শুধু প্রগতিশীলরা কেন, ইসলামি দলগুলো কী করছে?
সুন্দরবন নিয়ে
রিফাত বিন সালাম রূপমপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০১৭
শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং সুন্দরবন হলো বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। হাজার প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই বন, যার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরিবেশের ভারসাম্য। একই সাথে সেখানকার স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু ২০১১ সালে ভারত ও আওয়ামী লীগ সরকারের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ঘোষণার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন।
একমাত্র দেশের প্রগতিশীল দলগুলোই সরকারের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, নিয়মিত আন্দোলনও করছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার জাতীয় কমিটি সুন্দরবন রক্ষায় চার দিনের লংমার্চ শুরু করেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠে আসে, কেন শুধু প্রগতিশীল দলগুলো সংগ্রাম করছে এর বিরুদ্ধে? দেশের এত এত ইসলামি দল কি করছে? তাহলে কি পবিত্র কোরআন বা হাদিসে বন সংরক্ষণ নিয়ে কি কোনো কথা নেই? আল্লাহ কি বন রক্ষার কথা বলেননি? এ ব্যাপারে ইসলাম কি বলে?
ইসলামে ‘বিআ’ বা ‘পরিবেশ’ হল একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যা জীবনের সকল পর্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করে। পরিবেশ কখনো আরও ব্যাপকার্থে জমিন এবং আসমানকেও অন্তর্ভুক্ত করে। আবার কখনো তা সংকুচিত অর্থে মানুষের ঘরকে এবং তার কাজ ও বাসস্থান বোঝায়। এক কথায় পরিবেশ হলো মানুষের চারপাশের সবকিছু। সৃষ্টিজগতের সবকিছু। পানি ও বাতাস এবং প্রাণিজগৎ ও জড়জগতের সব। সেই পরিবেশের শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটানোকে পবিত্র কুরআন ‘বিশৃঙ্খলা’ হিসেবে এবং অধুনা বিজ্ঞান ‘দূষণ’ নামে অভিহিত করেছে। পরিবেশের শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং পৃথিবীর জীবনকে অসম্ভব ও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে এমন যে কোনো অনাচারের বিরুদ্ধেই ইসলাম সোচ্চার।
সামাজিক বিজ্ঞান ও যোগাযোগ বিষয়ে গবেষক মাওলাই মোস্তাফা বারজাওয়ীর লেখা একটা বই থেকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এখানে। ‘পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ইসলাম’ নামের বইটি অনুবাদ করেন আলী হাসান তৈয়ব।
ইসলাম পরিবেশ বা প্রকৃতির বিরুদ্ধে করা যে কোনো অনাচারকে হারাম ঘোষণা করেছে। যার মাধ্যমে মানুষ সামগ্রিকভাবে পরিবেশের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করে তাও নিষিদ্ধ করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে রসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে হলেও, যা মানুষের বসবাসের পৃথিবীর সৌন্দর্যের নিদর্শনগুলোকে বিনষ্ট করে। কারণ পরিবেশের শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়া মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য এক সরাসরি ও প্রচণ্ড হুমকি।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-
قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا
অর্থ: ‘নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তাকে কলুষিত করেছে।’ {সূরা আশ-শামস, আয়াত: ০৯-১০}
অর্থাৎ যারা পরিবেশকে ধ্বংস করে তারা ইসলামের বাণী অমান্য করেছে। একইভাবে তাদের বিশৃঙ্খলাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছে-
وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي ٱلۡأَرۡضِ لِيُفۡسِدَ فِيهَا وَيُهۡلِكَ ٱلۡحَرۡثَ وَٱلنَّسۡلَۚ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلۡفَسَادَ
অর্থ: ‘আর যখন সে ফিরে যায়, তখন জমিনে প্রচেষ্টা চালায় তাতে ফ্যাসাদ করতে এবং ধ্বংস করতে শস্য ও প্রাণী। আর আল্লাহ ফ্যাসাদ ভালোবাসেন না।` {আয়াত: ২০৫}
আরও বলা হয়েছে-
قَدۡ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٖ مَّشۡرَبَهُمۡۖ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ مِن رِّزۡقِ ٱللَّهِ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ
অর্থ: ‘তোমরা আল্লাহর রিজক থেকে আহার করো এবং পান কররো আর তোমরা ফ্যাসাদকারী হয়ে জমিনে ঘুরে বেড়িয়ো না।` {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৬০}
এখানে ‘ফ্যাসাদ’ দ্বারা পরিবেশ বা বন-প্রকৃতি বা জীবন ধ্বংস করাকে বোঝানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলামে বলা হয়েছে চারপাশের জীব ও জড়জগতের প্রতি ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যের দৃষ্টি রাখতে। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
وَمَا مِن دَآبَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا طَٰٓئِرٖ يَطِيرُ بِجَنَاحَيۡهِ إِلَّآ أُمَمٌ أَمۡثَالُكُمۚ ﴾ [الانعام: ٣٨
অর্থ: ‘আর জমিনে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণী এবং দু’ডানা দিয়ে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি, তোমাদের মতো এক একটি জাতি।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৩৮}
অর্থাৎ শুধু মানুষের জন্যই নয়, বরং একই সাথে পৃথিবীতে বসবাসকারী অন্য প্রাণীদেরও রক্ষা করা মানুষের দায়িত্ব, সেটাই ইসলামের মর্মকথা।
একইভাবে হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি (বিনা প্রয়োজনে) গাছ কাটবে আল্লাহ তার মাথাকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ [আবু দাঊদ: ৫২৪১]
অন্য এক হাদিসে বলা হচ্ছে, “একদা জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিঁড়লে নবী ওই ব্যক্তিকে এ রকম না করার পরামর্শ দেন এবং বলেন, ‘প্রতিটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’
কোরআনে এমন আরও অনেক আয়াত আছে। হাদিসে আছে বন-পরিবেশ রক্ষার অনেক পরামর্শ বাণী। বন-পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়ে ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মূল কথা হল, ইসলামের দৃষ্টিতে বন পরিবেশ ধ্বংস করা মহা-অন্যায়।
তাহলে এখন প্রশ্ন উঠে সুন্দরবন কি আসলেই ধ্বংস হচ্ছে?
যদিও সরকার বরাবরই বলছে, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, “দেয়ার উড বি সাম ইমপ্যাক্ট, অবভিয়াসলি (অবশ্যই কিছু প্রভাব পড়বে)। এত নৌকা আসবে, ক্যারিং সো মাচ কোল; এই নৌকা আসার ফলেই তো ফ্লোরা-ফনা ভেরি সাবস্টেনশিয়ালি অ্যাফেক্টেড হবে।”
সোজা কথা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কারণে `অবশ্যই কিছু প্রভাব পড়বে`। প্রচুর কয়লা ভর্তি নৌকা আসা-যাওয়ার ফলে সুন্দরবনের `উদ্ভিদ ও প্রাণী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে`।
কিন্তু তবুও প্রকল্পটি সরাবে না সরকার।
একই রকম কথা বলছেন পরিবেশ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বায়ুদূষণ, ছাইদূষণ, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হলে জলজ প্রাণীদের আবাস সঙ্কট, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির নামে সরকারের প্রতারণা, এমনকি স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থানের মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হচ্ছে।
একই সাথে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাও আপত্তি ও উদ্বেগ জানিয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ কল্লোল মোস্তফার এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনেই রামসার ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে।
সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউনেস্কো সরকারকে প্রথম চিঠি দেয় ২২ মে ২০১৩ তারিখে। ১৫ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে সরকারের ইআইএ রিপোর্ট ইউনেস্কোর হাতে পৌঁছে। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে ইউনেস্কো ইআইএ রিপোর্টের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা উল্লেখ করে সরকারকে চিঠি পাঠায়। সরকারের মতামত ইউনেস্কোর কাছে পৌঁছায় ১৫ এপ্রিল ২০১৪।
এর মধ্যে ইউনেস্কো সুন্দরবনের পাশে একই স্থানে আরেকটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ওরিয়ন গ্রুপের ৫৬৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র) পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। ইউনেস্কো এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ১১ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে সরকারকে আবার চিঠি দেয়। ইউনেস্কোর ৩৮ ও ৩৯তম অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল এবং অন্যান্য দূষণকারী কারখানার ব্যাপারে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ধর্মীয় বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সুন্দরবনের রামপালের এই প্রকল্প কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অর্থাৎ ৭২ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের কী চরিত্র সে সম্পর্কে সকলের কম বেশি জানা আছে। এর আগে ২০০৬ সালে বিএনপি আমলে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখন দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি না করার দাবিতে সেখানে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি চলাকালে তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনজন।
সরকারগুলো কি মাত্রার দুর্নীতিবাজ এবং পররাষ্ট্র-দালাল সে বিষয় নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। কিন্তু দেশের ইসলামিক দলগুলো, যারা সারাদিন ইসলামের কথা বলে তারা কি করছে? আজ তারা কোথায়? সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করছে না কেন?
কারণ অধিকাংশই নামেমাত্র ইসলামি দল। তাদের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা। তাই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ‘ওলামা লীগ’ বা একই ধারার অন্যান্য দল যেমন চুপ, ঠিক একইভাবে ২০০৬ সালে জামায়াতে ইসলামিও মুখ খোলেনি ফুলবাড়ী ইস্যুতে।
যদিও কিছু ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী বলে দাবিদার দল সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। যার মধ্যে আহলে হাদীস আন্দোলন বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা যায়। তারা পদ্মা, তিস্তা ও সুরমাসহ দেশের বড় নদীগুলোকে পানিশূন্য করার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্য ও সুন্দরবন ধ্বংসের পাঁয়তারা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু কখনোই প্রতিবাদ করেনি। আবেদন আর প্রতিবাদ এক বিষয় না। তাদের ‘আবেদন’ আবেদন হয়েই আছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে দেশের কোনো ইসলামি দল জোরাল আওয়াজ তুলছে না সুন্দরবন ধ্বংসের বিরুদ্ধে। সকলেই একটা সুবিধাভোগী অবস্থান নিয়েছে। হয় তারা ক্ষমতা ছাড়া কিছুই বোঝে না, অথবা তারা ইসলাম কি সেটাই বোঝে না। অন্যদিকে যাদের প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করা হয়, সেই ক্ষুদ্র প্রগতিশীল দলগুলোই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে জনগণই একমাত্র পারে বৈজ্ঞানিক এবং ইসলামি আদর্শ ধারণ করে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই ইসলামের মূলশিক্ষা।