শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের গল্প ‘অসমাপ্ত’

প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২১

কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৯০১ সালের ১৮ মার্চ ভারতের বীরভূম জেলার রূপসীপুর গ্রামে তার জন্ম। বাবা ধরণীধর মুখোপাধ্যায়, মা হেমবরণী দেবী। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘অসমাপ্ত’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

রাখাল-মাস্টারকে লইয়া গল্প লেখা চলে কিনা কে জানে! রাখাল-মাস্টার ইস্কুলের মাস্টার নয়— পোস্টমাস্টার। আমি গল্প লিখি এবং সেই-সব গল্প কাগজে ছাপা হয় শুনিয়া অবধি রাখাল-মাস্টার আমায় কত দিন কতবার যে তাহাকে লইয়া একটা গল্প লিখিয়া দিতে বলিয়াছে তাহার আর ইয়ত্তা নাই। একটি একটি করিয়া সে তাহার জীবনের প্রায় সমস্ত ঘটনাই আমাকে বলিয়াছে কিন্তু সেগুলিকে পরের পর সাজাইয়া কেমন করিয়া যে গল্পের আকারে লিখিয়া ফেলিব তাহা আমি আজও ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই।

এই বলিয়া গল্পটি একবার আরম্ভ করিয়াছিলাম! দেখিতে নাদুশনুদুশ, নালা-ক্যাবলা-গোছের চেহারা, চোখে নিকেলের ফ্রেম-দেওয়া চশমা, মাথার চুলগুলি ছোট-ছোট করিয়া কাটা, রাখালকে দেখিলে ঠিক পাগল বলিয়া মনে হয়। এই পর্যন্ত শুনিয়াই ত’ রাখাল-মাস্টার চটিয়া আগুন। বলিল, ‘না, তোকে লিখতে হবে না, তুই যা মিছে কথা বানিয়ে বানিয়ে… এমনি করেই লিখিস তোরা তা আমি জানি।‘ বলিয়া খানিকক্ষণ মুখ ভারি করিয়া বসিয়া থাকিয়া চশমার ফাঁকে একবার চোখ দুইটি তুলিয়া বলিল, যা বাপু যা, তুই এখন বিরক্ত করিস নে আমার হিসেব ভুল হয়ে যাবে। বেরো তুই এখান থেকো’।

বলি, ‘চটো কেন মাস্টার, শোননই না শেষ পর্যন্ত।’
‘হ্যাঁ, খুব শুনেছি।’ বলিয়া কলমটা মাস্টার তাহার কানে খুঁজিয়া রাখিয়া সোজাসুজি আমার মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, ‘পাগল কাকে বলে জানিস?না—অমনি লিখে দিলেই হলো।’
হাসিয়া বলিলাম, ‘পাগল ত লিখিনি। লিখেছি—পাগলের মত!’
‘ওই একই কথা।‘ বলিয়া হাত নাড়িয়া আমাকে সে চুপ করাইয়া দিয়া বলিল, ‘পাগল বলে কাকে জানিস? পাগল বলে—তোদের গাঁয়ে ওই নিবারণ মুখুজ্যেকে। চব্বিশ ঘণ্টা বৌ আর বৌ। সেদিন বললাম, বলি—ওহে নিবারণ, বোসো, তামাক-টামাক খাওা ঘাড় নেড়ে বললে, না ভাই, উঠি। বেলা হয়ে গেছে,–বৌ বকবে। ওই ওদের বলে পাগল। বুঝলি?’

বলিয়া কান হইতে কলমটি আবার তাহার হাতে লইয়া নিশ্চিন্ত মনে মাস্টার তাহার কাজ আরম্ভ করিতেছিল, হঠাৎ কি মনে হইল, আবার মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিল, ‘মিছে কথা না লিখলে তোদের গল্প লেখা হয় না। তবে কাজ নেই বাপু লিখে, মিছে কথা আমি ভালবাসি না।’

সেই দিন হইতে কিছুই আর লিখি নাই। ধানের মাঠের উপর দিয়া প্রায় ক্রোশ-খানেক পথ হাঁটিয়া প্রকাণ্ড একটা বন পার হইয়া গ্রামের শেষে, গুটিকয়েক আমগাছের তলায়, ছোট্ট সেই পোস্টাপিসটিতে প্রায়ই আমাকে যাইতে হয়। কোনোদিন হয়ত দেখি,দরজায় খিল বন্ধ করিয়া পোস্টাপিসের মেঝের উপর তালপাতার একটি চাটাই বিছাইয়া রাখাল মাস্টার তাহার হিসাব লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। চারিদিকে কাগজ ছড়ানো, উড়িয়া যাইবার ভয়ে কোনোটার উপর প্রকাণ্ড একটা মাটির ঢেলা, কোনোটার। উপর আস্ত একখানা ইঁট, কোনোটা বা পায়ের নীচে চাপা দেওয়া, মুখে বিরক্তির ভাব ঝড় বাতাসের উদ্দেশে যাহা মুখে আসিতেছে তাই বলিয়া অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দিতেছে, আর আপন মনেই কাজ করিতেছে।

হাসি আর কিছুতেই চাপিয়া রাখিতে পারি না। অবশেষে অতি কষ্টে হাসি চাপিয়া বলি, ‘ওহে মাস্টার, দরজাটা একবার খুলবে নাকি?’
আর যায় কোথা! ভিতর হইতে মাস্টারের চীৎকার শোনা গেল,—তা আবার খুলব না! সময় নেই, অসময় নেই…বেরো বলছি, পালা এখান থেকে, নইলে খুন করে ফেলব।’
বাস—চুপ।
কাগজের খুস খুসশব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভাবিলাম, আর-একবার ডাকি। কিন্তু ডাকিতে হইল না। জানলার কাছে খুট করিয়া শব্দ হইতেই তাকাইয়া দেখি, রাখাল-মাস্টার কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

চোখোচোখি হইবামাত্র বলিয়া উঠিল, ‘সাড়ে তের আনা পয়সার গোলমাল। বুঝলি? আসুক ব্যাটা পিওন, আমি তার চাকরির মাথাটি খেয়ে দিচ্চি—দ্যাখ!’

অত-সব দেখিবার অবসর তখন আমার নাই। সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, অতখানা পথ আবার আমায় একা ফিরিয়া যাইতে হইবে। বলিলাম, ‘দোরটা একবার খোল মাস্টার, চিঠিপত্রগুলো দেখেই আমি চলে যাব।’

কেন জানি না, হঠাৎ সে প্রসন্ন হইয়া দরজা খুলিয়া দিল। ভিতরে ঢুকিলাম। সেদিনের ডাকের চিঠিপত্রগুলো ছিল একটা খাটিয়ার নীচে। রাখাল-মাস্টার বাড়াইয়া দেখাইয়া দিয়া বলিল, ‘দেখিস, যেন আর কারও চিঠি নিসনে!’
অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইলাম। এমন কথা সে আমাকে কোনো দিন বলে না।

মাস্টার বলিল, ‘কত সব মজার মজার চিঠি থাকে তা জানিস? তুই ত কোন ছার, খাম-টাম খোলা-টোলা পেলে এক-একদিন আমিই দেখি! দেখে আবার বন্ধ করে দিই!—শুনবি তবে? একদিন একটা মেয়ে লিখেছে—’ বলিয়া সে শতচ্ছিন্ন দড়ির খাটিয়াটির উপর চাপিয়া বসিয়া হয় ত’ কোনও মেয়ের চিঠির গল্প আরম্ভ করিতেছিলা আমার মাত্র দু’খানি চিঠি হাতে লইয়া বলিলাম, ‘থাকা ও-গল্প তোমার আর-একদিন শুনব, আজ উঠি। ‘

‘তা উঠবি বই-কি নিজের কাজ সারা হয়ে গেছে ত’! যা।’ বলিয়া সে একরকম জোর করিয়াই আমার ঘাড়ে ধরিয়া দরজাটা পার করিয়া দিয়া আবার ভিতর হইতে খিল বন্ধ করিয়া দিল। আর-একদিন অমনি চিঠির খোঁজে ডাকঘরে গিয়াছি। দেখিলাম, দরজা বন্ধ। ভিতরে স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া সুরু হইয়াছে। তুমুল ঝগড়া!

কি লইয়া ঝগড়ার সূত্রপাত, বাহির হইতে কিছুই বুঝা গেল না। রাখাল-মাস্টার ক্রমাগত নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে, আর স্ত্রী বলিতেছে, —না তুমি সাধু নও, তুমি ভণ্ড, তুমি বদমাস, তুমি শয়তান।’

অবশ্য মুখ দিয়া যে ভাষা তাহাদের অনর্গল বাহির হইতেছে তাহা শুনিলে কানে আঙুল দিতে হয়। দু’জনেই সমান। যেন স্বামী, তেমনি স্ত্রী! কেহই কম যান না।

নিতান্ত অসময়ে আসিয়া পড়িয়াছি। একবার ভাবিলাম, চলিয়া যাই, আবার ভাবিলাম, এতখানা পথ হাঁটিয়া আসিয়া ‘ডাক’ না দেখিয়াই বাড়ী ফিরিয়া গেলে আফসোসের আর বাকি কিছু থাকিবে না। যা থাকে কপালে’ বলিয়া কাশিয়া গলাটা একবার পরিষ্কার করিয়া লইয়া ডাকিলাম, ‘মাস্টার!

উভয়েরই গলার আওয়াজ তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইয়া গেল। এত সহজে বন্ধ হইবে ভাবি নাই। দরজা খুলিয়া রাখাল-মাস্টার মুখ বাড়াইয়া বলিল, ‘ও, তুই! আয়, তোর আজ মেলা চিঠি।’

মাসের প্রথম কয়েকখানা মাসিকপত্র আসিয়াছিল। হাতে লইয়া সেদিন আর দেরি না করিয়াই উঠিতেছিলাম। রাখাল-মাস্টার বলিল, বোস, কথা আছে।’

বাধ্য হইয়া বসিতে হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি কথা?’ মাস্টার বলিল, ‘শুনেছিস? ঝগড়া আমাদের?’ বলিলাম, ‘শুনেছি। কিন্তু বুঝতে কিছু পারি নি।’ মাস্টার তিরস্কার করিতে লাগিলেন—’বুঝতে পারিস নি কিরকম? তুই না গল্প লিখিস?—এ ত’ একটা কচি ছেলেতেও বুঝতে পারে।’ কি জবাব দিব বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।

মাস্টার বলিল, ‘শোন তবে ও-হতভাগী যদি অমনি করে ত’ ওর মুখে আমি নুড়ো জ্বেলে দেব না ত’ কী করব?’ অন্তরাল হইতে মাস্টার-গিন্নির কণ্ঠস্বর শোনা গেল ‘হ্যাঁ, তা আবার দেবে না! আ মরি মরি, কি গুণের সোয়ামী গো!’

‘ওই শোন!’ বলিয়া আঙুল বাড়াইয়া মাস্টার বলিল, গলার আওয়াজ শুনেছিস? কাঠে যেন চোট মারচো’
এবারেও গৃহিণী কি যেন বলিলেন, কিন্তু কথাটা ভাল বুঝা গেল না।
মাস্টার তখন বলিতে লাগিলেন, ‘শোন তবে আসল কথাটাই বলি। একদিন একটা খামের চিঠি দেখলাম, মুখটা ভাল করে আঁটা হয়নি। সরিয়ে রাখলাম। এই গাঁয়েরই চিঠি। নিতাই গাঙ্গুলী কয়লা-খাদে চাকরি করো লিখেছে তার বৌ-এর কাছে। নিতাই-এর বয়েস…এই তোদেরই বয়েসী হবে, ছোকরা বয়েস—বৌটিও তেমনি ভাবলাম, পড়েই দেখি না কি লিখেছে। —আঃ! সে কি লেখা রে! হ্যাঁ, বিয়ে করা সাখক! বৌকে যদি অমনি চিঠিই না লিখতে পারলাম…আর ওই দ্যাখ আমার বাড়ীতে—’ বলিয়া মাস্টার আর-একবার তাহার গৃহিণীর উদ্দেশ্যে আঙুল বাড়াইয়া বলিল, ওকে চিঠি লিখব কি,—বিয়ে করা ইস্তক আজ পর্যন্ত মুখে আমার লাথি-ঝাঁটাই মারছে। যেমন প্যাঁচার মতন চেহারা, তেমনি গুণ! বলে কি না, ‘হতভাগা, তোর সঙ্গে আমার বিয়ে না হলে আমি সুখী হতামা’ বলি তাই—’যানা বাপু, যেখানে খুশী তোর চলে যা, যাকে খুশী বিয়ে করগে যা, আমার হাড়টা জুড়োেক।’ কিন্তু ক্ষেমতা নাই। হেঁ হেঁ! তখন বলে কি না—? হ্যাঁ যাব! মেয়েমানুষের যাবার পথ যে নেই রে পোড়ারমুখো! আমি মরবা মরে ভূত হয়ে এসে তোর ঘাড় মটকাব দেখে নিস!’ এই ত’ বাক্যিা যাক, শোন তবে আসল। কথাটাই শোন!’…

বলিয়া মাস্টার একটা ঢোক গিলিয়া একবার এদিক-ওদিক তাকাইয়া বলিল, ‘নিতাই-এর। যেমন বুদ্ধি! দেখি না, চিঠির ভেতর একখানা দশ টাকার নোটা বৌকে পাঠিয়েছে। ভাবলাম, নোটখানা দিই মেরে! ধরবার ছোঁবার ত’ কিছু নেই। তখন আমার সংসারে যা কষ্ট রে, সে আর কি বলব! পঁচিশটি টাকা মাইনো তাই থেকে বোনের তত্ব পাঠালাম দশ টাকার—বাকি পনেরটি টাকায় আর ক’দিন চলে! বাস, নোটখানা সরিয়ে রেখে খেতে গেলাম। খেতে বসে ভাত আর রোচে না, হাত যেন মুখে আর উঠতেই চায় না। খালি খালি ওই নোটটার কথাই মনে হয়। বলি, ‘না বাবা, এ অস্বস্তিতে কাজ নাই। আধ-খাওয়া করে উঠে পড়লাম। বৌ বললে, ‘ও কি গো! এ আবার কি ঢং!’ বললাম, থামো।’ বাস! তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে নোটখানা আবার তেমনি খামের ভেতর পুরে আঠা দিয়ে এঁটে নিজেই হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিতাই গাঙ্গুলীর দরজায় গিয়ে ডাকলাম—নিতাই-এর-বৌকে। বৌ ছেলেমানুষ কিছুতেই আসতে চায় না। বললাম, এসে ওই দরজার পাশে দাঁড়াও মা, তাহ’লেই হবে। আমি ‘পোস্টমাস্টার’। নিতাই-এর বৌ ঘোমটা টেনে এসে দাঁড়ালো! বললাম, ‘এই নাও মা, তোমার চিঠি নাও। চিঠির ভেতর দশ-টাকার একটি নোট আছে। ‘চিঠিখানি বৌ হাতে করে নিলো বললাম, ‘নিতাইকে বারণ করে দিও, বৌমা, এমন করে টাকা পাঠালে টাকা মারা যায়। ‘ ঘাড় নেড়ে বৌ বললে, ‘বেশ।’

বাবা! বাঁচলাম! এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় ফিরে এসে বললাম, ‘দাও, এবার ভাত দাও, খাব।’ বৌ জিজ্ঞেস করলে, কি হয়েছে বল দেখি!’ আগাগোড়া সব কথা বললাম বৌকে। —বৌ বলে কি জানিস?
‘কি বলে?’ বলিয়া মাস্টারের মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম।
মাস্টার হাসিল। বলিল, ‘তবে আর তুই লেখক কিসের রে?’
বলিয়াই মাস্টার আবার আরম্ভ করিল, ‘পোড়ারমুখী বলে কি না,—ওরে আমার কে রে! সাধু শ্যাওড়াগাছ! টাকা তুমি নিলে না কেন?’
‘বাস! এই নিয়ে হ’লো ঝগড়া! বুঝলি এবার?
ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ।’
মাস্টার রাগিয়া উঠিল। বলিল, ছাই বুঝলি। কিছুই বুঝিসনি।–বুঝেও কি তুই ওকে নিয়ে আমাকে ঘর করতে বলিস?
হাসিয়া বলিলাম, ‘কি বলব তা হ’লে?’
‘কি বলবি?’ বলিয়া মাস্টার আমার মুখের পানে তাকাইয়া দাঁত কিসমিস করিয়া বলিল, বলবি —খ্যাঁংরা মেরে বাড়ী থেকে দূর করে দিতে।‘

পোস্টাপিস ও মাস্টারের ‘ফেমিলি কোয়ার্টারে’ মাত্র একটি দেওয়ালের ব্যবধান দেওয়ালের ও-পার হইতে শোনা গেল, হে ভগবান! হে ভগবান! এমন সোয়ামীর হাত থেকে আমায় নিষ্কৃতি দাও ভগবান! চিরজন্মের মত নিষ্কৃতি দাও—হে হরি, হে মধুসূদন!’—বলিয়া মট মট করিয়া আঙুল মটকানোর শব্দ আর কান্না। রাখাল-মাস্টার উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘চল! এ আর চব্বিশঘণ্টা আমি কত শুনব? চল— তোকে খানিকটা এগিয়েই দিয়ে আসি চলা।’

তখন সূর্যাস্ত হইতেছে। বাড়ী ফিরিতে হয় ত’ রাত্রি হইবে। বাহিরে আসিয়া দেখি, অস্ত-সূর্যের স্তিমিত রশ্মি মেঘে-মেঘে প্রতিফলিত হইয়া সারা আকাশটাকে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছে। সম্মুখে হরীতকী, শাল ও মহুয়ার বন। তখন। ফাগুন মাস। সুচিক্কণ মসৃণ পত্ৰভারাবনত বৃক্ষশ্রেণী। শাল ও মহুয়া ফুলের গন্ধেভরা বাতাস। ঢেউ খেলানো অসমতল ভূমিখণ্ডের উপর সুমুখে কয়েক-ঘর সাঁওতালের বস্তি। তাহারই পাশ দিয়া সঙ্কীর্ণ একটি পথ-রেখা আঁকিয়া-বাঁকিয়া বনে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। সেই পথ ধরিয়াই নীরবে চলিতেছিলাম। রাখাল-মাস্টার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, হাঁ রে, লিখেছিস কিছু?

‘কি?
‘বা-রে! ভুলে গেলি এরই মধ্যে? সেই যে বলেছিলাম।
হাসিয়া বলিলাম, তোমার গল্প?
মাস্টার শুধু ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল।
বলিলাম, না, তোমার গল্প আমি আর লিখব না।’

মাস্টার সে কথায় কান দিল না। বলিল, ‘কেন লিখবি না? লিখবি লিখবি। তবে সত্যি কথা লিখিস বাপু। এই ধর—আমার বৌটার কথা লিখবি আগে। লিখবি যে, ওর মত খারাপ মেয়ে আর দুনিয়ায় নেই। মাগীটার কাছ থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি। নিজের চোখেই ত সব দেখে এলি, তোকে আর বেশিকি বলব!’ বলিলাম, ‘আচ্ছা। তুমি এবার যাও, নইলে ফিরতে তোমার রাত হবে।’

‘হোক না। ‘ বলিয়া রাখাল-মাস্টার আমার কাঁধে হাত দিয়া ঈষৎ হাসিল। বলিল, ‘অন্ধকারে সাপে কামড়াবে? কামড়াক না। বাঁচতে আর ইচ্ছে নেই, মাইরি বলছি, বৌটার জ্বালায় এক একদিন মনে হয় আমি মরি।’ বলিয়াই সে ফিরিয়া যাইবার জন্য পিছন ফিরিল বলিল, ‘আসি তবে লিখিস কিন্তু।‘

সম্মতি দিয়া ত বাড়ী ফিরিলাম। লিখিবার চেষ্টাও যে করি নাই তাহা নয়। লিখিয়াছিলাম। ‘পঁচিশটি টাকা মাত্র বেতন। রাখাল-মাস্টারের পোস্টমাস্টারী করিবার কথা নয়! অদৃষ্টের বিড়ম্বনা!

‘বড়লোকের ছেলে নয়। ছেলে নিতান্ত গরীবের তাও যদি বাবা বাঁচিয়া থাকিতেন!
‘শৈশবে পিতৃহীন বালক-মামার বাড়ীতেই মানুষ। মামা মস্ত বড়লোক। প্রকাণ্ড অট্টালিকা, দাসদাসী, লোকজন—তিন তিনটি মোটরকার। তাহারই একটিতে চড়িয়া প্রত্যহ বৈকালে রাখাল বেড়াইতে যায়। যেন পোশাক, তার তেমনি চেহারা। লোকে দেখে আর বলে, ব্যাটার কপাল ভাল।
‘মামা বিবাহ দিলেন। গরীবের ঘরের অনাথা একটি মেয়ে।
‘মেয়ের অভিভাবিকা ছিলেন এক পিসি। মামা নিজে মেয়ে দেখিতে গিয়েছিলেন।’ মেয়ের পিসি বলিলেন, ‘তাই ত’ বাছা, ছেলেটির মা নেই বাপ নেই, তার ওপর মামার কাছে মানুষ…’
মামা বলিয়াছিলেন, সেজন্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বেয়ান, মামা আর অর্ধেক সম্পত্তি ভাগনেকে দিয়ে যাবে।’
‘হয় ত’ দিতেন। কিন্তু এমনি রাখালের অদৃষ্ট যে, তিনি কিছুনা দিয়াই মরিলেন।’
রাখাল বোনের ছেলে, সুতরাং বলিবার কিছুই নাই।
কিছুদিন পরেই দেখা গেল সে তাহার স্ত্রীকে লইয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। —নিরবলম্ব, নিঃসহায়, নিঃসম্বল রাখাল
তাহার পর সে-সব অনেক কথা বলিতে গেলে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ হয়।

‘পথে পথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া অনেক দুঃখ কষ্ট পাইয়া শেষে বহুদিন পরে রাখাল একটি চাকরি পায়—পোস্টাপিসের পিওন। তাহার পর পিওন হইতে হয় পোস্টমাস্টার। ‘কিন্তু এই যে দুঃখ-দুর্ভোগ, ইহাও হয় ত’ সে নীরবে সহ্য করিতে পারিত—যদি সঙ্গিনীটি হইত তাহার মনের মতন।

‘রাখাল বলে, সে দুঃখের কথা আর বোললা না ভাই, মেয়েটা আমাকে ভালবাসে না। ভালবাসলে এত ঝগড়াঝাঁটি, এত কথা-কাটাকাটি হয় না কখনও।’ এই পর্যন্ত লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। লেখা কাগজগুলা প্রায় প্রত্যহই সঙ্গে লইয়া যাইতাম। ভাবিতাম মেজাজ ভাল থাকিলে মাস্টারকে একদিন পড়িয়া শোনাইবা কিন্তু পড়া আমার আর কোনদিনই হইয়া উঠিল না। ভাল মেজাজে রাখাল-মাস্টারকে পাওয়া বড় কঠিন। যে-দিন যাইতাম, শুনিতাম, কেহ-না-কেহ তাহাকে বড় বিরক্ত করিয়া গেছে। বিরক্ত করিবার লোকের অভাব নাই। কেহ একখানা পোস্টকার্ড কিনিতে আসিলেও মাস্টার তাহাকে দাঁত খিচাইয়া তাড়িয়া মারিতে ওঠো অথচ পোস্টাপিসে নানা প্রয়োজনে লোকজন আসিবেই।

গ্রামে তাহার দুর্নামের একশেষ। সবাই বলে, ‘এমন বদ-মেজাজী লোক বাবা আমরা জীবনে কখনও দেখি নি ওর নামে সবাই মিলে একটা দরখাস্ত না করলে আর উপায় নেই!’ কথাটা শুনিয়া বড় দুঃখ হইয়াছিল। মাস্টারকে একদিন বলিয়াছিলাম,—’দ্যাখো মাস্টার, পোস্টাপিসের কাজে যে-সব লোকজন আসবে, তাদের সঙ্গে তুমি ওরকম-ধারা ব্যবহার কোরো না। এতে তোমার ক্ষতি হবে’।

‘ক্ষতি? কি বললি,—ক্ষেতি?’ বলিয়া সে আমার মুখের পানে তাকাইয়া জবাব দিয়াছিল, ‘না। ক্ষেতি আমার কেউ করতে পারবে না তা তুই দেখে নিসা অনেকে অনেক চেষ্টাই করেছিল কিন্তু পারে নি। উল্টে পিওন থেকে পোস্টমাস্টার! ভগবান আমার সহায় আছেন।’ এই বলিয়া মাস্টার চোখ বুজিল। বলিল, ‘ভগবান সহায় না থাকলে…দ্যাখ, আমি যে কারও ক্ষেতি কোন দিন করিনি রে, আমার ক্ষেতি কেউ করবে না দেখিস ক্ষেতি যা কিছু আমার করবার, তা ওই উনি করেছেনা’ বলিয়া সে তাহার অন্তঃপুরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘চুপ! শুনতে পেলে কিছু বাকি রাখবে না।’

চুপ করিয়াই ছিলাম। মাস্টার কিন্তু চুপ করে নাই। বলিতে লাগিল, গাঁয়ের লোক আমার বদনাম করে, না? তা ত’ করবেই, বেটারা নিমকহারাম! আমি সাচ্চা মানুষ কি-না! ওই দ্যাখ—ওই রেজেস্টারী চিঠিখানা ফেলে রেখেছি। কেন রেখেছি জানিস? ওই অবিনাশ-বেটার কাছে সেদিন আমি চাল কিনতে গেলাম, শুনলাম নাকি ব্যাটা টাকায় দশ সের করে চাল বেচছে। আমায় দেখে বলে কি না, না ঠাকুর, চাল আমি আর বিক্রি করব না। টাকায় দশ সের করে ত’ নয়টাকায় আট সেরা’ অনেকক্ষণ চেঁচামেচির পর বললাম, তাই আট সেরই দে না রে বাপু, ঘরে যে গিন্নি আমার জল চড়িয়ে বসে আছে। ‘ অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বললে, না ঠাকুর, মিছে বকাবকি—আমি দেবো না।’ আচ্ছা দাঁড়া রে ব্যাটা অবিনাশ, তোকে কি আমি একদিনও পাব না! বাস, পেয়েছি। রেজেস্ট্রী চিঠি একখানা এসেছে ব্যাটার নামে। আজ দু’দিন হলো—ওইখানেই পড়ে আছে। থাক ব্যাটা ওইখানে পড়ে!’ বলিলাম, কিন্তু এ তোমার অন্যায়, মাস্টার।’ ‘অন্যায়?’ বলিয়া মাস্টার আমার মুখের পানে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিল, ‘তবে আর তুই লেখক কিসের রে?

কি আর বলিব! চুপ করিলাম। কিন্তু রেজেস্ট্রী চিঠি ফেলিয়া রাখা যে অন্যায়, সে কথা বোধ করি রাখালমাস্টার ভুলিতে পারিল না তাই সে আবার আমাকে প্রশ্ন করিয়া বসিল, ‘অন্যায় কিসের শুনি? সে-যে অন্যায় করলে সেটা বুঝি অন্যায় হলো না? আমার অন্যায়টাই অন্যায়?

কি যে বলিব ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। আমার চিঠি কয়খানি লইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছি, মাস্টার ধরিয়া বসিল, ‘ওসব চলবে না। তুই বলে যা।’

বলিলাম, ‘চাল সেনা দেওয়ায় তোমার ক্ষতি কিছু হয় নি কিন্তু এতে যদি তার ক্ষতি হয়? মাস্টার অন্যমনস্ক হইয়া কি যেন ভাবিতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, ‘কিসে ক্ষতি হয়?’

‘চিঠিখানা ফেলে রাখায়!’
‘তাও ত বটে।’ বলিয়া মাস্টার নীরবে বারকয়েক মাথা নাড়িয়া চুপ করিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘ঠিক বলেছিস। লেখক-মানুষ কি-না, বুদ্ধি-সুদ্ধি একটু আছে।’
উভয়েই চুপ। মাস্টার সহসা উঠিয়া দাঁড়াইলা হয়েছে তোর চিঠি নেওয়া? ঘাড় নাড়িয়া আমিও উঠিয়া দাঁড়াইলাম। —

অবিনাশের চিঠিখানা হাতে লইয়া মাস্টার বলিল, ‘চল, তবে নিজেই দিয়ে আসি। কাজ কি বাপু, রেজেস্ট্রী চিঠি, দরকারিও ত’ হ’তে পারে! চল।’

দু’জনে একসঙ্গে বাহির হইতেছিলাম, বাহিরে দরজার কাছে একজন হৃষ্টপুষ্ট লম্বা-চওড়া। সাঁওতাল ছোকরা দাঁড়াইয়া আছে, মাথায় বাবরি চুল, গলায় লাল কাঁটির মালা, হাতে একটা বিড়ালের বাচ্চার মত মেটে-রঙের মরা খরগোসা সাঁওতাল ছোকরাটিকে দেখিবামাত্র রাখাল মাস্টারের মুখোনি শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। চৌকাঠের কাছে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, ‘কে…মুংরা…তুই আজও এসেছিস…?

বলিয়া দাঁত দিয়া ঠোঁট কামড়াইতে কামড়াইতে মাস্টার কি যেন বলিতে লাগিল। মুংরা বলিল, ‘ধেৎতেরি! রোজ রোজ পুইসা নাই, পুইসানাই, আনতে তবে পুঁই বলিস কেনে? অনুমানে ব্যাপারটা কতকটা বুঝিলাম। মুংরাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কত দাম?

মুংরা দাম বলিবার আগেই মাস্টার বলিয়া উঠিল, ‘নিবি তুই? আহা খরগোসের মাংস—বুঝলি কি না—ভারি সুন্দর! আমার বৌ খুব ভালবাসে! দু’তিন মাস ধরে আমাকে বলছে, কিন্তু ছাই এমন দিনে মুংরা আসে যে আমার হাতে পয়সাই থাকে না। আরও দু’বার দুটো এনেছিল, তা ওই যে বললাম, এমন দিনে আসে হতভাগা…! দাম? দাম আর বেশি কোথায়? দাম দু আনা।’

পকেট হইতে একটি দু’আনি বাহির করিয়া মুংরার হাতে দিয়া বলিলাম, ‘দে, ওটা আমাকে দিয়ে যা।’ মুংরা অত্যন্ত খুশী হইয়া হাসিতে হাসিতে দু’ আনিটি হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।

‘দাঁড়া তবে, দাঁড়া।’ বলিয়া মাস্টার তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া লোহার একটি লম্বা ছুরি আনিয়া বলিল, ‘বেশ করে কেটে কুটে ওকে দিয়ে যা মুংরা, বাবু ছেলেমানুষ, কুটতে পারবে না— বুঝলি? সেই তোরা যেমন করে কুটিস—যা—আগে ওই ছোট তালগাছটা থেকে একটা বাগড়ো’ কেটে আন, তারপর তালের এই পাতা দিয়ে বাবুকে জিনিসটা বেশ ভাল করে বেঁধে দিবি, বুঝলি? বাবু হাতে করে ঝুলিয়ে বাড়ী নিয়ে যাবে।’ সুমুখের ছোট তালের গাছ হইতে একটা বাগডো’ কাটিয়া আনিয়া মুংরা খরগোস কাটিতে বসিল।

মাস্টারের রেজেস্ট্রী চিঠি দিতে যাওয়া আর হইল না। বলিল, ‘থাক, পিওনের হাতে পাঠালেই চলবে। ‘ বলিয়া চৌকাঠের উপর চাপিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল, ‘মামার বাড়ী যখন ছিলাম, বন্দুক নিয়ে প্রায়ই শিকার করতে যেতাম। যেতাম বটে, কিন্তু একটা পাখীও কোন দিন মারতে পারি নি। গুলি ছুঁড়তাম। ছোঁড়বার সময় মনে হতো—আহা, কেন মারব? বাস, হাত যেতো কেঁপে, আর শিকার যেতো ফসকে। একদিন একটা কুকুর মেরেছিলাম। মামার ছিল পায়রার সখা বুঝলি?

বলিয়া মাস্টার চোখ বুজিয়া চুপ করিল। বিগত দিনের সুখৈশ্বর্যের স্মৃতি বোধ করি তাহার মনে পড়িল। কিয়ৎক্ষণ পরে চোখ চাহিয়া বলিল, ‘বাড়ীতে অনেকগুলো পায়রা ছিল। নানান রকমের। পায়রা। একদিন একটা পায়রাকে বুঝি বেড়ালে ধরেছিল। পায়রাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতো, ভাল করে উড়তে পারত না পাশের বাড়ীর সুরেশের পোষা কুকুরটা একদিন ঝপ করে এসে তার ঘাড়ে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে দিলে পায়রাটাকে মেরে। আমার রাগ হয়ে গেল। জানিস ত আমার রাগ! বাস, তৎক্ষণাৎ বন্দুক বের করে চালালাম গুলি। দড়াম করে লাগলো গিয়ে কুকুরটার পেটো কাঁই কাঁই করে সে কি তার কান্না! ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। আবার গুলি! বাস! খতম! কুকুরটা ছটফট করতে করতে গোঁ গোঁ করে আমার চোখের সুমুখে মারা গেল। উঃ! সে কি দৃশ্য!

বলিয়া মাস্টার একবার শিহরিয়া উঠিয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বলিল, ‘সেই যে বন্দুক ছেড়েছি, জীবনে আর কোনো দিন…’ এই বলিয়া সেই যে সে মুখ ঢাকা দিয়া চুপ করিয়া রহিল, অনেকক্ষণ অবধি সে আর কথা কহিল না।

তাহার গল্পটা আমার পকেটে-পকেটেই ফিরিত ভাবিলাম ইহাই উপযুক্ত সময়। বাহির করিয়া বলিলাম, ‘গল্প তোমার খানিকটা আমি লিখেছি। শোনো।’

মুখের ঢাকা খুলিয়া মাস্টার বলিল, ‘পড়।’
পড়িলাম। খানিকটা শুনিয়াই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘নাঃ, গল্প লিখতে তোরা জানিস না।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেন?’
মাস্টার খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘না, দুঃখ তুই নিজে পাস নি কোনো দিন, দুঃখুর কথা তুই লিখবি কেমন করে? আমি যদি লিখতে জানতাম ত’ দেখিয়ে দিতাম কেমন করে লিখতে হয়। —আচ্ছা পড়া শুনি শেষ পর্যন্ত।’

শেষ পর্যন্ত শুনিয়া কি একটা কথা যেন সে বলিতে যাইতেছিল, হঠাৎ তাহার নজর পড়িল— মুংরার দিকে। মাংস কুটিয়া সে তখন দু’জায়গায় ভাগ করিতেছে। মাস্টার জিজ্ঞাসা করিল, ‘ও কি রে? দু’জায়গায় কেন?

বলিলাম, ‘আমি বলেছি। একটা তোমার, একটা আমার।’
‘আমার?’ বলিয়া সে আমার মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, বললাম আমার কাছে পয়সা। নেই…তুই আচ্ছা বোকা ত! চারটে পয়সাই বা এখন আমি পাই কোথায়?
বলিলাম, ‘পয়সা তোমাকে দিতে হবে না।’

মাস্টার সকরুণ দৃষ্টিতে একবার তাকাইল, তাহার পর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘চারটে পয়সা খরচ করবার ক্ষমতাও আজ আমার নাই।’ বলিতে বলিতে চোখ দুইটা তাহার জলে ভরিয়া আসিল। বলিল, ‘দাঁড়া, গিন্নিকে দেখিয়ে আনি।’ বলিয়া একটা ভাগ সে দু হাত দিয়া তুলিয়া লইয়া ভিতরে গিয়া হাঁকিতে লাগিল, ‘গিন্নি! ও গিন্নি!’ সেই অবসরে আমার ভাগটা লইয়া আমি পলায়ন করিলাম।

যথাসম্ভব দ্রুতপদে অনেকখানি পথ চলিয়া আসিয়াছি, এমন সময় পশ্চাতে ডাক শুনিয়া তাকাইয়া দেখি, রাখাল-মাস্টার ছুটিতে ছুটিতে আমার পিছু ধরিয়াছে।

সারাপথ ছুটিয়া আসিয়া সে হাঁপাইতে লাগিল। বলিল, ‘পালিয়ে এলি যে? তোকে একবার আসতে হবে।’ বলিয়া সে আমার হাতখানি চাপিয়া ধরিল। বলিলাম, না, রাত হয়ে যাবে, আমি আর যাব না।’ মাস্টার কিছুতেই ছাড়িবে না, বলিল, ‘উঁহু, যেতেই হবে তোকে।’ ব্যাপার কিছু বুঝিলাম না বাধ্য হইয়া ফিরিতে হইল। হাতে ধরিয়া আমাকে পোস্টাপিসের ভিতর লইয়া গিয়া মাস্টার হাঁকিল ধরে এনেছি গিন্নি, ওগো ও শ্রীমতী, কোথায় গেলে?

মাথায় একটুখানি ঘোমটা টানিয়া শ্ৰীমতী আসিয়া দাঁড়াইল —এক হাতে এক গ্লাস জল, আর এক হাতে ছোট একটি পাথরের বাটিতে খানচারেক বাতাসা। মাস্টার বলিল, ‘একটু জল।’ পাছে দুঃখ পায় বলিয়া বাতাসা-কয়টি চিবাইয়া জল খাইলাম।

মাস্টার হাঁকিল, ‘পান? পান কোথা? বলিয়াই সে নিজের ভুল শুধরাইয়া লইল। বলিল, ‘ও, পান ত’ নেই বাড়ীতে পান আমরা দু’জনেই খাই না। আচ্ছা দাঁড়া, দেখি।’

বলিয়া কি যেন আনিবার জন্য মাস্টার ভিতরে যাইতেছিল, কিন্তু তাহাকে যাইতে হইল না, পিতলের একটি রেকাবির উপর চারটি কাটা সুপারি ও কতকগুলি মৌরি লইয়া হাসিতে হাসিতে তাহার স্ত্রী ঘরে ঢুকিলা রেকাবি হইতে সুপারি লইতে গিয়া একবার চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম —আয়ত দুইটি চক্ষু, ম্লান একটুখানি হাসি! গৌরবর্ণ কৃশাঙ্গী যুবতী,—দেখিলে সুন্দরী বলিয়া ভ্রম হয়। তবে সৌন্দর্য যে তাহার একদিন ছিল তাহাতে আর কোনও সন্দেহ রহিল না। দুঃখে দারিদ্র্যে সে সৌন্দর্য আজ তাহার ম্লান হইয়া গিয়াছে।

ভাবিলাম, গল্পে যে জায়গায় তাহাকে কুৎসিত লিখিয়াছি সে জায়গাটা কাটিয়া দিব। বলিলাম, নমস্কার! আজ আসি।’ মাস্টার-গৃহিণী হাসিয়া প্রতি-নমস্কার করিল না, কোনও কথা বলিল না, ম্লান একটু হাসিয়া মাত্র তাহার জবাব দিল।

এ মেয়ে যে কেমন করিয়া মাস্টারের জীবন দুর্বহ করিয়া তুলিতে পারে, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে বাহির হইয়া আসিলাম মাস্টারও আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল।

কিয়দ্র আসিয়া মাস্টার হাসিয়া আমার কাঁধে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘দেখলি?’ কি দেখিলাম সে প্রশ্ন করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না। ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, হ্যাঁ।’

মাস্টার বলিল, ‘দ্যাখ, আমার গল্পের ভেতর সেই যে এক জায়গায় লিখেছিস—ও আমাকে ভালবাসে না, ওটা কেটে দিস। বলিলাম, ‘নিশ্চয়ই।’ ভাবিলাম, গল্পটা আগাগোড়া ছিড়িয়া ফেলিয়া আবার নূতন করিয়া লিখিব।