শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১২

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১২, ২০২০

বেহেস্তে নিজের ঘরে ফিরে বিধ্বস্ত পাখিটির মতো বসে থাকি। যে নীড় নিজের ভেতর একটু একটু করে নির্মাণ করা শুরু করেছিলাম, হঠাৎ সে যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো এদিক ওদিক। ক্রিস্তভ একাধিক বার আমার কাছে জাহির করেছে আমার প্রতি তার ভালোবাসার কথা। তবে কি তাকে চিনতে এত ভুল হলো? আমারার সাথে তার সম্পর্কের কথা কেনই বা সে গোপন করলো আমার কাছে? এই দ্বিধার ভেতর এত দ্বন্দ্ব নিয়ে কার কাছে আশ্রয় পাব আমি? বড় হতাশ লাগে। সেই বড় অন্ধকার বড় শূন্যতার ভেতর জুমেরানকেই ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। সে আমার ভেতর যে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে দিয়ে গেছে, প্রতিক্ষণ তাকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা বুকে নিয়েও যে না ফিরে পাওয়ার ভয়, সেই তো আমাকে তাড়িত করেছে ক্রিস্তভের দিকে।

এসব ভাবতে ভাবতে দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরে। নিরুত্তর ভালোবাসার নোনাজল চিবুক বেয়ে কণ্ঠ বেয়ে নামে। আমার এমন পাগলপারা রূপ দেখে মিশ্মি এসে বসে পাশে। বলে, মা তুমি কেন কাঁদছো, বাবা ঠিক ফিরে আসবে। শিশু কন্যাটি তার মায়ের ভেতরে ওঠা ঝড় সম্পর্কে অজ্ঞাত। তবু কিছু আন্দাজ করে। তার চেয়েও আশ্চর্যের তার দৃঢ় প্রত্যয় যে, তার বাবা ঠিক ফিরে আসবে।

দুদিন বাড়ি থেকে বের হই না। স্টোরেও যাই না। চুপচাপ শুয়ে থাকি সারাদিন। ফ্রিতির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি নিজের অজান্তে। তৃতীয় দিন সকালবেলা বাড়ির দরজায় বেল দেয় কেউ। একবার দুবার তিনবার। আমি বুঝি ক্রিস্তভ। প্রথমে ভাবি, দরজা খুলবো না। সাড়া না দিয়ে চুপ করে পড়ে থাকবো। সাড়া না পেয়ে  ক্রিস্তভ দরজায় ধাক্কা দেয় বারবার।

টলমল সত্তাকে কোনোক্রমে টেনেটুনে দরজার কাছে নিয়ে যাই। দরজা খুলে দাঁড়াই নিথর মূর্তির মতো। সামনে ক্রিস্তভ। সে বলে, আমাকে ভেতরে আসতে দাও, এভাবে দরজা আগলে দাঁড়িও না, আমাকে বলতে দাও।

আমি নীরব হয়ে বসি। যেন ভেতরের সব ঝড় আমি আত্মস্থ করে ফেলেছি। যেন কোনো প্রশ্ন নেই আমার। কিছুই বলার নেই। আমি ক্রিস্তভের চোখের দিকে দেখি। দে,খি সেও বড় অশান্ত বড় বাঙ্ময়, বহু আবেগের দোলায় দোদুল্যমান উদভ্রান্ত এক দৃষ্টি তার। অথচ এই ক্রিস্তভকেই কত শান্ত মনে হতো, যেন নিদারুণ এক আশ্রয়।

ক্রিস্তভ বলে, আমাকে ভুল বুঝো না মারিয়া। আমি তোমার থেকে কিছুই গোপন করতে চাইনি। আমারার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছ আমি তোমাকেই চেয়েছি। আমার ভালোবাসায় কোনো মিথ্যে নেই মারিয়া। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমাকে গ্রহণ করো। এ কথা বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ক্রিস্তভ।

আমি তাকে বলি, এত কেন জবাবদিহি করছ। তুমি স্বাধীন। এই শহরে একাকী চলার পথকেই বেছে নিয়েছিলাম আমি। সেজন্যই বহুদূরে ফেলে এসেছি আমার যাবতীয় পিছুটান। তুমি এলে। তোমার মধ্যে যেন আমার পুনর্বীকরণ হলো। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জেগে উঠলো। একটা মরা গাছকে বাঁচিয়েছ তুমি। তাই হয়তো একটু বেশিই আঁকড়ে ধরেছিলাম। কখনো তো জানতে চাইনি, তুমি কি চাও, তোমার কি অতীত। এত কিছু কি আমার প্রাপ্য হয়, বলো? ক্রিস্তভ তুমি স্বাধীন পুরুষ। তুমি যেদিকে খুশি যেতে পারো।

ক্রিস্তভ আমার দুটি হাত চেপে ধরে। বলে, আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিও না মারিয়া। আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই। আমারার সাথে যাবতীয় যোগাযোগ ছিন্ন করতে চাই আমি।

তবে একথা আমাকে আগেই জানালে না কেন? আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি মুক্ত পুরুষ ক্রিস্তভ। তুমি যার কাছে খুশি যেতে পারো, যতদূর খুশি।  তবু প্রেমেরও এক নিজস্ব ধর্ম আছে, নিজের অভিমান। যদি ভালোবেসে থাকো তবে সেই ভালোবাসার কি অধিকার ছিল না তোমার আলোকিত স্পষ্ট অস্তিত্বের সামনে দাঁড়ানোর। কেন নিজেকে অন্ধকারে রাখলে? মানবের এই সঙ্কট। জানি ক্রিস্তভ। সে কখনোই পারে না মুক্ত আলোর সামনে নিজেকে নিঃসংশয়ে মেলে ধরতে। এই সংশয়ই তার সবচেয়ে কঠিন অসুখ।

ক্রিস্তভ মাথা নিচু করে বসে। এমন ভারাক্রান্ত রূপ তার আগে কখনো দেখিনি। যে মানুষ ভালোবাসেনি সে এত ভারাক্রান্ত কেন হবে। তার দ্বিখণ্ডিত সত্তার দ্বন্দ্ব আমি বুঝতে পারি। প্রতিটি মানুষই এমন করে জর্জরিত। ক্রিস্তভকে দেখে তার ওপর রাগ নয়, বড় মায়া হয় আমার। চলবে