আমাদের সামনে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবছা আবছা বুঝতে পারছি। ওর ভেতর কোনো অন্তর্বাস নেই। সুঢৌল হয়ে ফুটে আসে স্তনযুগল। আমাদের চোখ আর চোখ নেই। হয়ে উঠেছে কোনো পেইন্টারের চোখ। আমি আজমলকে প্রশ্ন করি, আজ রাতে কি আমি গঁগ্যা?

আর আমি? বলতে পারবো না। আজমলের মন খারাপ হয়। এবার সুর্বণা নড়েচড়ে ওঠে। সুর্বণা তার গাউনটা খুলে ফেলে আমাদের চোখের সামনে। এ কী সুর্বণার কবিতা! সুর্বণা বলে, আজ আমরা তিনজন একসাথে নগ্ন হয়ে শোবো। কেউ কারও উপর জোর জবরদস্তি করবে না। কারও যদি শরীর সাড়া দেয়, আমি না করবো না। আবার আমার যদি শরীর সাড়া দেয় কারও উপর, সেও না করতে পারবো না। রাত অনেক হয়ে গেছে। পালানোর উপায় নেই। আমরা মেনে নেই। এক এক করে আমি আর আজমল নগ্ন হই। সুর্বণা দেয়াল থেকে আমার কাছে এসে বসে।

ও আমাদের মাঝে বসে আছে। আজমল বাঁশিতে সুর তোলে কোনো ভিনদেশি সে সুর। শুনে মনে হলো লাতিন কোনো গানের সুর। জানালা দিয়ে বাঁকা হয়ে ঘরে চাঁদের আলো পড়েছে। ওই আলো সুর্বণার দু’স্তনের মাঝ দিয়ে কেটে বের হয়ে গেছে। আমার মনে হলো, ওর স্তন বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। আমি রক্ত আটকাতে চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। সুর্বণা হাসতে থাকে। ঘর কেঁপে ওঠে। আমার অদ্ভুত কাণ্ড দেখে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। আজমল এবার নিরোর বাঁশি বাঁজায়। ভোর হতে আরও ঘণ্টা দুই বাকি। নিরো বাঁশি থামায় ও কী করবে বুঝতে পারে না। কিন্তু সুর্বণা বোঝে।

ও তখন আজমলকেও তার এক পাশে নিয়ে শুয়ে পড়ে। আমরা তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি ভোর অব্দি। সুর্বণার কানে কাকের ডাক আসতে আমাদের মাঝখান থেকে ওঠে পড়ে। আমরা তখন দুজন শুয়ে থাকি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি আমরা দুজন বুঝতে পারি না। সকালে উঠে দেখি সুর্বণা ঘরে নেই। ওকে ফোন করি। সুইচ অফ। অনেক দিন পড়ে আবার একবার ফোন করি, দেখি ফোন খোলা। অপর পাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে। আমি চিনতে পারি না। আমি বলি, আপনি কি সুর্বণা বলছেন?
হুম।
আমি রাতুল, চিনতে পেরেছিস?
না। রাতুল নামে আমার পরিচিত কেউ নেই। সরি আপনি হয়তো রং নম্বরে ফোন করেছেন। রাখি।
ফোন রেখে দেয়। তারপর আর চেষ্টা করিনি। এভাবে আমাদের পনের বছর কেটে যায়। আমি বা আজমল কেউ বিয়ে করিনি। আমাদের বয়স এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আমরা একটা কবিতা শুনতে পেয়েছি, যে কবিতা লেখা যায় না।