‘সংস্কৃ‌তি এক‌টি জা‌তির প‌রিচয়’ কথাটার মানে আসলে কি

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০২০

কথাটা প্রায়ই শুনি, সংস্কৃ‌তি এক‌টি জা‌তির প‌রিচয়। যারা কথাটা ব‌লে নিশ্চয়ই তারা খারাপ উদ্দেশ্যে এটা বলে না। কিন্তু ভে‌বেচি‌ন্তে ব‌লেন না। কথাটা আজ‌কেই আবার পড়‌তে হলো একজ‌নের মন্ত‌ব্যে। ম‌নে হ‌লো, এ সম্প‌র্কে কিছু স্পষ্ট ক‌রে বলা দরকার। যি‌নি কথাটা ব‌লে‌ছেন তার কথাটা বলার মূল উদ্দেশ্য নি‌য়ে বল‌তে চাই না কিছু। ‌কিন্তু কথাটার ভাব আর বিভ্রা‌ন্তি নি‌য়ে কিছু বল‌তে চাই। ভাবনা‌চিন্তা ক‌রে কথা বলার অভ্যাসটা ম‌নে হয় আমা‌দের অনেক কম। মাথায় কিছু একটা ঢুক‌লে ব‌লে ফে‌লি। য‌দিও অন্যের মু‌খে বারবার শোনা কথাটাই ব‌লি, ‌কিন্তু বলার আগে ভা‌বি, খুব দামি একটা কথা বল‌তে যা‌চ্ছি।

জা‌নি যে, এ রকম একটা কথা বল‌লে হা‌ততালি পাব, নি‌জের দেশ‌প্রেম, নি‌জে‌র দে‌শের সংস্কৃ‌তির প্রতি আমার আবেগ টের পা‌বে সবাই। কথাটা বলার আগে দ্বিতীয়বার ভাবার চিন্তা ক‌রি না, যা বলতে যা‌চ্ছি তার সত্যিকার রূপটা কী। যা বল‌বো ঠিক ক‌রে‌ছি তা কি বু‌ঝেশু‌নে বল‌তে যা‌চ্ছি সে নি‌য়ে সামান্য মাথা ঘামাই না। খুব ছোট বয়‌সে গ্রা‌মে গে‌লে নানা ধর‌নের প্রবাদ শুনতাম। সেগুলির অনেকটাই আমার আজও মনে আছে। ত‌বে সবগুলির স‌ঙ্গে যে আমি সবসময় একমত ছিলাম, তা নয়। গ্রা‌মের এরকম দু‌টি প্রবাদ, বলা কথা ছোড়া তীর ফেরা‌নো যায় না, এবং ভা‌বিয়া ক‌রিও কাজ। কিন্তু ভে‌বে কথা বলার অভ্যাসটা ম‌নে হয় আমা‌দের স্বভা‌বে নেই।

খুব বে‌শি দূর যে‌তে হ‌বে না, ক‌য়েকমা‌সে ক‌রোনা ভাইরাস সম্প‌র্কে আমা‌দের মন্ত্রী‌দের কিছু কথা এ ব্যাপা‌রে বিরাট সব উদাহরণ হ‌য়ে আছে। বলার আগমুহূর্তে বা বলার প‌রেও ভা‌বেন‌নি, তা‌দের কথাগুলি ক‌তেটা সঙ্গ‌তিপূর্ণ। থাক সেসব পরচর্চা। বড় মানুষের কথা নি‌য়ে বিতণ্ডা করার আমি কে? আদার বেপারির আবার জাহা‌জের খব‌রের দরকার কী! সংস্কৃ‌তি এক‌টি জা‌তির প‌রিচয়, সেটাই হ‌চ্ছে আস‌লে আলোচনা। প্রথম প্রশ্ন দাঁড়ায় `জা‌তি` বড় না `সংস্কৃ‌তি` বড়? `ব্যক্তি` বড় না‌কি তার `নাম`টা বড়? মূল প‌রিচয় কি ব্যক্তি‌টি নি‌জে, না তার নাম? মহান সব ভাষ্যকার‌দের কথায় না হয় ধ‌রেই নিলাম, সংস্কৃ‌তি এক‌টি জা‌তির প‌রিচয়। ম‌নে ক‌রে নিলাম, এটা খুবই জ্ঞা‌নের কথা। তাহ‌লে কাগ‌জে কল‌মে সে জ্ঞা‌নের কথাটা স‌ত্যি কতটুকু জানার চেষ্টা ক‌রি।

ফেন্স, জার্মান, স্পে‌নিশ, ব্রি‌টিশ এরা সবাই তো এক একটা জা‌তি। বা ভিন্ন দিক থে‌কে বলা গেল ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ব্রি‌টেন এরা এক একটা রাষ্ট্র। কিন্তু কেউ কি ব‌লে দি‌তে পার‌বে, এইসব দেশ বা জা‌তির প‌রিচয় বুঝ‌তে কা‌জে দে‌বে তা‌দের কোন্ কোন্ সংস্কৃ‌তিটা? সংস্কৃ‌তি য‌দি জা‌তির প‌রিচয় হয়, উল্লেখিত চারটা দেশ বা জা‌তি‌কে বুঝ‌তে বা চিন‌তে তা‌দের কোন্ কোন্ সংস্কৃ‌তিটা কা‌জে আস‌বে তার একটা তা‌লিকা দি‌তে পার‌বেন কেউ? ফ্রান্স বা ফেন্স বল‌তে তা‌দের কোন সংস্কৃ‌তিটা আমা‌দের সাম‌নে প‌রিচয় হ‌য়ে দাঁড়া‌চ্ছে? ব্রি‌টিশরা যে দীর্ঘকাল ভারতে ছিল, আমরা কি বল‌তে পার‌বো তা‌দের সংস্কৃ‌তিটা কী, যা দি‌য়ে আমরা ব্রি‌টিশ‌দের চিন‌তে পা‌রি বা আলাদা কর‌তে পা‌রি? খুব সহজ একটা প্রশ্ন য‌দি ক‌রি, আমা‌দের সংস্কৃ‌তির প্রে‌মিকরা কি কেউ বল‌তে পার‌বেন, ব্রি‌টিশ‌কে আর ভারত‌কে আমরা কোন সংস্কৃ‌তির দ্বারা আলাদা কর‌বো?

ঠিক তেম‌নি আবার ভারত আর বাঙালি‌কে কোন সংস্কৃ‌তি দি‌য়ে বিভাজন করা যা‌বে? ‌ব্রি‌টিশরা প্রথম বাংলা দখল ক‌রেছিল। ফ‌লে প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্নটা আস‌তেই পা‌রে, ব্রি‌টিশ জা‌তির স‌ঙ্গে সেই বাঙালির সংস্কৃ‌তিটা ভিন্ন ছিল কোথায়, যা দিয়ে দুজ‌নের প‌রিচয় বোঝা যায়? সংস্কৃ‌তি জা‌তির প‌রিচয় সূত্র দি‌য়ে এগুলি সামান্য প‌রিমা‌ণে কেউ ব্যাখ্যা বি‌শ্লেষণ ক‌রে দেখাক তাহলে না আমা‌দের কিছু জ্ঞান বা‌ড়ে। খা‌লি মা‌ঠে গোল দি‌য়ে তো লাভ নেই। কথাটা আস‌লে খুব স্পষ্ট, যখন আমরা ব‌লি ফ্রান্স বা জার্মানি বা রুশ আমরা তা‌দের সংস্কৃ‌তি নি‌য়ে মাথা ঘামাই না। যারা সমাজ‌বিজ্ঞান বা নৃতত্ত্ব নি‌য়ে কাজ কর‌বে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। ফ্রান্স, জার্মানি, রুশ‌দের নি‌য়ে বা পৃ‌থিবীর তাবৎ দেশ নি‌য়ে জানবার বহু কিছু আছে। কিন্তু আজ‌কের দু‌নিয়ায় সেটা তা‌দের প্রথম প‌রিচয় নয়।

ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন ও সুইজারল্যাণ্ড বল‌তে আমা‌দের কা‌ছে প্রধান প‌রিচয় এগু‌লি ধনী দেশ, শীত প্রধান দেশ, জ্ঞান‌বিজ্ঞা‌নে উন্নত দেশ, প‌রিষ্কার প‌রিচ্ছন্ন দেশ। সেস‌ঙ্গে আর একটা কথা মাথায় আসে, গণতা‌ন্ত্রিক ভোটা‌ধিকার, মানু‌ষের নাগ‌রিক অধিকার সেসব দে‌শে অনেক বে‌শি। ফ‌লে তা‌দের সংস্কৃ‌তি কী, ধর্ম কী কখ‌নো সেটা মাথায় আসে না তা‌দের প‌রিচয় বুঝবার জন্য। বরং ক‌তেটা তারা মান‌বিক আচরণ ক‌রে সেটা গুরুত্ব পায়। য‌দি ত‌র্কের খা‌তি‌রে সংস্কৃ‌তি দি‌য়ে প‌রিমাপ কর‌তে হয়, বল‌তে হ‌বে চারটা দে‌শের সংস্কৃ‌তি এক। সকলেই তারা রাষ্ট্রীয়ভা‌বে বিজ্ঞা‌নের চর্চা ক‌রে, য‌থেষ্ট নাগরিক অধিকার ভোগ ক‌রে, নারী-পুরু‌ষের মেলামেশায় ধর্মীয় বি‌ধি-নি‌ষেধ নেই, আবার কম‌বে‌শি চার্চও আছে, প্রাথ‌মিক এবং মাধ্যমিক ‌শিক্ষায় এগিয়ে র‌য়ে‌ছে প্রায় সক‌লে।

সারা ইউরোপের প্রায় সব দে‌শের ক্ষে‌ত্রে এগু‌লি স‌ত্যি হ‌বে। কিন্তু বাংলা‌দে‌শের প‌রিচয়টা তা‌দের কা‌ছে কী? নিশ্চয়ই একটা দুর্নী‌তির দেশ। আরও লম্বা তা‌লিকা দেয়া ‌যা‌বে। কিন্তু বাংলা‌দে‌শের সংস্কৃ‌তি দি‌য়ে তারা বাংলা‌দে‌শের প‌রিচয় খোঁজে না। বাংলা‌দে‌শের ভদ্রলোকরা প‌হেলা বৈশা‌খের দিন ঘটা ক‌রে পান্তা ভাত খায় কিনা, শীত এলে ইদা‌নীং কেউ শখের পিঠা উৎসব ক‌রে কিনা, বস‌ন্তের প্রথম দি‌নে মে‌য়েরা হলুদ শা‌ড়ি প‌রে কিনা, তা দি‌য়ে তারা বাংলা‌দে‌শের পরিচয় খোঁজার চেষ্টা ক‌রে না। বুঝ‌তে চেষ্টা ক‌রে তার অর্থ‌নৈ‌তিক অবস্থা, গণতা‌ন্ত্রিক কাঠা‌মো, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা আর বেকার‌ত্বের হার, আর বাঙালিরা নিজ‌দে‌শের অন্যজা‌তি গোষ্ঠীর প্রতি ক‌তটা সদভাব রক্ষা কর‌ছে। সেগু‌লিই তা‌দের কা‌ছে বাংলা‌দে‌শের বা বাঙালির প‌রিচয়।

সংস্কৃ‌তির চে‌য়ে জা‌তির প‌রিচ‌য়ে ইতিহাসের ভূ‌মিকাটা আরো ‌ বড়। কারণ সংস্কৃ‌তি ব্যাপারটা আস‌লে বিরাট, মানব‌গোষ্ঠীর সংস্কৃ‌তি সারা বি‌শ্বেই সং‌মি‌শ্রিত একটা ব্যাপার। যেমন সকল মানব সমাজ আগুনের ব্যবহার ক‌রে। ধরা যাক, বাংলা ভাষা, আসলে এটা এসেছে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা থে‌কে। ইউরোপের প্রায় সকল ভাষা আর বাংলা ভাষার উৎপ‌ত্তি প্রায় এক জায়গা থে‌কে। ভার‌তের তা‌মিল, তে‌লেগু, কন্নড়, মালয় আবার এর থে‌কে আলাদা। ভার‌তের আরসব ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা থে‌কে উৎপ‌ত্তি। ফ‌লে সংস্কৃ‌তি এক বিরাট ব্যাপার, নিরব‌ধি বহু আবহমানকাল ধ‌রে চ‌লে আস‌ছে। এর কো‌নো কূল কিনারা নাই। কিন্তু দেশ আর জা‌তিগুলিকে ‌কিছুটা হ‌লেও সীমা দি‌য়ে বা সীমান্ত দি‌য়ে নির্ধারণ করা যায়।‌ ফ‌লে বি‌ভিন্ন দে‌শের ইতিহাস থা‌কে, ভূ‌গোল থা‌কে। চিনবার বুঝবার জন্য সেগুলিই তাদের প্রধান প‌রিচয় হয়ে দাঁড়ায়।

ধরা যাক ফ্রা‌ন্সের কথা। ফ্রা‌ন্সের ইতিহাসগতভাবে আরো একটা বড় প‌রিচয় আছে। রাজনী‌তির ইতিহাসের ছাত্রসহ কে না জা‌নে যে, ফরাসি বিপ্ল‌বের দেশ। ঠিক একইভা‌বে ব্রি‌টে‌নের প‌রিচয় শিল্প‌বিপ্ল‌বের দেশ। রুশ বিপ্লব তো সর্ব‌ক্ষে‌ত্রে সাড়া জাগা‌নো। যা উদাহরণ দেয়া হ‌লো, সবগু‌লো ঘটনা আন্তর্জা‌তিক। চীন আর কিউবার ‌বিশ্বজু‌ড়ে প‌রিচয় সমাজতা‌ন্ত্রিক বিপ্লব আর তারপর দেশ দু‌টি‌কে ইতিবাচকভাবে বি‌শ্বের দরবা‌রে তুলে ধরার জন্য। সমাজতা‌ন্ত্রিক বিপ্লব করার জন্য চীন আর কিউবা‌কে কেউ ম‌নে রাখ‌তো না। ম‌নে রে‌খে‌ছে রাষ্ট্র হি‌সে‌বে পরবর্তী সাফ‌ল্যের জন্য। রাষ্ট্র বা জা‌তির প্রধান প‌রিচয় ঘ‌টে, সে জ্ঞান‌বিজ্ঞা‌নের ইতিহাসে বিশ্বমান‌বের জন্য কী অবদান রেখে যে‌তে পার‌লো তার বি‌বেচনায়। বাংলার কী অবদান আছে, সেখা‌নে সেটাই বি‌বেচ্য। বাঙালি বা বাংলা‌দেশ বিশ্বমান‌বের জ্ঞান ভাণ্ডা‌রে কি কিছু রে‌খে যে‌তে পে‌রে‌ছে? জা‌তি হি‌সে‌বে সেটাই প্রধান প্রশ্ন।

যারা বল‌ছে, সংস্কৃ‌তি এক‌টি জা‌তির প‌রিচয়, বিনীতভা‌বে তা‌দের কা‌ছে জান‌তে চাই, সেটা কোন্ সংস্কৃ‌তি? ধরা যাক বাংলা‌দে‌শে অনেকগুলি বড় ছোট জাতি আছে, সেখা‌নে কারটা ধর‌বো আর কারটা বাদ দে‌বে? য‌দি ধ‌রে নেই, বাঙালির সংস্কৃ‌তি, কে নির্ধারণ কর‌বে কোনগু‌লি বাঙালির সংস্কৃ‌তি? কা‌রো প‌ক্ষে কি তা‌লিকা দি‌য়ে বলা সম্ভব, এগু‌লি বাঙালির সংস্কৃ‌তি? বাংলা‌দে‌শে একজন মানুষ নেই যে বল‌তে পার‌বে এটা বাঙালির সংস্কৃ‌তি, বল‌তে পার‌বে না এটা আমা‌দের জাতীয় ঐতিহ্য। কারণ, বলা সম্ভব নয়। মানবসভ্যতা কখ‌নো বিচ্ছিন্ন কো‌নো ঘটনা নয়, আর কখ‌নো তা এক জায়গায় দাঁড়ি‌য়ে নেই। সংস্কৃ‌তি নি‌য়ে আমা‌দের মাথায় কিছু উদ্ভট চিন্তা আছে। প্রত্যেক জা‌তির বোধ হয় আলাদা আলাদা একটা সংস্কৃ‌তি থাক‌তেই হ‌বে। খুব সংক্ষিপ্ত কা‌লের জন্য বা তা থাক‌তে পা‌রে, বৃহৎ সম‌য়ের জন্য পা‌রে না। সংস্কৃ‌তি সবসময় আদান প্রদা‌নের ব্যাপার। বি‌শ্বের কো‌নো জা‌তির কো‌নো অনড় সংস্কৃ‌তি নেই, মানু‌ষের সভ্যতা আগায় সেই স‌ঙ্গে সংস্কৃ‌তি পাল্টায়।

মানুষ য‌দি তা‌দের অগ্রগ‌তি‌কে আট‌কে রাখ‌তে চায়, তাহ‌লে বস্তাবন্দি ক‌রে রাখ‌তে হ‌বে তার সংস্কৃ‌তি‌কে। বাঙালির সংস্কৃতি নি‌য়ে আমা‌দের উচ্চকণ্ঠ আবেগ বা তা রক্ষার নানা শ্লোগান, আস‌লে স্মরণ ক‌রি‌য়ে দেয়, মানবসভ্যতার গ‌তিপথটা আমরা বু‌ঝি না। সকল মানু‌ষের সব‌চে‌য়ে বড় সংস্কৃ‌তি হ‌চ্ছে, সকল মানু‌ষের সকল কৃ‌ষ্টির প্রতি সম্মান দে‌খি‌য়ে বৃহত্তর মানব সমাজকে স‌ঙ্গে নি‌য়ে সাম‌নের দি‌কে এগিয়ে চলা। না হ‌লে বে‌শি বে‌শি জা‌তি জা‌তি করা, জাতীয় আবেগ দেখা‌নোটা হ‌বে হিটলা‌রের ম‌তো জা‌তির শ্রেষ্ঠ‌ত্বের প্রচার করা। প্রতিটা জা‌তির জীব‌নে নানা বিষ‌য় থা‌কে, থা‌কে প‌রিশ্রম, উৎপাদন, বিজ্ঞানচর্চা, সা‌হিত্য; নানা কিছু। পিছ‌নের সকল চর্চা আর আগামী দি‌নে কাজ দেয় না। নতুন চিন্তা‌কে তখন স্থান দি‌তে হয়। সেভা‌বে সংস্কৃ‌তি পাল্টায়, দর্শন পাল্টায়। আবার শ্রেণিবিভক্ত সমা‌জে সকল শ্রেণির এক রকম সংস্কৃ‌তি থাক‌তে পা‌রে না। ধনীর খাবার, ধনীর পোষাক আর গরি‌বের খাবার, গরি‌বের পোষাক এক রকম হয় না।

বাঙ‌ালির কোয়া‌রেন্টাইন ব‌লে কিছু আছে কি? বাঙালি ধনীর আর বাঙালি গরি‌বের কোয়া‌রেন্টাইন এক রকম নয়। হ‌তে পা‌রে না, কারণ সব‌কিছু অর্থনী‌তি দ্বারা নিয়‌ন্ত্রিত হয়। বাংলা‌দেশ নামক এক‌টি রা‌ষ্ট্রের সকল নাগ‌রিক যেমন সমান অধিকার ভোগ ক‌রে না, যেমন ব্যক্তিগতভা‌বে বিমান ভাড়া ক‌রে যখন তখন যে কো‌নো দেশে চ‌লে যে‌তে পা‌রে না, তেম‌নি সকল বাঙালির একক সংস্কৃ‌তি ব‌লে কিছু নেই। সংস্কৃ‌তি বুঝবার জন্য তাই অর্থনী‌তির ধারাটা বুঝ‌তে হয়। অর্থনী‌তির গ‌তিপ্রকৃ‌তি না বু‌ঝে তাই, সংস্কৃ‌তি নি‌য়ে হুটহাট মন্তব্য করাটা সঠিক নয়। সকল বাঙালির সকা‌লের নাস্তাটা একরকম নয়, দুপু‌রের খাদ্য একরকম নয়, রা‌তের খাবার একরকম নয়, সক‌লের আবাস আর আবাসিক সু‌বিধা একরকম নয়। মুসলমান ধনী-গ‌রিব বাঙালির ইফতারটা প্রায় কেমন ক‌রে যেন অনেকটা একরকম। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। ধ‌র্মের বিচা‌রে বাঙালি মুসলমান তো আর সব বাঙালি নয়। ধ‌র্মের বিচা‌রে বাঙালি হিন্দু মা‌নে তো আর‌ সকল বাঙালি নয়।‌

দু’প‌ক্ষের ধর্মীয় সংস্কৃ‌তিগুলিও তো একটা সংস্কৃ‌তি। কিন্তু সেটাও সকল বাঙালির নয়। সকল বাঙালির সংস্কৃ‌তি ত‌বে কোনটা বা কোনগুলি? যেটা দি‌য়ে বিশ্ববাসী বাঙালির প‌রিচয় পা‌বে? বল‌বে হ্যাঁ, এ সংস্কৃ‌তি‌টি ঠিক ঠিক সকল বাঙালির প‌রিচয়? ‌দি‌নের শে‌ষে কথাটা হ‌লো এই, বাঙালি য‌দি নি‌জের গ‌র্বিত প‌রিচয় দি‌তে চায়, সেটা দি‌তে হ‌বে জ্ঞান‌-বিজ্ঞা‌নে অবদান রে‌খে। মানু‌ষের নাগ‌রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। মানু‌ষের খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর বাকস্বাধীনতা নি‌শ্চিত ক‌রে। বিশ্ব মানবতার সাম‌নে তখনই, সে মাথা‌ তু‌লে দাঁড়া‌তে পার‌বে। সংস্কৃ‌তি নি‌য়ে তখন আর বাগাড়ম্বর কর‌তে হ‌বে না। কী তার আলাদা সাংস্কৃ‌তিক প‌রিচয় তা নি‌য়ে তখন আর ভাব‌তে হ‌বে না। সারা বিশ্বের মানব সংস্কৃ‌তি আপন ম‌হিমা নি‌য়ে নিরহঙ্কা‌রে ব‌য়ে যা‌বে নি‌জের ম‌তো ক‌রে।