শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১৬

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২১

কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকি। কতক্ষণ তা জানি না। সুজান লিখে চলেছেন। মোমের আলোয় তার শরীরের রেখাচিত্র দেখে দেবমূর্তি বলে মনে হয়। সমস্ত অবয়বটুকু অন্ধকার। শুধু সেই অন্ধকারের সীমা ছুঁয়ে ঠিকরে বেরচ্ছে আলো। এমন দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখিনি। এমন নিবিড় প্রশান্তি অনুভব করিনি আগে। নীরবতার ভেতর তার সাথে আমার নিঃশব্দ সংলাপ দীর্ঘায়িত হয়।

হঠাৎ লেখা থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসেন সুজান। তার মুখ আধো আলো আধো অন্ধকারে ঢাকা। একটি কাগজ এগিয়ে দেন আমার দিকে। আমি হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করি। সুজান বলেন, পড়ো। আমি দেখি সেই কাগজে লেখা কিছু শব্দ, সুজানের নিজ হাতে লেখা: অপেক্ষা করেছে তোমায় নিগূঢ়। দ্যোতনা অনুপূর্ব। শুধু বদলে যাচ্ছে খুঁটি। সে আছে তাই আছ তুমি। অপেক্ষারও তোমাকে প্রয়োজন, অনুপমা, মৃত্যু অবধি। সে নেই। যে আছে দেখা হোক তার সাথে।"

এসব কি লিখেছেন সুজান? সমস্ত অক্ষরগুলো আমার চোখের সামনে ঝাপসা হতে থাকে। এ কি কোন সঙ্কেত? ‘সে নেই। যে আছে দেখা হোক তার সাথে।’ এসবের মানে কি? কে নেই? কার সাথে দেখা হবে? অসহায়ের মতো সুজানের দিকে তাকাই। তিনিও দেখছেন আমাকেই। এবার বলে ওঠেন, যে প্রশ্ন তোমার মনে, যা জানতে এসেছ, এই তার উত্তর। এর ব্যাখ্যা আমার কাছে চেয়ো না। আমি লিখিনি। এই কলমে যার স্পন্দন ধরা দেয়, সে আমি নয়। আমি কেবল অনুবাদক। শব্দে প্রকাশ করি।

বাকরহিত হয়ে বসে থাকি। বিস্ময়ের রেশ কাটে না আমার। চোখ দিয়ে জল ঝরে অবিরাম। সুজান আমাকে ঈশারায় কাছে ডাকেন। আমি তার হাঁটুতে মাথা রেখে বসি। তার হাত আমার কপালে। কী উষ্ণ সেই স্পর্শ, আমার ভেতরের কঠিন বরফ গলে জল হতে থাকে। ক্রমশ ভিজি সেই ফল্গুস্রোতে। কতক্ষণ এভাবেই বসে থাকি, জানি না। জানলা দিয়ে ভোর আসে। মোমের আলো নিভে গেছে তার বহু আগে। সুজান উঠে দাঁড়ান ধীরে। হেঁটে ধীরে ধীরে নেমে যান সিঁড়ি দিয়ে। আমি তার পদধ্বনি শুনি একা ঘরে বসে।

দরজায় এসে দাঁড়ায় সেই বালক। বলে, এখন প্রার্থনার সময়, এসো। নিচে গিয়ে দেখি, একটু দূরে রডডেনড্রন বাগিচার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একদল বালক বালিকা। তাদের সবার আগে সুজান। তিনি গান গাইছেন ঈশ্বরকে স্মরণ করে। গলা মেলাচ্ছে বালক বালিকার দল। তাদের ঘিরে তুষারের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে আছে লাল পাপড়ি। প্রার্থনা শেষে সামান্য আহার। তারপরেই সুজান যাবেন স্কুলে পড়াতে।আমাকেও ফিরে যেতে হবে বেহেস্তে।

গতরাতে তার দেয়া কাগজটিই আমার প্রাপ্তি। সেই মহৎ উপঢৌকনের গরিমা নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই শেষবারের মতো। বলি, তবে আসি? সুজান হেসে বলেন, ফিরে যাও সাবধানে। মুখে সেই ঈশ্বরসুলভ হাসি। আমি বলি, আপনার বই পড়েছিলাম বেহেস্তের লাইব্রেরিতে, সেই বই আমাকে এতদূর টেনে আনলো। সত্যিই কি যা দেখা যায় না, আপনি তা দেখতে পান? সুজান তার হাসির রেশ ধরে রেখেই বলেন, আর যা যা দেখা যায় সেই সব দেখতে পাও তুমি? তোমরা দেখতে পাও সেই সব কিছু? ভালো করে দেখো, পথে যেতে যেতে, কত কিছু দেখেও দেখনি এতদিন...

আমি সুজানের চরণ স্পর্শ করি। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেন। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যান স্কুল বাড়িটির দিকে। আমি পা বাড়াই ফেরার পথে। ঢাল বরাবর নামতে থাকি। নামতে নামতে দেখি, পথের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি বয়ে যাচ্ছে একটি ঝরনা। আমি এ পথেই এসেছি। অথচ এই ঝরনাটি আমার চোখে পড়েনি তো। কী আশ্চর্য! নাকি আমি দ্বিধাহীনভাবে পাথরে পা রেখে ঝরনাটি টপকে চলে গেছি এপার থেকে ওপার অবলীলায়। আরও কিছুটা পথ নেমে এসে দেখি, পথের পাশেই একটি গুহা। তার সামনে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বালানো, রাখা আছে সাদা ফুলের গুচ্ছ। গুহার কাছে গিয়ে দেখি, সেখানে খোদাই করে লেখা আছে কিছু। বোধহয় কারো এপিটাফ। যাওয়ার পথে চোখে পড়েনি এসব কিছুই। চোখে পড়েনি অরণ্যে ফুটে থাকা অজস্র বুনো ফুল। কিছুই দেখিনি কেবল তুষারের আবরণটুকু ছাড়া। অথচ এ সবই ছিল, আছে।

একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অবধি এসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করি। গাড়ি আসে। আমি উঠে বসি গাড়িতে। মনে হয় আমি সেই মানুষ, শুধু যার দেখার চোখদুটি প্রসারিত করে দিয়েছেন সুজান। ব্যাগ থেকে তার লিখে দেয়া চিরকুটটি বের করি পড়ি। বারংবার পড়ি, অপেক্ষা করেছে তোমায় নিগূঢ়। দ্যোতনা অনুপূর্ব। শুধু  বদলে যাচ্ছে খুঁটি। সে আছে তাই আছ তুমি। অপেক্ষারও তোমাকে প্রয়োজন, অনুপমা, মৃত্যু অবধি। সে নেই। যে আছে দেখা হোক তার সাথে।

কে নেই? কার সাথে দেখা হবে? আমি সেই প্রহরের জন্য হৃদয়ের দ্বার অবারিত করি... চলবে