শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১৯

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০২১

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অস্পষ্ট শব্দোচ্চারণে বাবুজী বলতে থাকে আমার জীবনের অন্ধকারতম সেই রাতের কথা। আগুনে খাক হচ্ছিল গোটা গ্রাম আর জুমেরান রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিল সেই পথে। মানুষগুলোকে যেভাবেই হোক, বাঁচাতে হবে যে! পথেই দাঁড়িয়েছিল কম্পানির লোক। কারণ সবটাই ছিল পরিকল্পিত। জুমেরানকে জোর করে গাড়িতে তোলে তারা। গ্রামের পথ ছাড়িয়ে ফ্রিতির সেতু পার হয়ে গাড়ি বাঁক নেয় কম্পানির দিকে।

বড় গেট পার হয়ে গাড়ি ঢোকে কম্পানির প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানে তিনজন অফিসার ছিল, যাদের একজন মিস্টার ওনাম। যার কদর্য লোভ ছিল আমার শরীরের ওপর। জুমেরানের কাছে আশ্রয় পেয়েছি আমি, এখবর ওনামকে দিয়েছিল বাবুজী। তীব্র যৌনঈর্ষায় জুমেরানকে খতম করে দেয়ার ইচ্ছের কথা সে প্রকাশ করেছিল বাবুজীর কাছে। ফ্রিতির জল নিয়ে কম্পানির সাথে জুমেরানের নেতৃত্বে গ্রামবাসীর যে আন্দোলন, সেটাই তার কাছে ফিরে এলো ব্যক্তিগত ঈর্ষা মেটানোর মোক্ষম সুযোগ হয়ে।

এই অবধি বলে বাবুজী জোরে জোরে শ্বাস নেয় আর ফোঁপাতে থাকে। তার প্রতি বিন্দুমাত্র করুণা হয় না আমার। বরং চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। এসব কথা অনেক আগেই আমাকে জানানোর সুযোগ থাকলেও সে জানায়নি। আমাকে একা ছেড়ে দিয়েছে আমার নিয়তির হাতে। বরং আমার শত্রুকে মদত যুগিয়েছে। একা ও অসহণীয় মৃত্যুই তার প্রাপ্য। ভাবতে ভাবতে আমার ভেতরটা ক্রমশ অনমনীয় হয়ে ওঠে।

একটু থেমে বাবুজী আবার বলতে থাকে, চেম্বারে উপস্থিত কর্মকর্তারা জুমেরানকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে বলে। জুমেরান তার অবস্থানে অনড় থাকার কথা জানায়। কিছুতেই আন্দোলন থামতে দেবে না সে। বরং প্রতিবাদকে আরও মজবুত করবে। নতি স্বীকারের কোনো প্রশ্নই নেই। ঠিক এমন সময় পকেট থেকে রিভলভার বের করে জুমেরানকে তাক করে মিস্টার ওনাম। বলে, তাকে খুন করে ফ্রিতি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। জুমেরান বলে, তার শরীরের রক্ত যদি ফ্রিতির জলে মিশে যায়, সে-ই হবে তার পরম শুশ্রুষা। কিন্তু প্রাণ থাকতে ফ্রিতির জল নিয়ে কোনো অনধিকার চর্চা সে সহ্য করবে না। একথা বলার সাথে সাথেই সোজা দুটো গুলি এসে বিঁধে যায় জুমেরানের বুকে। তার লুটিয়ে পড়া শরীর থেকে চুঁইয়ে বের হয় রক্ত। সেই দৃশ্য দেখে পিপাসা মেটে ওনামের। সেই খবর সে জানায় বাবুজীকে।

হ্যাঁ, এটাই শোনার জন্য এতবছর অপেক্ষা করেছি আমি। এই সত্যের সম্মুখীন হবো বলে অশেষ প্রতীক্ষার ভেতরেও নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুত করেছি। নিজের ভেতর আগুনে পুড়ে পুড়ে খাক হয়েছি। এক বিরাট শূন্যতা ধারণ করতে করতে নিজেই শূন্য হয়ে গেছি। অথচ আজ এতটুকু বিচলিত নই কেন আমি? আমার চোখে এক ফোঁটা জল কেন নেই? জুমেরানের মৃত্যু কি তবে হয়েছিল আমার অন্তরে বহুদিন আগেই? আজ কেবল অপেক্ষার অন্ত হলো। নেই নেই , জুমেরান আর কোথাও নেই। এই আকাশ বাতাস অরণ্য নদী সবই জুমেরানশূন্য। এক হু হু করা বাতাসের মতো আমি আজ। উঠে দাঁড়াই। এখানে প্রয়োজন ফুরিয়েছে আমার।

বাবুজীর দুটো চোখ খোলা। তার দুটি কোণ চিকচিক করছে। আমাকে এই কথাগুলো বলার জন্য এতদিন পাপের ভার বুকে নিয়ে বেঁচে ছিল মানুষটা। এবার হয়তো শান্তিতে চলে যাবে। কিন্তু আমার এসবে কী প্রয়োজন? তবে যাওয়ার আগে নির্ভার করে গেল যে আমায়, শেষ হলো আমার আজীবনের প্রতীক্ষা, এই অনেক। আর কিছু চাই না আমি তার কাছে। পিতা হওয়ার ঋণটুকু শোধ হলো আজ।

ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। গ্রাম্য মহিলাটি দূরে দাঁড়িয়ে নির্বাক চোখে দ্যাখে, এক পিতাকে ছেড়ে সন্তানের শেষবারের মতো চলে যাওয়া। আমি ঘর ছেড়ে নির্মোহ হয়ে হাঁটতে থাকি। যেন কোনো পিছুটান নেই আজ আমার। পরিচিত পথে আমি যেন কে এক অপরিচিতা। বুকের ভেতর শ্মশানের স্তব্ধতা।

হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াই ফ্রিতির ওপর কাঠের সেতুতে। রাত নেমেছে। সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা। পূর্ণ চন্দ্রের আলোয় চারদিকে স্বর্গীয় উজ্জ্বলতা। সেতুর এপার থেকে ওপার অবধি স্পষ্ট দেখা যায়। একবার চোখ বন্ধ করে প্রাণপণ ভাবার চেষ্টা করি, বাবুজীর সব কথা যদি মিথ্যা হয়! যদি চোখ খুলে দেখি, সেতুর ওপ্রান্ত থেকে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে জুমেরান! নিজের শ্বাস গুনতে থাকি।

চোখ খুলি। খুলে দেখি , নাহ্ কেউ নেই। সেই এক আলোকমগ্ন শূন্য পথ। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি ফাঁকা। চলবে