শেখ ফজলল করিমের ৫ কবিতা
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
শেখ ফজলল করিম আধুনিক মুসলিম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ও কথাসাহিত্যিক। তৎকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল কলকাতা নয়, সেখান থেকে অনেক দূরে রংপুর জেলার এক নিভৃত পল্লী থেকে নিরলসভাবে তিনি সাহিত্যের সাধনা করে গেছেন। তার জন্ম ১৮৮২ সালের ৯ এপ্রিল, মৃত্যু ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তার উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে, পথ ও পাথেয়, ভগ্নবীণা, উন্নতির উপায় কি, পরিত্রাণ, মহর্ষি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির (র.) জীবনী, মহর্ষি এমাম রব্বানি মোজাদ্দাদে আলফসানি (র.), হারুন-অর-রশিদের গল্প, বিবি রহিমা, রাজর্ষি এবরাহীম, পয়গম্বরগণের জীবনী ও কর্মবীজ মুনশি মেহেরুল্লাহ। আজ তার মৃত্যুদিন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধ্যার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
গাঁয়ের ডাক
ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায়
দামাল ছেলের মতো
ডাক দে বলে, আয়রে তোরা আয়
ডাকব তোদের কত!
মুক্ত মাঠের মিষ্টি হাওয়া
জোটে না যা ভাগ্যে পাওয়া
হারাসনে ভাই অবহেলায় রে
দিন যে হলো গত।
ছোট্ট নদী কোন সুদূরে ধায়
বক্ষে রজত-ধারা
ডাক দে বলে, আয়রে ছুটে আয়
রুগ্ন সাহস-হারা।
লাগলে মাথায় বৃষ্টি-বাতাস
উলটে কি যায় সৃষ্টি আকাশ?
রোদের ভয়ে থাকলে শুয়ে রে
নৌকা বাইবে কারা?
ছোট্ট নদী কোন সুদূরে ধায়
বক্ষে রজত-ধারা।
সবুজ বনের শীতল কোলের কাছে
একটি খড়ো ঘর
ডাক দে বলে, ভুলেছো ভাই মোরে
তাই ভেবেছো পর।
ইটের পাঁজায় চক্ষু বুঁজে
নিত্য নুতন অভাব খুঁজে
শেষ হবে তোর জীবনধারা যে
থাকবে বালুচর।
সবুজ বনের শীতল কোণে রে
একটি খড়ো ঘর।
সাত-সকালে ঝাঁপি মাথায় চাষী
মাঠের দিকে যায়
ডাক দে বলে, “এই তো তোদের পথ
বাঁচতে যারা চায়।
পেটের ক্ষিদে মেটে না যার
এই রাতে ঠাঁই কোথা তার?
বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর রে
আবার এসে গাঁয়।”
সাত-সকালে ঝাঁপি মাথায় চাষী
মাঠের দিকে ধায়।
এপিটাফ
আর্দ্র মহীতলে হেথা চির নিদ্রাগত
ব্যথাতুর দীন কবি, অফুরন্ত সাধ
ভুলে যাও একটি তার জনমের মতো
হয়তো সে করিয়াছে শত অপরাধ
পান্থপদ রেণুপুত এ শেষ ভবন
হতে পারে তার ভাগ্যে সুখের নন্দন।
বিশ্বদর্শন
জিব্রাইল জিজ্ঞাসিল নূহ পয়গাম্বরে
‘বলো, বলো বর্ষীয়ান, দয়া করে মোরে
এত বর্ষ আয়ু তব হলো বসুধার
কেমন দেখিলে তুমি বলো না ইহার?’
নূহ বলে, ‘মহাত্মন, কী বলিব আর
দেখিলাম, এক গৃহ, তার দুটি দ্বার,
এক দ্বার দিয়া জীব প্রবেশ করিয়া
অন্য দ্বারপথে সবে যেতেছে চলিয়া।’
সাধন-সৌধ
প্রতিবেশীগণ প্রবীর খৃস্টে কহিল মিনতি করি,
তোমার লাগিয়া দিতে চাই প্রভু, সাধন-সৌধ গড়ি।
খৃস্ট কহেন, গড়ে দাও তবে স্রোতের উপরে ঘর
লোকে বলে, উহা হয় কি কখনো? অসম্ভব ঘোরতর।
মিষ্ট মধুর হাসিয়া প্রেমিক কহিল, বন্ধুগণ
সংসার সুখ-বাসনা পুষিয়া অন্তরে কোন জন
ভজনা করিলে, সে ভজন হয় ব্যর্থ, বিফল তার;
তরুতল মোর সবচেয়ে ভালো, নাহি চাই ঘরদ্বার।
তুলনায় সমালোচনা
শত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে
সহসা একদা পেল সে প্রবীণ কোনো এক মহাজনে।
সুধালো, হে জ্ঞানী, আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার?
জ্ঞানী বলে, বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাই কিছু আর।
পুনঃ সে কহিল, পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারি কি আছে?
জ্ঞানী বলে, বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে।
জিজ্ঞাসে পুনঃ, পাথরের চেয়ে কি আছে অধিক শক্ত?
জ্ঞানী বলে, বাছা, যে হৃদয় হয় জগদীশ প্রেমভক্ত।
কহিল আবার, অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার?
জ্ঞানী বলে, বাছা, ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার।
পুছিল পথিক, বরফের চেয়ে শীতল কি কিছু নাই?
জ্ঞানী বলে, বাছা, স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই।
সুধালো সে জন, সাগর হইতে কে অধিক ধনবান?
জ্ঞানী বলে, বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘শেখ ফজলল করিম রচনাবলি’ থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো