শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘আততায়ী’
প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০২১
সেদিন সকাল থেকেই আকাশে মেঘ করে এসেছিল। সুবর্ণ অফিস যায়নি। দুপুরবেলা পোস্ট বক্সটা খুলে দেখে একটা চিঠি, চিঠিটা সুবর্ণর নামেই এসেছে। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে নিজের পড়ার টেবিলে রাখে সুবর্ণ। সন্ধ্যাবেলা চা খেতে খেতে চিঠিটা পড়া শুরু করে সে।
অদ্ভুত! চিঠিটা খুলে সুবর্ণ দেখে লেখা আছে কেবল দুটি শব্দ, ‘আমি জানি’। এবার চিঠিটা ভালো করে উল্টে পাল্টে সে দেখে। চিঠিটা কে পাঠিয়েছে তার কোনো ঠিকানা লেখা নেই। নামও নেই। সুবর্ণর শিরদাঁড়া বেয়ে খেলে যায় হিমশীতল ঢেউ। এই চিঠির মানে কি! কে পাঠালো!
সুবর্ণর সাথে মৌমিতার বিয়ে হয়েছে দশ বছর। সম্বন্ধ করে বিয়ে। মৌমিতাকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল সুবর্ণর। কিন্তু বিয়ের পর জীবনটা স্বাভাবিক হয় না ওদের। সমস্যাটা আসে মৌমিতার দিক থেকে। সে জানায়, স্বামী হিসেবে সুবর্ণর প্রতি সব দায়িত্ব পালন করবে মৌমিতা, কিন্তু ভালোবাসতে পারবে না। কারণ রক্তিমকে এখনো ভালোবাসে মৌমিতা, আজীবন বাসবে, কোনোভাবেই তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না সে। এই কথাগুলো সুবর্ণকে বলতে যেন এতটুকু দ্বিধাবোধ হয়নি মৌমিতার। নিষ্ঠুর ভাবেই অকপট হয়েছিল সে।
তবে আগে কেন বললে না? সুবর্ণর স্বাভাবিক ও সহজাত প্রতিক্রিয়া ছিল এটাই।
রক্তিম ওর পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। বিয়েটা পরিবারের মতেই করেছে। আমিও ভেবেছিলাম, সব ভুলে নতুন করে শুরু করব। কিন্তু পারলাম না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল মৌমিতা।
অনেক চেষ্টা করেছিল সুবর্ণ মৌমিতার মন পেতে। কী না করেছে ওর জন্য! শেষে বুঝতে পেরেছে, মৌমিতার ভেতর একটা অংশ কেবল রক্তিমের, যা কোনোদিন ওর হবে না।
সেদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরে সুবর্ণ। গলির মোড়ে বাতিগুলো তখনো জ্বলেনি। সুবর্ণ বাড়ির কাছে এসে খেয়াল করল, সদর দরজাটা খোলা। অন্যদিন দরজা বন্ধ থাকে ভেতর থেকে। বেল বাজলে ভেতর থেকে খুলে দেয় কাজের মেয়ে আরতি। সেদিন দরজা খোলা দেখে সুবর্ণ সোজা ভেতরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই দেখে, দরজার পাশে খুলে রাখা অচেনা একজোড়া জুতো। বুকের ভেতরটা ধকধক করে ওঠে সুবর্ণর। কিসের যেন অশনি সঙ্কেত! নিচের ড্রইংরুম থেকে সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে ওপরের ঘরে। হাতের ব্যাগটা সোফায় আস্তে করে নামিয়ে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে সুবর্ণ।
দোতলায় এসে দেখে, ওদের বেডরুমের দরজাটা খোলা। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সুবর্ণ। দেখে ওদের বিছানায় আধশোয়া হয়ে এলিয়ে আছে এক পুরুষ। সুবর্ণর চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না। ওটা রক্তিম। মৌমিতার কাছে রক্তিমের ছবি দেখেছে সে। মুহূর্তের মধ্যে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে সুবর্ণর। মনে পড়ে যায় কিভাবে এই লোকটার জন্য তাকে বঞ্চিত করেছে মৌমিতা। তীব্র যৌনঈর্ষায় যা এতদিন নীরব অভিমানে সহ্য করেছে তা অদম্য আক্রোশে পরিণত হয় সুবর্ণর মনে। কী আছে এই ছেলেটার মধ্যে যা ওর মধ্যে নেই? কিসের জন্য মৌমিতা রাতের পর রাত সুবর্ণর থেকে মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে?
কিন্তু মৌমিতা কোথায়? মৌমিতাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? নিঃশব্দে কিচেনে যায় সুবর্ণ। ড্রয়ার থেকে বড় ছুরিটা তুলে নেয়। তারপর আবার নিঃশব্দে বেডরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। রক্তিম সেই একই অবস্থায় শুয়ে আছে। ও এত নিস্তেজ কেন? সফল রমণের ক্লান্তিতে নিশ্চয়ই ওর ঘুম পেয়েছে। একটু আগেই মৌমিতার সাথে পুরো বিছানায় সাঁতার কেটেছে ও। চোখের সামনে গোটা দৃশ্যটা দেখতে পায় সুবর্ণ। আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সোজা এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। রক্তিমের চোখ দুটো বোজা। কেমন নির্বিষ সাপের মতো পড়ে আছে বিছানায়। সমস্ত বিষ নিজের শরীরে নিয়ে মৌমিতা নিশ্চয়ই স্নানে গেছে। দুদণ্ড অপেক্ষা না করে সুবর্ণ ছুরিটা সোজা বসিয়ে দেয় রক্তিমের এলিয়ে থাকা ঘাড়ে। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্তিম চোখ খোলে না। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো একটা শব্দ। শুধু ওর শরীরটা একবার মুচড়ে উঠে স্থির হয়ে যায়। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণ। হাত থেকে ছুরি খসে পড়ে। ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। নিজের এতদিনের যন্ত্রণা আর অভিমানকে খুন করে মুক্ত সে।
সুবর্ণ জানে না কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মৌমিতা। আলুথালু ভাব অথচ এতটুকু বিস্ময় নেই তার চোখে মুখে। যেন এই দৃশ্যের সামনে এসে দাঁড়ানোর বহুদিনের তার অপেক্ষা আজ শেষ হলো। মেঝে থেকে ছুরিটা তুলে নেয় সে। ঠাণ্ডা গলায় বলে, বডি কি করবে?
বডি! যে রক্তিমের প্রেমে আসক্ত মৌমিতা একদিনের জন্য সুবর্ণকে কাছে আসতে দেয়নি, তার শরীরের ওপর তার ভালোবাসার ওপর কোনো অধিকার দেয়নি যে রক্তিমের জন্য, আজ তাকেই সে `বডি` বলছে? এতটুকু তাপ উত্তাপহীন পিশাচিনীর মতো চোখে চোখ রেখে কথা বলছে সুবর্ণর সাথে? তার তো ঘৃণা করা উচিত সুবর্ণকে।
সেদিন রক্তিমের বডি সরাতে সুবর্ণকে সাহায্য করে মৌমিতাই। একটা বস্তায় বডি ভরে গাড়ির ডিকিতে করে বহুদূরের এক খালে বডি ফেলে আসে সুবর্ণ। সারা ঘরে লেগে থাকা প্রেমিকের রক্ত নিজের হাতে ধুয়ে মুছে সাফ করে মৌমিতা। এরপর ছয় মাস কেটে গেছে। রক্তিমের অন্তর্ধানে সক্রিয় হয়েছে পুলিশ। কোনো এক সূত্রে একদিন দুপুরে মৌমিতার সাথেও কথা বলে গেছেন ইন্সপেক্টর ঘোষ।
আপনার বন্ধু ছিলেন রক্তিম বাবু? আপনি জানেন ওনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? ওনার ফোনের টাওয়ার বলছে শেষ যেদিন ওনাকে দেখা গিয়েছিল সেদিন উনি এই অঞ্চলে ছিলেন।
মৌমিতা যদিও ওর সাথে রক্তিমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেনি। পুরো ব্যাপারটাই এড়িয়ে গেছে। তবু যাওয়ার আগে মিস্টার ঘোষ বলে গেছেন, দরকার হলে আবার যোগাযোগ করতে পারেন। সুবর্ণর কাছে আগের মতোই নিষ্প্রভ মৌমিতা। বরং আগের থেকে অনেক বেশি উদাসীন। অথচ এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে সুবর্ণকে কোনোদিন একটাও প্রশ্ন করেনি মৌমিতা।
তারপর হঠাৎই এই চিঠি! কে পাঠাতে পারে এই চিঠি? একমাত্র মৌমিতা ছাড়া আর কারোর তো জানার কথা নয়। তবে কি কেউ দেখেছে? ভয়ে সিঁটিয়ে যায় সুবর্ণ। কিন্তু মৌমিতাকে কিছু জানায়না চিঠির কথা। বরং রোজই দু’চার বার করে পোস্ট বক্স চেক করা শুরু করে। এক অদ্ভুত ভয় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো শুরু করে যে সেই অদৃশ্য সাক্ষী নিশ্চয়ই তার পিছু ছাড়বে না, প্রমাণ করেই ছাড়বে যে সুবর্ণ চ্যাটার্জি খুনী!
একমাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার চিঠি আসে সুবর্ণর। শার্টের পকেটে চিঠি নিয়ে অফিস যায় সুবর্ণ। কিন্তু কারো সামনে চিঠি খোলার সাহস করতে পারে না সে। মাথার ভেতর বিষাক্ত ঘোর। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে ঘরের দরজা দেয় সে। মৌমিতা চা নিয়ে এসে কোনো উত্তর না পেয়ে ফিরে যায়। সুবর্ণ ততক্ষণে খাম খুলে রুদ্ধশ্বাসে পড়া শুরু করেছে। চিঠিতে লেখা, খুব অবাক হলেন বুঝি? অবাক হবেন না। প্রতিটি মানুষই আততায়ী। সে কাউকে না কাউকে হত্যা করে বসে আছে। নীরবে। নিজের ভেতর ঘৃণ্য পশুটাকে যত্নে ঢেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু নিজের কাছে কি লুকানো যায়? নিজের বিবেকের কাছে?
ঘামতে থাকে সুবর্ণ। কে লিখছে এসব? কেনই বা লিখছে। চিঠিতে আরও লেখা, ভালোবাসার মানুষ যখন বুকের ওপর দিয়ে চলে যায়, তখন খুব খারাপ লাগে, তাই না সুবর্ণ? ইচ্ছে করে তাকেও শেষ করে দিতে। আসল আততায়ী তো সে যে তোমাকে ওই চক্রান্তের দিকে ঠেলে দিল। অথচ এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউই না। আইনের চোখে খুনী সে যার হাতে খুন হয়। অথচ খুনীই হয়তো মনে মনে খুন হয়ে বসে আছে। কে করবে তার বিচার?
দরজার বাইরে থেকে মৌমিতা ডাকে, ডিনার করবে না?
খেতে বসে বিস্মিত হয় সুবর্ণ। মৌমিতা নিজের হাতে পায়েস করেছে। পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে সুবর্ণকে বলে, ভুলে গেছ আজ তোমার জন্মদিন?
সুবর্ণ সত্যিই ভুলে গেছে আজ তার জন্মদিন। মনে রাখার মতো মানসিক পরিস্থিতি তার নয়। তাছাড়া মৌমিতার থেকে এধরনের আতিশয্য পেতে সে অভ্যস্ত নয়। সুতরাং মনে মনে বিস্মিত হলেও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে সুবর্ণ। তারপর স্টাডি টেবিলে বসে কী যেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সেখানেই।
ঘুম যখন ভাঙে তখন মধ্যরাত। দেখে টেবিলের ওপর রাখা একটা চিঠি। আবার চিঠি দেখেই ওর বুকটা কেঁপে ওঠে। এত রাতে চিঠি কে রেখে গেল? খাম খুলে পড়তে শুরু করে সে, সুবর্ণ, আর ভনিতা করার সময় নেই। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। এবার তাই সত্যিকারের খুনীকে ধরিয়ে দেওয়ার পালা। সেদিন বিকেলে রক্তিম বাড়িতে আসে। ওকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু বিয়েটা ওর সাথে হওয়ার ছিল না। রক্তিম বলে, ও আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। কারণ ওর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ওকে অনেক মানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। এক মুহূর্তেই আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যায় যেন। সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে ওর সাথে চলতে চেয়েছিলাম আমি। এমনকি তোমাকেও...। আর ও কিনা সন্তানের অজুহাতে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়? তাহলে আমার এতদিনের অপেক্ষা বৃথা? নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হতে থাকে। আর সেই থেকেই মাথার ভেতর একটা আগুন জ্বলে ওঠে। কীভাবে কী করলাম জানি না সুবর্ণ। তবে সেদিন তোমার প্রতি আমার অবিচারটা কেমন, তা বুঝেছিলাম। রক্তিমের অগোচরেই ওর ড্রিঙ্কস এ বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিলাম। আমাকে এত নিঃস্ব করে বাঁচার অধিকার নেই ওর। ড্রিঙ্কটা নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অচেতন হয়ে পড়েছিল রক্তিম। আর ঠিক তারপরই তুমি...
প্রকৃত আততায়ী তুমি নও সুবর্ণ। তুমি রক্তিমকে ছুরি মারার অনেক আগেই ও মরেছিল আমার বিষে। আর রক্তিমকে মারার অনেক আগেই আমার হাতে খুন হয়েছিলে তুমি, তোমার বিশ্বাস। আমি তোমার ক্ষমার যোগ্য নই। তোমার জীবন আর বিষাক্ত করব না। তিন তিনটে খুনের আসামি আমি। তবে এবার নিজের হাতে নিজেই। ভালো থেকো।
সুবর্ণ পাশের ঘরে ছুটে যায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এক লাথি মারতেই দরজা ভাঙে। দেখে মৌমিতা পড়ে আছে মেঝেতে। নিথর তার দেহ। পাশে গড়াগড়ি যাচ্ছে ট্রাঙ্কুইলাইজারের ফাঁকা শিশি।