শৃঙ্খল ভাঙার কবি বাঁধা পড়লেন চির-শৃঙ্খলে
সানোয়ার রাসেলপ্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০২৩
বরের মাথায় সাদা চাদর দিয়ে পাগড়ি বাঁধা। কন্যার দেশের বাড়ি কুমিল্লায়। ধর্মে হিন্দু। নাম শ্রীমতি আশালতা সেনগুপ্তা দুলী। বিবাহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে মুসলিম পাত্রের সঙ্গে। কোলকাতার ৬ নং হাজী লেনের একটি বাসায় বাদ জুমা বিবাহের আয়োজন।
হিন্দু-মুসলিমে সিভিল-ম্যারেজ হতে পারে, তবে সিভিল-ম্যারেজ আইন অনুযায়ী বর-কনে উভয়কেই এই বলে স্বীকৃতি দিতে হয় যে, `আমি কোনও ধর্ম মানি না।`
কিন্তু পাত্র এই স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তার কথা হলো, `আমি মুসলমান। মুসলমানি রক্ত আমার শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারবো না।`
তবে কি পাত্রীকে আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে?
পাত্র বললেন, `কারুর কোনও ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোনও জোর নেই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে পরেও করতে পারবেন।`
লাইব্রেরির নাম নূর লাইব্রেরি। নূর লাইব্রেরির মালিক মওলবি মঈনউদদীন হোসায়ন সাহেব বিশিষ্ট সাহিত্যিক। তিনিই হলেন এ বিয়ের কাজী। কুমিল্লার জনাব আব্দুস সালাম হলেন উকিল আর দুজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন হলেন সাক্ষী। এমন অভিনব পদ্ধতির বিবাহ এর আগে তারা আর দেখেননি।
কী করে দেখবেন! পাত্র যে আর কেউ নন, যুগে যুগে তো এমন মানুষ জন্মায় না! শিকল ভাঙার মন্ত্র নিয়ে যে মানুষটি দেশকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে, সেই দুরন্ত কবি কাজী নজরুলই যে এই বিবাহের পাত্র!
বিবাহের কাজী সাহেব কনে শ্রীমতি আশালতা সেনগুপ্তার সামনে গেলেন। কনে লম্বা ঘোমটায় মুখটি ঢেকে রেখেছেন। উকিল সাহেব মুসলমানি কায়দায় জিজ্ঞেস করলেন, `বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম নিবাসী জনাব কাজী ফকির আহমদ সাহেবের পুত্র কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব আপনাকে ১০০০ টাকা দেনমোহরের এওয়াজে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। আপনি তাকে শওহরীয়তে কবুল করতে রাজি আছেন?’
কনে নিশ্চুপ! ব্যাপার কি? কনে কথা বলছেন না কেন? সাক্ষীদের একজন উকিলকে বললেন, `কথাগুলো সহজ বাংলা ভাষায় বলুন। হয়তো কনের পক্ষে মুসলমানি শব্দগুলো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।`
উকিল সাহেব সহজ বাংলায় আবার কথাগুলো বলে শেষে বললেন, `আপনি কি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবকে স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত?`
এইবার ক্ষীণকণ্ঠে জবাব পাওয়া গেলো, `হ্যাঁ, স্বীকৃত`।
-স্বীকৃত?
-হ্যাঁ, স্বীকৃত।
-স্বীকৃত?
-হ্যাঁ, স্বীকৃত।
এরপর কাজী সাহেব নজরুলের কাছ থেকেও স্বীকৃতি আদায় করে আরবি ভাষায় খুতবা পড়ে মোনাজাতের মাধ্যমে বিবাহকার্য সম্পন্ন করলেন।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল রোজ শুক্রবার শৃঙ্খল ভাঙ্গার কবি চির-শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লেন।