শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’
পর্ব ১৩
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৯, ২০২০
ক্রিস্তভ বলে, তোমাকে বলবো ভেবেছিলাম কথাগুলো, কিন্তু বলে ওঠা হয়নি। রুবিয়ানায় আমারা আসে বছর পাঁচেক আগে। বেহেস্তের একটি বারে সে আগেও নাচতো। সেখানেই তার সাথে আমার প্রথম আলাপ। সে রুবিয়ানায় কাজ করতে চায়। আমারা অসামান্য সুন্দরী। নাচেও দারুণ। সে থাকা মানে ব্যবসায় সাফল্য অবধারিত। আমারা আসে রুবিয়ানায়। প্রতিটি সন্ধ্যা সে জমিয়ে দেয় তার উদ্দাম লাস্যের উত্তাপে। সুরাপ্রেমীদের ভিড় উপচে পড়ে। কেউ কেউ আসে কেবল আমারার টানে। তার প্রতি আকর্ষণ ছিল আমারও।
এক সন্ধ্যায় এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটে রুবিয়ানায়। তখন সন্ধ্যা জমে উঠেছে পুরোদমে। চলছে নাচগান আর সুরাপান। বারের এককোণে বসেছিল এক ভিনদেশি পুরুষ। হঠাৎ মদ্যপ অবস্থায় আমারার দিকে এগোয়। সকলে সচেতন হওয়ার আগেই সে নৃত্যরতা আমারাকে কোলে তুলে নিয়ে পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করে ওপরের দিকে তাক করে। রুবিয়ানার বাকি লোকেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে তখন। আমারা ভয়ে চিৎকার করছে। আমি গিয়ে দাঁড়াই লোকটির মুখোমুখি। লম্বা চওড়া লোকটি ভিনদেশি ভাষায় কিছু বলে, যার অর্থ বোঝা যায় না।
লোকটি বোধহয় আমারাকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। আমি শান্তভাবে বলি তাকে পিস্তল রেখে দিতে। লোকটি কোনো কথায় কান না দিয়ে আমারাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। কোনো উপায় না দেখে আমি একটা ছুরি তুলে নিয়ে লোকটির ঊরুতে গেঁথে দেই। লোকটি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমারাকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রুবিয়ানা থেকে বেরিয়ে যায়।
এর দুদিন পরে আমারা আমাকে বলে, তার একা একা থাকতে খুব ভয় করছে। তাকে বেশ শঙ্কিত দেখায়। আমি তাকে বলি, কোনো অসুবিধা না থাকলে সে আমার বাড়িতে ক’দিন থাকতে পারে। আমারা সহজেই রাজি হয়। সে আমার বাড়িতে থাকা শুরু করে। দিনরাত সে প্রেম করে আমাকে। বলে, ক্রিস্তভ তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, আজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আমি। তার অগাধ সৌন্দর্য, তার অবাধ যৌবন ও লাস্য আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়। কেবল তার প্রেমে ডুবে থাকি। একদিন আমারা বলে, সে আমার সন্তানের মা হতে চলেছে।
কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবেই এই খবর আমাকে আনন্দ দেয় না। আমি বুঝতে পারি, আসলে আমারার প্রতি আমার যে আকর্ষণ তার মধ্যে কোনো ভালোবাসা নেই, সে নেহাতই শারীরিক। সে হঠাৎই আমার কাছে ধরা দিয়েছে আর আমি তার ভেতর ডুব দিয়েছি। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা যে ঘটে যাবে, তা ভাবিনি। আমারা হয়তো আমাকে ভালোবেসেছিল। সে আমাকে বলে, প্রয়োজন হলে সে একাই সেই সন্তানের জন্ম দেবে ও দায়িত্ব পালন করবে। বেহেস্তের অনেক মেয়েরাই এমন জীবন যাপন করে। আমার প্রতিক্রিয়ায় সে নিশ্চয়ই আহত হয়। বলে, ভালোবাসা চাই না, তবে তোমার জীবন থেকে আমাকে মুছে দিও না।
সেদিন এসেছিল সে কথা বলতে। তোমার সাথে দেখা হলো তার। আমারাকে আমি ভালোবাসতে পারিনি। তার আগুনে কিছু সময় পুড়েছি মাত্র। ওকেও পুড়িয়েছি। কিন্তু মারিয়া, তোমার মধ্যে আমি প্রশান্তি পেয়েছি। আমি ভালোবাসি তোমাকেই। হয়তো এই কথাগুলো অনেক আগেই বলা উচিত ছিল তোমাকে। বিশ্বাস করো, আমার জীবনে অতীতের কিছু দাগ থেকে গেছে মাত্র। কিন্তু অতীতের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি শুনি তার সব কথা। যত শুনি তত আমার ভেতরটা আরও শূন্য হতে থাকে। কে যেন আমার ভেতর এক মরা নদীর জন্ম দিয়েছে। জল নেই তাতে, চাঁদের ছায়া পড়ে না। শুধু একটি সাঁকো আজীবন তার ওপর দুলতে থাকে। আমি ক্রিস্তভ কে বলি, তুমি এখন ফিরে যাও। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। আমাকে দু’দণ্ড একলা থাকতে দাও। জীবন তো এমনই। কোথাও পৌঁছনোর নেই আমার। তবু এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা বহন করে করে একে অপরকে আঁকড়ে ধরা। কখনো জৈবিক স্বার্থে, কখনো প্রশান্তির জন্য। তুমি এখন ফিরে যাও ক্রিস্তভ।
তাকে বড় শূন্য দেখায়। সে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে একবার ফিরে দেখে। তারপর বেরিয়ে যায়। দরজাটা খোলাই রয়ে যায়। এলোমেলো হাওয়া দেয়। আবার বোধহয় বৃষ্টি আসবে। আমি মনে মনে ভাবি, ক্রিস্তভ হয়তো আমাকে সত্যিই ভালোবাসে, কিন্তু আমি? আমি কি তাকে ভালোবাসি? যদি ভালোবাসি তবে আমার এই উদাসীনতা কেন? এত দ্বন্দ্বের মাঝে আমার অসহায় লাগে। ইচ্ছে করে, প্রেম নয়, নয় কোনো প্রয়োজন, কেবল কারো বুকের ভেতর মাথা দিয়ে পড়ে থাকি, নীরবে... চলবে