শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘মায়ানগর’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২১, ২০২৩

এসময়টা রোজ বারান্দায় এসে বসে অনুমেয়। সকালের রোদের একফালি বারান্দায় এসে পড়ে তখন। সেই উষ্ণতার আবেশ ভালো লাগে তার। কবি অনুমেয় সোম, কে না চেনে তাকে! তার কবিতার অবিস্মরণীয় সব পঙক্তি মানুষের মুখে-মুখে ফেরে।

 

বছর খানেক হলো, অ্যামনেশিয়ায় ভুগছে অনুমেয়। তার স্মৃতিপট থেকে অবাধ্য স্মৃতিগুলো মুছে যাচ্ছে বেখাপ্পাভাবে। কতকিছুই যে তার আর মনে পড়ে না! অথচ কবিতার পঙক্তিগুলো অনুগত প্রেমের মতোই তাকে জড়িয়ে থাকে। আর একটি নাম বারবার তার স্মৃতিতে ফিরে আসে, অমৃতা। কিন্তু অমৃতাকে স্পষ্ট উপলক্ষ করে তোলার মতো আর কিছুই তার মনে নেই।

 

শুধু কিছু চিঠি রয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই সেগুলো পড়ে অনুমেয়। স্মৃতিকোষ থেকে মুছে গেছে যেসব দিন তার উষ্ণতায় খুঁজে নিতে চায় খুব অস্পষ্ট এক মানবীকে। আজও যেমন খাম খুলে হলুদ পাতার একটি চিঠি পড়তে পড়তে তার চোখ দুটো আরক্ত হয়ে আসছে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা— কবি, তোমার লেখা পড়লাম। তারপর থেকে মুগ্ধ হয়ে বসে আছি। দিন যায়। কী অপার অদ্ভুত সেতুবন্ধন তোমার আমার। তুমি কি আমাকে অনুভব করো? কবে দেখা হবে কবি? এই বহুদূর মায়ানগর থেকে একদিন ঠিক তোমার শহরে পৌঁছে যাব। ইতি, তোমার অমৃতা

 

ঘোর কাটে ভ্রমিতার কণ্ঠে, চাটা নাও। আর এই ওষুধগুলো। একটা খাওয়ার আগে... ভ্রমিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে ওঠে অনুমেয়, কেন মনে করিয়ে দাও এসব? আমি আর কোনোদিন ভালো হবো না। মাঝে মাঝে তোমাকেও অচেনা মনে হয়। এই খাবার এই ওষুধ এতকিছু মনে করিয়ে দেওয়ার কি প্রয়োজন যদি না অমৃতাকে মনে পড়ে… কে অমৃতা… বলো … কোথায় সেই মায়ানগর… অমৃতা বলেছে সে আসবে।

 

ভ্রমিতা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বেল বেজে ওঠার শব্দে চকিত দুজন। ভ্রমিতা দরজার দিকে এগোতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় অনুমেয়, কে এলো? কী হলো, সাড়া দাও?

 

দুধঅলা দুধ দিয়ে যায়। ফ্রিজে প্যাকেট ঢোকাতে ঢোকাতে ভ্রমিতা বলে, ওষুধটা খেয়ে নাও।

 

কী যেন বিড়বিড় করতে করতে অনুমেয় ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একমনে বলতে থাকে, কেন থেকে যাও? এরপরও… এতকিছুর পরেও… একদিন তোমাকেও আর চিনতে পারবো না। অমৃতা বলেছিল সে আসবে। সে আসলে তুমি কি চিনবে তাকে? চিনিয়ে দেবে আমাকে?

 

কোলের ওপর খাতাটা টেনে নিয়ে কী যেন লিখতে থাকে অনুমেয়। হয়তো না-হয়ে ওঠা কোনো কবিতাকে কেটেকুটে ঠিক করার চেষ্টা। ঠিক এমন সময় বেলটা আবার বেজে ওঠে। এলার্ম দেওয়া ঘড়ির মতোই হঠাৎ কবিতা থেকে জেগে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায় অনুমেয়।

 

রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল ভ্রমিতা। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে দরজাটা খুলতেই বাজারের ব্যাগ হাতে ঢোকে কাজের মেয়ে কুসুম। সোজা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, উফ বাবা, সবজির কী দাম গো বৌদি... বলেই বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে ধপ করে মেঝেয় বসে পড়ে।

 

অনুমেয় তখনও দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। ভ্রমিতা বলল, বারবার দরজার কাছে কেন ছুটে আসছ?
অনুমেয় বারান্দার দিকে ফিরে যেতে যেতে বলে, অমৃতা আসবে।

 

কুসুমকে রান্নাটা বুঝিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ভ্রমিতা। বলেন, অমৃতা আসবে না।
অনুমেয় কী যেন লিখছিল। কলম থামিয়ে ভ্রমিতার দিকে তাকায়। চোখের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা নিয়ে সে বলে ওঠে, কেন? কেন আসবে না অমৃতা?

 

সে এসেছিল বহুবছর আগে। ভ্রমিতা বলে, তোমার কবিতার সাথে সম্পৃক্ত হতে। তারপর সে আর ফিরে যায়নি। তুমি তার কাছে নতুন জীবন চেয়েছিল, তাকে চেয়েছিলে পুনর্নবার মতো, তার নাম রেখেছিলে অমৃতা। অমৃতা তার আসল নাম নয়। কবিতায় তুমি তাকে অমৃতা বলে ডেকেছ। সেই কবিতার সরণী পার করে বহুবছর হল সে রয়ে গেছে এই বাড়িতে তোমার অন্ন আর ওষুধের দায়িত্বে… তোমার স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝখানে। তাকে চিনতে পারো অনুমেয়?

 

হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ভ্রমিতা । চিঠিগুলো দেখিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল অনুমেয়, ঠিক এমন সময় বেলটা বেজে ওঠে। আজ তৃতীয়বার। আমি খুলছি, বলে চোখ মুছতে মুছতে দরজার দিকে এগোয় ভ্রমিতা। দরজা খুলে সে দেখে, লাল পাড় সাদা শাড়ি এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। বয়স চল্লিশের কাছে। কপালে গাঢ় লাল টিপ। মুখের আদলে প্রচ্ছন্ন হাসি, বহু বছরের অপেক্ষা শেষ হলে যেমন হয়। জিজ্ঞেস করে, কবি আছেন?
ভ্রমিতা বলে, আপনার নাম?
ওদিক থেকে উত্তর আসে, অমৃতা।
অনুমেয় ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রমিতার ঠিক পিছনটাতে।