
শ্রেয়া চক্রবর্তী
শ্রেয়া চক্রবর্তীর কবিতা ‘পুনর্মিলন’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
স্কুলের বারান্দায় একটা দোয়েল পাখি
এসে বসতো, ক্লাস এইটের জানলা দিয়ে
বারান্দায় যখন এক চিলতে রোদ্দুর খেলা করতো
দেখেছি ওর চোখ দুটো চিকচিক করছে
লেজ নাচিয়ে যেন ডাকছে আমাকেই।
ভাস্বতী দিভাই তখন ইংলিশ গ্রামারে মন দিতে বলছেন,
এমন সময় `হুশ পাখি` বলে ওকে উড়িয়ে দিলাম একদিন।
মুহূর্তে উড়ে যাওয়ার সময় কেন জানি না মনে হলো,
বড় অভিমান নিয়ে চলে গেল
চলে গেল এত দূর বারান্দার এক চিলতে রোদ্দুরে
আর এলো না কোনোদিন।
এরপর অঙ্ক ক্লাস চলছে, সুদীপ্তা দিভাই হুড়মুড় করে
এসে ক্লাসে ঢুকলেন, এই মেয়েরা বসো-বসো
চক ডাস্টার কিচ্ছু রাখোনি—
দেখলাম একটা টুনটুনি পাখি এসেছে
ডানা দুলিয়ে যেন ডাকছে আমাকেই
আমিও তাকে চোখের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বললাম
ঐ ক্লাসটা শেষ হলেই— ঢং ঢং
পাখিটাকে হাতের পাতায় নিতেই
পাখির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক ভীমরুল
এই প্রকল্প সম্পর্কে সন্দিহান আমি কিছুই না বুঝে
বসে রইলাম একা— অতঃপর আরও একা—
একটা পাখি আমি উড়িয়ে দিয়েছি,
আরেকটি অন্তত আমার হোক—
পড়ায় মন বসে না, তবু সুচিত্রা দিভাই এলেন
প্রশ্ন উনি আমাকে করবেন আমি জানি
উত্তরও আমাকেই দিতে হবে, তাই শান্ত মেয়ের মতো—
এ কী! এবার এক ফিঙে পাখি উষ্ণ শিষ দিচ্ছে
এক চিলতে রোদ্দুরে বারান্দায় ইচ্ছে হলো ছুটে যাই
ঢং ঢং কখন হবে? হতে না হতেই দুরন্ত আমি
ফিঙে পাখি মুঠোর ভেতর রাখতেই দেখি
পাখি নয় , বিরাট এক বিষপোকা বিষ নিষ্ক্রমণের আক্রোশে
মাথা তুলেছে—
আমি কি ভুল দেখছি? মরীচিকা! বারবার ভুল?
মুষ্টিবদ্ধ হতবাক দাঁড়িয়ে আছি একা
রমা দিভাই এসে বললেন, এই এখানে কেন ক্লাসে চলো
না দিদিভাই, ঐ দেখুন একটা চড়ুই পাখি! দিদিভাই!
আমি ঠিক দেখছি তো! এবার আমি ঠিক দেখছি তো?
দৌড়ে গিয়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে যেই ছুঁয়েছি তাকে,
পাখি নয়, সাপ, ভয়ংকর ফণা তুলে
ছোবল দিল আমাকেই!
তারপরও আমি বেঁচে রইলাম। কী আশ্চর্য!
সাপের মাথার মণির মতো, কবির উচ্চারিত মন্ত্রের মতো
আমি বেঁচে রইলাম।
শুধু একটি পাখি যাকে উড়িয়ে দিয়েছিলাম
তার অভিমানে আর কোনো পাখি আমার কাছে এলো না।
এখনও আমি যাই।
ঐ মাঠে যাই, ঐ ঘরে যাই, ঐ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই
নির্জনে একা-একা ঘাসের ওপর শুয়ে থাকি
বেদীর পাশে বসি
গাছেদের জড়িয়ে ধরি
টেবিলে মাথা রাখি
সিঁড়ির রেলিং স্পর্শ করি , নির্জনে একা-একা
মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াই
সামনে একটা শূন্য গ্যালারি
ভুলে যাওয়া সংলাপগুলো আওড়ে দেখি— মাথা ঠুকি
একটি পাখিকে উড়িয়ে দিয়েছি কবেই,
তাই এই স্কুলভর্তি নির্জনতা আমার
এই স্কুলভর্তি শূন্যতা আমার
এই স্কুলভর্তি নিশুত রাত অসময়োচিত বৃষ্টির তীক্ষ্ণতা
আমার,
এইসব অভিসম্পাত আমি জীবন দিয়ে গিলে নেব
একটি পাখিকে উড়িয়ে দিয়েছি কবেই, তাই
আমি আর কোনো পাখির কাছে যাই না।